বিশ্বের ভয়ংকরতম নরপিশাচদের গল্প (পর্বঃ ০৪)


১৫৬০ সালের ৭ আগস্ট তৎকালীন হাঙ্গেরির ট্রান্সিলভানিয়ায় সব চেয়ে অভিজাত আর পুরাতন ব্যাথোরি পরিবারের ঘর আলো করে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক মেয়ে। তার নাম রাখা হল এলিজাবেথ আর নামের শেষে বংশের পদবীটা মিলে হল এলিজাবেথ ব্যাথোরি। স্বভাবতই এলিজাবেথের ছিল ক্ষমতাবান অনেক আত্মীয় স্বজন। এর মধ্যে তার কাজিন ইস্তেভান (১৫৭৫-১৫৮৬ পর্যন্ত পোল্যান্ডের শাসক) ছিল অন্যতম।

১৫৭৫ সালের দিকে যখন এলিজাবেথ ১৫ বছরে পা দেয় তখন তার বিয়ে দেয়া হয় ২৬ বছরের কাউন্ট ফেয়ারএন্তয ন্যাদাস্তি এর সাথে। এসময় এলিজাবেথ ছিল হাঙ্গেরির সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরি। এই নব দম্পতি তখন বসবাস করতে শুরু করে ক্যাসেল শায়তুহ তে। কিন্তু কাউন্ট ছিল খুব যুদ্ধ প্রিয় মানুষ। তাই তার বেশির ভাগ সময়ই কেটে যেত যুদ্ধ বিগ্রহে। তিনি বীর যোদ্ধাও ছিলেন বটে। তার উপাধি ছিল "দ্যা ব্ল্যাক হিরো অফ হাঙ্গেরি"।কাউন্টের এ অনুপস্থিতির এসময়ই তার পুরুষ ভৃত্য থরকো তাকে পরিচয় করায় যাদু বিদ্যার সাথে। এর কিছুদিনের মধ্যে এলিজাবেথ পালিয়ে যায় এক "কালো আগন্তুক" এর সাথে এবং কিছুদিন পরে সে ফিরেও আসে। তারপরে একসময় কাউন্ট ফিরে এলে এলিজাবেথকে ক্ষমা করে দেয় সে, এবং একসাথে বাস করা শুরু করে ক্যাসেল শায়তুহতে। এ সময় এলিজাবেথ যে জিনিসটা একদমই সহ্য করতে পারত না, সেটা হল তার শাশুড়ি। আসলে তার শাশুড়িও তার দুর্বলতার সুযোগে তার উপর প্রভাব খাটানো শুরু করে। এসময় এলিজাবেথ শুরু করে একটি ভয়াবহ কাজ। সে তার সেবিকা ইলোনা জুকে সাথে নিয়ে প্রাসাদের চাকরানীদের উপর নির্যাতন করা শুরু করে। এক্ষেত্রে তার অন্যান্য সহকারী ছিল থরকো, ফিযকো, দুই জাদুকরী মহিলা ডারভুলা এবং দরত্তিয়া। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ১০ টি বছর। ১৫৮৫ সালে জন্ম নেয় তার প্রথম কন্যা সন্তান যার নাম রাখা হয় অ্যানা। এর পরের ৯ বছরের মধ্যে আরও ২ টি সন্তানের জন্ম দেয় এলিজাবেথ। সব কিছু মোটামুটি ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল তখন।

এলিজাবেথ ব্যাথোরি
হঠাৎ করেই এক তীব্র যুদ্ধে মারা পরেন কাউন্ট ন্যাদাস্তি। এসময় ন্যাদাস্তির বয়স ছিল ৫১ বছর। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় এলিজাবেথ এর যুগ। সে প্রথমেই যে কাজটি করে তা হল তার শাশুড়িকে প্রাসাদ থেকে বহুদূরে পাঠিয়ে দেয়। ধারনা করা হয় এসময় এলিজাবেথ যাদুবিদ্যার গভীরে ঢোকে। সে বিভিন্ন রিচুয়াল পালন করা শুরু করে এবং ক্রমাগত ঘোড়াসহ অন্যান্য জীবজন্তু বলি দেয়া শুরু করে।

এভাবে চলছিল সবকিছু। হঠাৎ করেই একদিন এলিজাবেথ লক্ষ করে তার চামড়া কুচকে উঠছে। তার মানে সে বুড়িয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে তার অপূর্ব সৌন্দর্য। সে কিছুতেই এটাকে মেনে নিতে পারল না। পৃথিবীতে সে এই একটা জিনিসই কখনো মেনে নিতে পারেনি। ধীরে ধীরে তার সমস্ত সত্ত্বা দখল করে নিলো এই ভাবনা।

তো একদিনের ঘটনা, তার চাকরানী তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ মেয়েটির চিরুনিতে লেগে চুল ছিড়ে যায় তার। সাথে সাথে এত জোরে সে মেয়েটিকে চড় মারতে শুরু করে যে, মেয়েটির মুখ থেকে রক্ত বেড়িয়ে আসে। সেই রক্তের কয়েক ফোটা গিয়ে পড়ে এলিজাবেথের হাতে। সাথে সাথেই তার মনে হয় তার চামড়া যেন চাকরানীটির কিছুটা যৌবনের সতেজতা নিয়ে নিল। সে এ সময় থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সে চিরকালীন যৌবনের সন্ধান পেয়ে গেছে। আর তা হল কুমারী মেয়েদের রক্ত!

তার কিছুক্ষণ পরেই তার অনুগত ভৃত্য থরকো মেয়েটিকে এক বড়সড় পাত্রের উপর বেধে তার শরীরে আঘাতের পর আঘাত করতে শুরু করে। এর ফলে মেয়েটির নগ্ন শরীর বেয়ে বেড়িয়ে আসতে থাকে রক্তের অবিরল ধারা। এরপর এক সময় মেয়েটি মারা গেলে তার শরীরকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় যাতে মেয়েটির দেহের সম্পূর্ণ রক্ত বের করে আনা যায়। এরপর সব রক্ত সেই পাত্রে জমা করা হলে এলিজাবেথ তার মনের সুখে সেই রক্তে গোসল করল।

এরপর থেকে নিয়মিতই চলতে থাকে এলিজাবেথের এই গোসল পর্ব। তার ভৃত্যরা প্রতিদিন তার জন্য কুমারী যুবতি মেয়ে ধরে নিয়ে আসতো। এসব মেয়েদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে তাদের সমস্ত রক্ত বের করে নেয়া হত। তারপর সেই রক্তে গোসল করত সে। নির্যাতনের এক বর্ণনায় তার ভৃত্য ফিযকো বলে, "তাদের হাত রশি দিয়ে বাধা হল এবং তাদেরকে ক্রমাগত আঘাত করে যাওয়া হল যতক্ষণ না তারা মারা গেল। এসময় তাদের শরীরের চামড়া গুলো কালো কয়লার মত হয়ে যেত, এবং ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। এরপর থরকো তাদের হাতের আঙ্গুল গুলো চামড়া থেকে পশম ছাড়ানোর মত করে টেনে ছিঁড়ে ফেলত। তারপরে তাদের রগ গুলো কাচি দিয়ে ছিঁড়ে দিত যাতে সমস্ত রক্ত বের করে আনা যায়!" 


তবে এক্ষেত্রে এলিজাবেথ সবসময়ই তাদের শেষকৃত্য যেন ধর্মীয় নিয়ম কানুন মেনেই হয় সে ব্যাপারে কঠোর নজর রাখত। তারপর এই সব লাশকে বিভিন্ন জায়গায় পুতে ফেলা হত।

এভাবেই চলছিল একের পর এক! কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন একটি মেয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। আর তার মুখ থেকেই সাড়া শহরে ছড়িয়ে পড়ে এলিজাবেথ ব্যাথোরির এই গোপন ধ্বংসলীলার খবর। তখন কিং ম্যাথুয়াস ১৬১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এলিজাবেথের কাজিন কাউন্ট দায়ার্দুকে পাঠান ক্যাসেল শায়তুহ ঘেরাও করতে। এসময় প্রাসাদে এসে তারা কোন প্রকার বাধার সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু এক রুমে ঢুকে তারা দেখতে পায় একটা মেয়েকে কেটে তার সব রক্ত নিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পাশে একটা জীবিত মেয়ে নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে যার সাড়া দেহে অনেক গুলো গর্ত করা হয়েছে। এরপর তারা প্রিজন সেলে গিয়ে আরও কয়েক ডজন অর্ধমৃত মেয়েদের দেহও উদ্ধার করে যাদের প্রায় সবার শরীরেই অসংখ্য ছিদ্র এবং কোন না কোন অঙ্গ কেটে নেয়া হয়েছে। সবশেষে প্রাসাদের নিচ থেকে আরও প্রায় ৫০ টি ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

এরপর গ্রেপ্তার করা হয় এলিজাবেথ এবং তার বিশ্বস্ত কর্মচারীদের। শুরু হয় বিচারকার্য। কিন্তু এলিজাবেথ সেখানে উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে তার সহকারী ইয়ানোস তার দেখা ৩৭ টা খুনের বর্ণনা দেয়। সে বলে, "মেয়েদেরকে প্রথমে একটা ঝুলন্ত খাঁচায় ভরা হত। তারপরে তাদেরকে একটা ছুরি বা গরম লোহার শিক দিয়ে অনবরত খোঁচান হত। ফলে তাদের দেহ থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পরত। সেই খাঁচার নিচে দাড়িয়ে এলিজাবেথ তার "ব্লাড শাওয়ার" নিতেন।" সেবিকা জুনা এসময় আরও প্রায় ৪০ টি খুনের কথা স্বীকার করে। এভাবে বিভিন্ন কর্মচারীদের স্বীকারোক্তির প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত খুনের সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ৬১২ তে।


বিচারে এলিজাবেথ ছাড়া সবার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সব ভৃত্যদের মাথা কেটে নিয়ে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। আর ২ ডাকিনিকে জীবিত পুড়িয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় এলিজাবেথকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। আর অন্যদিকে কিং ম্যাথাউসের কাছে ব্যাথোরি পরিবার অনেক টাকাও পেত। তাই কিং ম্যাথাউস এর পক্ষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সম্ভব হয়নি। শাস্তি হিসেবে কিং ম্যাথাউস সেই পাওনা টাকা কেটে রাখেন। তাকে ক্যাসেল কাহাতিসে বন্দি করে রাখা হয়। এর প্রায় ৪ বছর পর ১৬১৪ সালে ক্যাসেল কাহতিসে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায় এলিজাবেথ। সেই সাথে তার সকল জিনিসপত্র প্রায় ১০০ বছরের জন্য সিল করা দেয়া হয়। সেই সমাজে এলিজাবেথের নাম নেয়া ও তার সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবেই শেষ হয় এলিজাবেথ ব্যাথোরি তথা "দ্যা ব্লাড কাউন্টেস" এর ইতিহাস! পরে অবশ্য তাকে নিয়ে অনেক গল্প, উপন্যাস, সিনেমা হয়েছে।

সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info
জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info