আওরঙ্গযেব এ উপমহাদেশের অতীত ঐতিহ্যের হীরক খণ্ড। ৫১ বছর শাসনের কোমল কোলে আগলে রেখেছেন এই ভারতবাসীকে। মৃত্যুর শীতল স্পর্শে শেষ নিদ্রায় আশ্রয় নিয়েছেন হিজরী ১১১৭ সালের ২৮ শে যিলকদ। আজো লাখো মানুষের ঢল নামে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে। এই তো ২৬/১০/২০১২ তে ছিল তার ৩০৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। এবারো তার সমাধির পাশে ভিড় করেছিল প্রায় এক লাখ ভক্ত। সংবাদটা পড়ে মনটা দুলে উঠেছিল আনন্দ বেদনায়। মনে হয়েছিল বলবান পিতার অবর্তমানে অসহায় সন্তানরা যেমন করুণ হালে দিন কাটায়, অতঃপর সজল নয়নে পথ চেয়ে থাকে পিতার প্রত্যাবর্তনের আশায়। পিতা ফিরে এলে আছরে পরে পিতার কোলে। ভারতবাসীও যেন এদিন তাদের দরদী পিতার সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করে। হে আওরঙ্গযেব! এই ভারতবর্ষে আশোক রাজার পর আওরঙ্গযেবের রাজত্বই ছিল ছিল সবচেয়ে বিস্তীর্ণ। গজনী থেকে চট্টগ্রাম আর কাশ্মীর থেকে কর্ণটক পর্যন্ত ছিল তার রাজ্য। এই ভারত বর্ষের প্রাচীন আমল আমল থেকে ইংরেজ বর্বদের উত্থান অবধি এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আর কেউ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দৈর্ঘ্য প্রস্থ কোন বিচারেই না।
ভাষা ধর্ম সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র 'আসাম' অঞ্চলকে সুলতান আওরঙ্গযেবই সর্বপ্রথম মোগল পতাকা তলে টেনে আনতে সক্ষম হন। আত্মমর্যাদাবোধ, সাহস, বিচক্ষণতা, প্রশাসনিক দৃঢ়তা, সামরিক অভিজ্ঞতা, অসামান্য মানবিকতা, অসম বীরত্ব ও ধর্মপরায়ণতার যে বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছিল তার চরিত্রে তারই ফসল ছিল ভারত ব্যাপী তার অবিস্মরণীয় শাসনকাল! বিশাল ভারতের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে সিক্ত করেছিল তার উদার ইনসাফ! উদারতা, সাহসিকতা ও মানবিকতার ঝর্ণা জলে ধুয়ে মুছে সাফ করে তুলেছিল ভারতভূমি। ধর্মীয় বিকৃতি, রুগ্ন বিশ্বাসের সংকীর্ণতা, হিন্দু, মুসলিম বিভাজনের সব কুয়াসা মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল তার নীতি সূর্যের প্রখর তাপে।
সুলতান আওরঙ্গযেবের এই প্রবাদসম সফলতার পেছনে বিপ্লবী সংস্কারক আলিম হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীর অবদানের কথা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। আকবরের বিনাশী নতুন চিন্তার প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধাভাজন আলিম সমাজ যে মুক্তির প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন তার প্রদীপ প্রভায় সর্বাধিক আলোকিত ছিল আওরঙ্গযেবের কাল। ফলে বিজয়, শাসন, ইনসাফ ও সমৃদ্ধির বিচারেও তার শাসনকাল ছিল মোগল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। হযরত আলফেসানীর নির্দেশনায় পবিত্র ইসলামের বিমল বিভায় তাঁর ব্যক্তিজীবন এতটা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যে মানুষের মুখে মুখে তিনি ছিলেন 'যিন্দাপীর'। তার সাধনা শাসিত ব্যক্তি জীবনকে কেবল আউলিয়া দরবেশগণের জীবনের সাথে তুলনা করা যায়। নমুনা হিসেবে দুটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছিঃ
১) রমজান মাস! লূ হাওয়ায় তপ্ত বাতাস। দীঘল দিবস। বাদশাহ রোজাদার। ওযীফা তিলাওয়াত ও কোরআনের কপি লিখনে মগ্ন। রাষ্ট্রীয় কাজ কর্ম ও বিচার সালিস তো আছেই। সন্ধ্যায় ইফতার করে মোতি মসজিদে তারাবীহ ও নফলে মশগুল হয়ে পড়তেন। রজনীর অর্ধ প্রহর অতিক্রান্ত হলে সামান্য খাবার গ্রহণ করতেন। রাতে ঘুমাতেন খুবই সামান্য। রাতের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন ইবাদাতে। বরকতপূর্ণ বিশেষ রাত্রি গুলোতে মোটেও ঘুমাতেন না। রমজানের পুরো মাসটাই এভাবে কাটাতেন।
২) ওফাতপূর্ব অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামসুল উলামা যাকাউল্লাহ দেহলবী (রঃ) লিখেছেনঃ
'শরীরের তাপ ছিল প্রচণ্ড। প্রবল অসুস্থতা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ তাকওয়ার বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়তেন। একটি ওসিয়তনামা লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন, টুপি সেলাই করে অর্জিত অর্থের অবশিষ্ট সাড়ে চার রুপি দিয়ে আমার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করবে। পাক কুরআনের কপি তৈরি করে অর্জিত অবশিষ্ট আটশ' পাঁচ রূপি গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে দিবে। শাসক জীবনের একান্নতম বর্ষ। ১১১৭ হিজরী সালের যিলকদ মাসের শুক্রবার। ফযর নামাজ শেষে কালেমায়ে তাওহীদের যিকিরে মশগুল হয়ে পড়েছেন। দিবসের এক প্রহর কেটে গেছে। প্রসন্ন প্রাণে গিয়ে মিলিত হয়েছেন মহান প্রভুর সনে।'
২) ওফাতপূর্ব অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামসুল উলামা যাকাউল্লাহ দেহলবী (রঃ) লিখেছেনঃ
'শরীরের তাপ ছিল প্রচণ্ড। প্রবল অসুস্থতা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ তাকওয়ার বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়তেন। একটি ওসিয়তনামা লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন, টুপি সেলাই করে অর্জিত অর্থের অবশিষ্ট সাড়ে চার রুপি দিয়ে আমার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করবে। পাক কুরআনের কপি তৈরি করে অর্জিত অবশিষ্ট আটশ' পাঁচ রূপি গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে দিবে। শাসক জীবনের একান্নতম বর্ষ। ১১১৭ হিজরী সালের যিলকদ মাসের শুক্রবার। ফযর নামাজ শেষে কালেমায়ে তাওহীদের যিকিরে মশগুল হয়ে পড়েছেন। দিবসের এক প্রহর কেটে গেছে। প্রসন্ন প্রাণে গিয়ে মিলিত হয়েছেন মহান প্রভুর সনে।'
আওরঙ্গযেবের এই আধ্যাত্মিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের কথা স্বীকার করেছেন শ্রীবিনয় ঘোষের মত লোকও। বলেছেন, 'ভারতবর্ষ যদি ইসলাম ধর্মের দেশ হইত তাহা হইলে সম্রাট আওরঙ্গযেব হয়ত ধর্মপ্রবর্তক মুহাম্মদের বরপুত্ররূপে পূজিত হইতেন। বাস্তবিক তাহার মত সচ্চরিত্র, নিষ্ঠাবান, মুসলমান ইসলামের জন্মভূমিতেও দুর্লভ।' তিনি আরো লিখেছেন, 'সম্রাট বলতেন, বিশ্রাম ও বিলাসিতা রাজার জন্য নহে।' শ্রী বিনয় মশাই আরো লিখেছেন, 'বাস্তবিক বিলাসিতার অভ্যাস আওরঙ্গযেবের একেবারেই ছিল না। বাদশাহের বিলাসিতা তো দূরের কথা, সাধারণ ধনীর বিলাস স্বাছন্দ্যও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এড়াইয়া চলিতেন। লোকে তাহাকে যে রাজবেশী 'ফকীর' ও 'দরবেশ' বলিত তাহা স্তুতি নহে ,সত্য। পোশাক পরিচ্ছেদে, আহারে বিহারে তিনি সংযমী ছিলে। সুরা, নারী, বিলাস তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।'
এটিকে আওরঙ্গযেব কর্তৃক লিখিত কোরআনের একটি কপি বলে ধারনা করা হয় |
আওরঙ্গযেবের মানবতাবোধ জনদরদ আর চারিত্রিক দৃঢ়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো পিতা শাহাজানের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ভারত বর্ষে শাহাজানের অমর কীর্তি তাজমহল। প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে হারিয়ে তার স্মৃতি স্তম্ভ হিসাবে শাহাজাহান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য এই তাজমহল নির্মাণ করেন। বাইশ বছর ধরে বিশ কোটি বার লক্ষ রূপি খরচ করে নির্মাণ করা হয় এই মহল। এর ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু এতেও তৃপ্ত হয়নি শাহাজাহানের বিষাদ পীড়িত রাজ হৃদয়।
তাই তিনি তুষার শুভ্র আকাশ স্পর্শী তাজমহলের পর ভ্রমর কালো কৃষ্ণ পাথরের আরেকটি তাজমহল তৈরির পরিকল্পনা করেন। যার ভেতরে থাকবে পান্না, হিরা, পদ্মরাগ, মনি প্রভৃতি অমূল্য ধাতুর সংস্থাপন। আর শুভ্র কৃষ্ণ তাজমহলের সংযোগ পথ তৈরি হবে মাটির ভেতর দিয়ে। ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে যদি এই নতুন তাজমহল সৃষ্টি হতো তাহলে দিল্লীর রাজকোষ অর্থনৈতিক পতনের অতল তলে হারিয়ে যেত। দেশ শিকার হতো চরম আকালের। পিতা শাহজাহানকে আরাম কক্ষে বন্দী করে আওরঙ্গযেব দেশ ও জাতিকে সেদিন এই ভয়ানক আকাল থেকে রক্ষা করেন।
আওরঙ্গযেবের অর্থনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক সুবিচার সমকালীন পৃথিবীকে স্তম্ভিত করেছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ফরাসী পর্যটক বার্নিয়েব এবং তাভার্নিবার। তারা উল্লেখ করেছেন, আওরঙ্গযেবের সাম্যবাদ অর্থনীতি ও শাসননীতি এত সুন্দর ছিল যা, যে কোন নিরপেক্ষ মানুষের মনকে আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত করে। কালমার্কসও ইতিহাসের এই অধ্যায় পড়ে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একথা শ্রী বিনয় ঘোষও তার 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। বিনয় বাবু লিখেছেন, 'বার্নিয়েবের বিশ্লেষণ পাঠ করিয়া কালমার্কসের মত মনিষীও মুগ্ধ হইয়াছিলেন। বেদনার বিষয় হলো, কালমার্কস বুঝলেও বুঝতে রাজী নন ভারতের আধুনিক ইতিহাস রচয়িতারা। তারা নানাভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করছেন ভারতবর্ষের এই অমূল্য ধন আওরঙ্গযেবের শাসন ইতিহাসকে। বিশেষ ভাবে তাকে হিন্দু বিদ্বেষী হিসাবে চিত্রিত করে আধুনিক হিন্দু প্রজন্মের মানসে মুসলিম নির্যাতনের বীজ বপন করতে একবিন্দু কসুর করেননি এই 'মহান' পণ্ডিত গোষ্ঠী।
অথচ ইতিহাস কিন্তু কোনভাবেই স্বীকার করেনা এই 'আধুনিক' দুষ্ট তথ্য। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৪৬ সালের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক হিসাবে রচিত হিন্দুস্থান প্রেস ১০, রমেশদত্ত স্ট্রীট কলকাতা থেকে মুদ্রিত গ্রন্থে আছে, 'জোর করিয়া মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যেই যদি আওরঙ্গযেবের থাকিত, তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বই বোধ হয় আজ দেখা যাইত না।' সেই করা তো দূরের কথা বরং বেনারস, কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দু মন্দির এবং তৎসংলগ্ন দেবোত্তর ও ব্রক্ষ্মোত্তর সম্পত্তি আওরঙ্গযেবের নিজের হাতে দান করিয়া গিয়াছেন। সে সকল আজো পর্যন্ত বিদ্যমান। 'আজও চিত্রকুটের রামাঘাটের উত্তর দিকে অবস্থিত বালাজী মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির, সেখানে গেলে দেখা যাবে মন্দিরের গায়ে লেখা আছে, 'সম্রাট আওরঙ্গযেব নির্মিত বালাজী মন্দির।'
Balaji Mandir, Ramghat, Chitrakoot |
হিন্দু প্রজাদের প্রতি আওরঙ্গযেবের আন্তরিকতা ছিল তার লালিত বিশ্বাসের প্রতিফলন। ভারত বর্ষের অগণিত হিন্দু প্রাচীন কারুকার্যময় মন্দির সমূহই তার উজ্জ্বল সাক্ষী। তাছাড়া মোগলদের হালুয়া ভোগী রাজাদের তালিকা দেখলেও এ সত্য সহজেই অনুমান করা যায়। তাই আওরঙ্গযেবের উদারতার জন্যে প্রমাণ অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি সেকালের হিন্দু সম্প্রদায়। প্রমাণ দিতে হচ্ছে আজ আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভয়ানক সংকীর্ণতার জবাবে এবং এ দেশীয় তাদের মানস সন্তানদের মাসীর দরদ নেভাতে।
Delhi Shri Digambar Jain Lal Mandir was built in 1658 AD |
বেনারস শাসনকর্তা আওরঙ্গযেবকে একখানা গোপন পত্র দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বেনারসকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ঘাঁটি হিসাবে উল্লেখ করে সেখানে ব্রাক্ষ্মণদের উপাসনাভিত্তি শিথিল করার প্রস্তাব দেন যাতে মানুষ ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। জবাবে আওরঙ্গযেব লেখেছিলেন, 'প্রজাদের উপকার সাধন এবং ভিন্ন সকল সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন আমাদের দৃঢ় উদ্দেশ্য। কোন লোক অন্যায় ভাবে ব্রাক্ষ্মণ অথবা তাহাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ অথবা তাহাদের উপর কোন হামলা করিতে পারিবে না। তাহারা যেন পূর্বের ন্যায় স্ব স্ব কার্যে নিযুক্ত থাকিতে পারে এবং আমাদের আল্লাহ প্রদত্ত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য সুস্থ মনে প্রার্থনা করিতে পারে।"
17th century Badshahi Masjid built by Mughal emperor Aurangzeb in Lahore |
সবশেষে আরেকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ঘটনাটি খুব মর্মস্পর্শী। সম্রাট আওরঙ্গযেবের সৈন্য বাহিনী। একজন মুসলমান সেনাপতির অধীনে পাঞ্জাবের একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথে এক ব্রাক্ষ্মণের অপরূপ সুন্দরী কন্যার প্রস্ফুটিত গোলাপ মুখ দেখে গলে যান সেনাপতি। পিতা ব্রাক্ষ্মণকে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আর জানিয়ে দেন, আজ থেকে এক মাসের মাথায় বর সেজে তিনি ব্রাক্ষ্মণের বাড়িতে উঠবেন। পিতা ব্রাক্ষ্মণ বিচলিত! ছুটে গেলেন সম্রাট আলমগীরের কাছে। ঘটনা খুলে বলল। সবিনয় সাহায্য প্রার্থনা করল। আওরঙ্গযেব আশ্বাস ও অভয় দিয়ে বললেন, 'নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে যাও। নির্দিষ্ট দিনে আমি তোমার বাড়িতে উপস্থিত থাকব।' ব্রাক্ষ্মণ নানা চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরল। ভাবছিল, আসলেই কি সম্রাট আমার বাড়িতে আসবেন? হয়তো প্রতিনিধি পাঠাবেন। আর যদি আসেনই তাহলে সাথে হাতি ঘোড়া লোক লশকর! আমি তাদের থাকতে দেব কোথায়? ব্রাক্ষ্মণের মাথায় চিন্তার অন্ত নেই। সব চিন্তার অবসান হলো। ঘটনার ঠিক একদিন পূর্বে মহান সুলতান উপস্থিত! সম্পূর্ণ একা! ব্রাক্ষ্মণতো হতবাক! সম্রাট ব্রাক্ষণের জীর্ণ ঘরে সারারাত ইবাদাত বন্দেগীতে কাটালেন। পরদিন যথা সময়ে সেনাপতি মহোদয় 'বর' বেশে উদিত হলেন। কথা প্রসঙ্গে ব্রাক্ষ্মণকে বললেন, 'বিয়ের আগে কন্যাকে আরেকবার দেখা উত্তম। আপনার কন্যা কোথায়?' ব্রাক্ষ্মণ সম্রাটের শেখানো সুরে সম্রাট যে ঘরটিতে অবস্থান করছেন সে ঘরটি দেখিয়ে দিলেন! সেনাপতি ঘরে ঢুকেই দেখে,সম্রাট আলমগীর কোষমুক্ত তরবারী হাতে! সাহসী সেনাপতি ভয়, লজ্জা, অপমানে থর থর কাঁপতে থাকে। মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ঘটনায় বাকরুদ্ধপ্রায় ব্রাক্ষ্মণও। সম্রাটের কদম জড়িয়ে বলে, 'আপনি আমার কন্যার ইজ্জত রক্ষা করছেন। এই ঋণ অপরিশোধ্য!' সম্রাট ব্রাক্ষ্মণকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'ভাই! এটা আমার কর্তব্য! আমি যে আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি এতেই আমি খুশি।'
Built in 1669 under the rule of Mughal emperor Aurangzeb, the Mosque (masjid) is also known as Alamgir masjid. It stands high above Panchganga ghat on the banks of the river Ganga |
এই তো সম্রাট আওরঙ্গযেব। এই তো আমাদের বাদশাহ আলমগীর। এই মহান বাদশাহ এখন ঘুমিয়ে আছেন আহমদাবাদের খুলতাবাদে স্বীয় পীর ও মুর্শিদ হযরত যাইনুদ্দিন (রঃ) এর সমাধি পাশে। লক্ষ জনতা আওরঙ্গযেবের মাযার সান্নিধ্যে কেন যায়, কী বলে তারা সেখানে গিয়ে, তা জানি না। তবে মনে পরে এই সেই ভারত একদা যার প্রতি ইঞ্চি মাটিসিক্ত ছিল সম্রাট আলমগীরের স্নেহরসে। আর কালের ব্যবধানে এখানেই ঘটেছে মানবতার ইতিহাসে জঘন্যতম পৈশাচিক বর্বর ঘটনা। আজো এই ভারতের মুসলমান 'গুজরাট' শব্দটি শুনলেই ভয়ে শংকায় নীলমুখ হয়ে ওঠে।
আওরঙ্গযেবের সাধাসিধে কবর |
এখানেই নরেন্দ্রমোদীর নির্দেশে গর্ববতী মায়ের পেট থেকে ভ্রুণ বের করে মায়ের চোখের সামনেই শত আর্তনাদ সত্ত্বেও তা টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হয়, একই ঘরের মধ্যে ১৯ জন সদস্যের এক পরিবারকে অবরুদ্ধ করে সেখানে হাঁটু অব্দি ডুবানো হয় হোস পাইপের পানি প্রবাহিত করে, তারপর হাইটেনশন বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে তাদের হত্যা করা হয়। ষোড়শী মেহেরুন নেসাকে তারা নগ্ন করে ঝাপিয়ে পড়ে হায়েনার মত। মেয়েদের ওরা ধর্ষণ করে রাস্তার উপর। ধর্ষণ শেষে মেয়ের যৌনাঙ্গ ওরা ফালিফালি করে কেটে আগুন ধরিয়ে দিত। মাঝে মাঝে ধর্ষণের একপর্যায়ে পাকস্থলীতে রড ঢুকিয়ে দিত, পরে তাকে পোড়ানো হতো। এভাবে তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ১২ বছরের নূরজাহান। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে। এ ঘটনাগুলো গুজরাটের আহমদাবাদের! যেখানে আওরঙ্গযেব ঘুমিয়ে আছেন! ২০০২ সালের দাঙ্গার, খুন, ধর্ষণের, অগ্নি সংযোগের এমন বিকৃত নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কোন বিচার হয়নি বরং মোদী সাহেব ২০০৫ সালের জরিপে গুজরাটের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির আসন জয় করেছেন। পাশাপাশি দুটি ছবি রাখলাম। আজো যারা মুসলিম শাসক, ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নাম শুনলেই পেট ভারি মোষের মত ফোঁসতে থাকেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ছবি দুটি মিলিয়ে দেখুন, জীবনে শত ভাগ ইসলামী আদর্শে নিবেদিত শাসকের রূপ আর উদার ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুত্ববাদী আপনাদের বাবুদের চেহারা দেখুন!
One of the thirteen gates at the Lahore Fort, this one built by Mughal emperor Aurangzeb and named Alamgiri Gate |
জানিনা, গুজরাটের ঘটনার এত বছর পর কি অসহায় অধিকার হারা প্রজারা তাদের হারানো অভিভাবকের কাছে সেই বেদনার নালিশ নিয়ে যায়। হতেই পারে। এই পৃথিবীতে তাদের আর যাবার জায়গা কোথায়?
লেখকঃ অগ্রপথিক।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
লেখকঃ অগ্রপথিক।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন