প্রাচীণ মিশর ও ফারাওদের রাজত্ব (১ম পর্ব)


মিশরে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রীস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরের এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস মিশরকে বলেছেন নীল নদের দান। ৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়ের মিশরকে প্রাক রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। সে সময় মিশর কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। সেগুলোকে বলা হয় 'নোম'। ৩২০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে মেনেস নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। দক্ষিন মিশরের মেস্ফিস হয় এর রাজধানী। এভাবেই মিশরে রাজবংশের সূচনা হয়েছিল। আর ফারাও হলো গ্রিক রোমান কর্তৃক বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের রাজাদের প্রচলিত উপাধি। প্রাচীন মিশরের নতুন রাজ্যের সময় ফেরাউনরা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা ছিল। তখন বড় বাড়ি বলতে রাজাদের বাড়িকে বোঝানো হত কিন্তু মিশরীয় ইতিহাসের গতিপথের সাথে সাথে তা হারাতে বসে ছিল এমনকি রাজা এর জন্য ঐতিহ্যবাহী মিশরীয় শব্দের পরস্পরিক পরিবর্তনে মধ্যে প্রকাশ করা হয়েছিল। যদিও মিশরের শাসকরা সাধারণত পুরুষ ছিল। ফেরাউন শব্দটা বিরলভাবে মহিলা শাসকদের হ্মেত্রেও ব্যবহার করা হত। ফেরাউনরা বিশ্বাস করত যে দেবতা হরুসের সাথে জীবনের দেহযুক্ত। তারা নিজেদেরকে সূর্যের বংশধর মনে করত। নিজেদেরকে দেবতা বলে মনে করায় তারা বংশের বাইরে কাউকে বিবাহ করত না। ফলে ভাইবোনেদের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হত। ফেরাউনরা মৃত্যুর পরও জীবন আছে বলে বিশ্বাস করত। তাই তাদের মৃত্যুর পর পিরামিড বানিয়ে তার নিচে সমাধিকক্ষে এদের দৈনন্দিন জীবনের ভোগ বাসনার সমস্ত সরঞ্জাম রক্ষিত করত। মৃতদেহকে পচন থেকে বাঁচাবার জন্য তারা দেহকে মমি বানিয়ে রাখত এবং স্বর্ণালঙ্কারে মুড়ে সমাধিকক্ষের সবাধারে রাখা হত।


সম্ভবত প্রাচীন মিশরের সমস্ত রাজবংশের চেয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি পরিচিত। ১৯২২ সালে হোওয়ারড কাটারের মাধ্যমে কবর গুলো খুজে পাওয়া যায়। এর স্বর্ণ অলংকার চোরদের দ্বারা দুইবার চুরি হওয়া সত্ত্বেও আলোড়নসৃষ্টিকারী প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ছিল। তুতাংখামুন সহ মিশরের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ফেরাউনদের কবর সেখানে রয়েছে। অষ্টাদশ রাজবংশ কখনও কখনও থুউতমোসিড রাজবংশ হিসেবেও পরিচিত। কারণ থুউতমোসিসের চারটি ফেরাউনের নামের অর্থ থোথ শিশু, হাতশেপসুত এবং সম্ভবত আরও দু'টি নারী ফেরাউন এই রাজবংশের সময় মিশরের রাজা হয়ে শাসন করেছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৫০ অব্দ নাগাদ প্রথম ফারাওয়ের অধীনে উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের রাজনৈতিক একীকরণের মাধ্যমে এই সভ্যতা এক সুসংহত রূপ লাভ করে। তারপর তিন সহস্রাব্দ কাল ধরে চলে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিকাশপর্ব। প্রাচীন মিশরের ইতিহাস একাধিক স্থায়ী রাজ্য এর ইতিহাসের একটি সুশৃঙ্খলিত ধারা। মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর্ব দেখা দিয়েছিল। সেই পর্ব গুলি অন্তর্বর্তী পর্ব নামে পরিচিত। নতুন রাজ্যের সময়কাল সেই সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশপর্ব। তার পরই ধীরে ধীরে মিশরীয় সভ্যতার পতন আরম্ভ হয়। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের শেষ পর্বে একাধিক বৈদেশিক শক্তি মিশর অধিকার করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ অব্দে আদি রোমান সাম্রাজ্য মিশর অধিকার করে এই দেশকে একটি রোমান প্রদেশে পরিণত করলে ফারাওদের শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়ে যায়। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সাফল্যের আংশিক উৎস নিহিত রয়েছে নীল নদ উপত্যকার পরিস্থিতির সঙ্গে সেই সভ্যতার মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতার মধ্যে। সুপরিচিত বন্যা এবং উর্বর উপত্যকার নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থার ফলস্রুতি ছিল উদ্বৃত্ত ফসল। যা থেকে সেই অঞ্চলের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। সেই সম্পদের সাহায্যেই প্রশাসনের সহায়তায় উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী মরু অঞ্চলে খনিজ পদার্থের উত্তোলন শুরু হয়। একটি স্বাধীন লিখন পদ্ধতির আদি বিকাশ সম্ভব হয় ও স্থাপনা এবং কৃষিজ পণ্যের সুসংহত ব্যবহার শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সামরিক বাহিনী বহিঃশত্রুদের পরাজিত করে মিশরীয় প্রাধান্য স্থাপন করেন। সেই সকল কার্যে প্রেরণা জোগানো এবং একে সুসংহতরূপে সাধন করা ছিল উচ্চবিত্ত লিপিকার, ধর্মনেতা ও ফারাওদের অধীনস্থ প্রশাসকবৃন্দের আমলাতন্ত্রের নিদর্শন। তারা সমগ্র মিশরের জনগণকে একটি বহুব্যাপী ধর্মবিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের সহযোগিতা এবং একতাকে সুনিশ্চিত করেছিলেন।প্রাচীন মিশরীয়দের নানান কৃতিত্বগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য খনি থেকে অট্টালিকাদি নির্মাণের জন্য পাথর খনন ও সমীক্ষণ এবং নির্মাণ কৌশলের দক্ষতা।আর তারই ফলস্রুতি ঐতিহাসিক মিশরীয় পিরামিডসমূহ, মন্দির, ওবেলিস্কসমূহ, মিশরীয় গণিত ব্যবস্থা, একটি ব্যবহারিক এবং কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থা ও কৃষি উৎপাদন কৌশল, প্রথম জাহাজ নির্মাণ, মিশরীয় চীনামাটি এবং কাঁচশিল্পবিদ্যা একটি নতুন ধারার সাহিত্য ও বিশ্বের ইতিহাসের প্রাচীনতম শান্তিচুক্তি।প্রাচীন মিশর এক দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকারকে পিঁছনে ফেলে যায়। প্রাচীন মিশরের শিল্পকলা এবং সাহিত্যের ব্যাপক অনুকৃতি লক্ষিত হয়। বিশ্বের দূরতম প্রান্তে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এর পুরাকীর্তিগুলি। শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাচীন মিশরের পুরাকীর্তিগুলির ধ্বংসাবশেষ পর্যটক এবং লেখকদের কল্পনাশক্তিকে অনুপ্রাণিত করেছে। আধুনিক যুগের প্রথম ভাগে পুরাকীর্তি ও খননকার্যের প্রতি নতুন করে মানুষের আগ্রহ জেগে উঠলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মিশরের সভ্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু হয়। আর তার ফলেই মিশরীয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগুলি মিশর এবং বিশ্ববাসীর সম্মুখে নতুন রূপে উপস্থাপিত হয়।

সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই নীল নদ মিশরের জীবনযাত্রায় মূল ভূমিকা পালন করছে। নীল নদের উর্বর প্লাবন সমভূমি সে অঞ্চলের অধিবাসীদের স্থায়ী কৃষি অর্থনীতি ও একটি জটিল এবং কেন্দ্রীভূত সমাজ গঠনে সাহায্য করে যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।আধুনিক শিকারি সংগ্রাহক মানুষের মধ্য প্লেইস্টোসিন যুগের শেষ ভাগে অর্থাৎ বারো লক্ষ বছর আগে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। পরবর্তী প্যালিওলিথিক যুগ থেকেই উত্তর আফ্রিকার শুষ্ক জলবায়ু আরও উষ্ণ ও শুষ্ক হতে শুরু করে। তার ফলে এই অঞ্চলের মানুষেরা নীল নদ উপত্যকায় ঘন জনবসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়।


রাজবংশ এবং পূর্ব মিশরঃ
প্রাকসম্রাজ্য এবং আদি সম্রাজ্যের কালে মিশরের জলবায়ু বর্তমানের চেয়ে কম শুষ্ক ছিল। মিশরের বড় অংশ ছিল সাভানা এবং সেসকল এলাকায় ক্ষুরযুক্ত পশুপালের বিচরণ ছিল। উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে নীল অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল এবং বিপুল পরিমাণ জলজ পাখিও সেখানে পাওয়া যেত। সেই পরিবেশ শিকারী জীবনযাপন ছিল সাধারণ এবং অনেক প্রাণী সে সময়ে পোষ মানানো হয়। ৫৫০০ খ্রিষ্টপূর্বব্দের মধ্যেই নীলনদ উপত্যকার ছোট ছোট গোত্র বিকশিত হয়ে উন্নত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। তাদের মাঝে পশুপালন এবং কৃষিকাজে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রন লক্ষ্য করা যায়। তাদের মৃতশিল্প এবং বিভিন্ন ব্যক্তিগত জিনিস যেমন চিরুনি,ব্রেসলেট এবং বিড ছিল তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সে সকল আদি সংস্কৃতির মাঝে উচ্চ মিশরে সবচেয়ে বড় ছিল বাদারি। তাদের উৎপত্তি সম্ভবত লিবিয় মরুভূমিতে। উন্নত সিরামিক সামগ্রী ও পাথরের হাতিয়ার এবং তামার ব্যবহারের জন্য তারা সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত ছিল।বাদারিদের পরে আসে আমরতিয় এবং গেরজেহ যারা আরো কিছু প্রাযুক্তিক উন্নতি সাধন করেন। নাকাদা ১ এর সময় থেকেই মিশরীয়রা ইথিওপিয়া থেকে অবসিডিয়ান আমদানি করে তা দিয়ে ব্লেড বানাতে শুরু করে। নাকাদা ২ সময়ে নিকটপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। মাত্র এক হাজার বছর সময়েই নাকাদা সংস্কৃতি ছোট ছোট কিছু কৃষি সম্প্রদায় থেকে এক শক্তিশালী সভ্যতায় পরিণত হয় যে এর নেতারা নীল অঞ্চলের সম্পদ এবং মানুষদের পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়। নাকাদা ৩ এর নেতারা প্রথম নেখেন বা হায়ারকানপলিসে এবং পরবর্তীতে আবিদোসে শক্তিশালী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রভাব নীলনদ বরাবর উত্তর মিশরে বিস্তৃত করেন। তারা দক্ষিণে নুবিয়া, পশ্চিমে লিবিয় মরুভূমির মরূদ্যানগুলি এবং পূর্বে পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও নিকটপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করত। রাজকীয় নুবিয় সমাধির বিভিন্ন হস্তশিল্পে মিশরিয় রাজতন্ত্রের বিভিন্ন চিহ্ণ যেমন সাদা মুকুট এবং শকুন এর সবচেয়ে প্রাচীণ নিদর্শন পাওয়া যায়।

নাকাদা সংস্কৃতি বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ব্যবহার সমগ্রী তৈরি করত যেমন চিরুনি, ছোট ভাস্কর্য, ছবি অঙ্কিত মৃৎপাত্র, উচ্চ মানের নকশাকৃত পাথরের পাত্র, স্বর্ণ, ল্যাপিস, আইভোরির অলংকার। তারা একধরনের সিরামিক গ্লেজ তৈরি করে যা ফাইয়েন্স নামে পরিচিত যা পাত্র, ছোট মূর্তি, এমুলেট অলংকৃত করতে এমনকি রোমান যুগেও ব্যবহৃত হত।নাকাদা সংস্কৃতির শেষের দিকে চিহ্ণলিপি ব্যবহার শুরু করে যা অবশেষে প্রাচীন মিশরিয় ভাষার লিখনপদ্ধতি হায়ারোগ্লিফের জন্ম দেয়।

লেখকঃ ব্লগ সার্চম্যান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info