লাল পিঁপড়ার ভেলা ।। Red Ant Raft

আপনাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছো, যে লাল পিঁপড়াদের চেনেন না? ঐ যে ছোট্ট ছোট্ট লাল পিঁপড়াগুলো, যারা কিনা কামড়ালেই জ্বলতে থাকে। মনে হয়, যেখানে কামড়েছে সেখানে যেন আগুন ধরে গেছে! আর এই কারণেই কিন্তু ইংরেজিতে ওদের আরেকটা নাম ‘ফায়ার অ্যান্ট’। ভাবছেন, তা না হয় হলো। কিন্তু ওদের সঙ্গে লাল ভেলা’র কি সম্পর্ক? বলছি। তার আগে ওদের সম্পর্কে দুটো কথা তো জানা দরকার।

ওদের কিন্তু আরো কয়েকটা মজার মজার নাম আছে। এই যেমন, ‘জিঞ্জার অ্যান্ট’, মানে আদা পিঁপড়া! ওদের এমন অদ্ভুত নাম কেন দেওয়া হয়েছে কে জানে! তবে অদ্ভুত অদ্ভুত নাম থাকলেও ওরা কিন্তু দেখতে মোটেও অদ্ভুত নয়। অন্য পিঁপড়াদের মতোই ওদেরও শরীরে ৩টি প্রধান অংশ মাথা, বুক আর উদর বা পেট যা শরীরের শেষের অংশ। পা থাকে ৩ জোড়া। আর আছে ২টা অ্যান্টেনা। মাথার রং খয়েরি। সেখান থেকে পেছনের অংশ ক্রমশ গাঢ় রঙের।


পিঁপড়াদের জগতে যে ৩ ধরনের পিঁপড়া আছে, সে কথা কি জানেন? একরকম হলো রাণী পিঁপড়া। একটা পিঁপড়াদের দলে একজনই রাণী থাকে। সে আরাম আয়েশ করে, আর বসে বসে ডিম পাড়ে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার ডিম পাড়ে ও একাই! তবেই বোঝেন, ওদের দলে দুই-তিনটি রাণী থাকলে কী হতো! আর ছেলে পিঁপড়ারা বলা যায় একদম অলস। তেমন কোনো কাজও করে না। আর ওরা বেশিদিন বাঁচেও না, বাঁচে মাত্র ৪ দিন। আর আরেক রকম পিঁপড়া হলো কর্মী পিঁপড়া। ওরা সব মেয়ে পিঁপড়া। ওরা বাসা বানানো, তা সংরক্ষণ করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা, সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করা সবই ওরা করে। এমনকি বাসা রক্ষা করার কাজও ওরাই করে। কেন যে সবাই বলে, মেয়েরা কোনো কাজ করতে পারে না!

এবার লাল পিঁপড়াদের লাল ভেলার কথায় আসি। আচ্ছা, আমাদের গ্রামে যখন বন্যা হয়, তখন মানুষ কি করে বলেন তো? বাসা ডুবে গেলে একটা ভেলা বানিয়ে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ে শুকনো ডাঙার খোঁজে। এই লাল পিঁপড়ারাও একই কাজ করে। ভাবছেন, ওদের ভেলার রং লাল হয় বলেই বুঝি বারবার লাল ভেলা বলছি। ওদের গায়ের রং লাল তো, তাই ওরা সবাই মিলে ভেলা হয়ে গেলে সেটার রং তো লাল-ই দেখায়!


না, মোটেও ভুল পড়েননি। সত্যি সত্যি ওরা নিজেরাই তখন ভেলা হয়ে যায়! কিভাবে? যখন ওদের বাসায় বন্যার পানি আসতে থাকে, ওরা তখন তখনই সবাই একসঙ্গে হয়ে যায়। সঙ্গে আবার ওদের সব ডিমগুলোও নিয়ে নেয়। ওদের বাচ্চাদেরকেও যে ওরা খুবই ভালোবাসে! আর তারপর সবাই সবার হাত ধরে (চাইলে পা ধরেও বলতে পারেন! ওদের হাত আর পা তো একই।) একটা ভেলার আকৃতি নিয়ে নেয়। এরপর ভেসে যায় পানিতে। আমরা যেমন ভেলায় চড়ে ডাঙার খোঁজ করতে থাকি, ওরাও তেমনি নিজেরাই এক বিশাল লাল ভেলা হয়ে ডাঙার খোঁজ করে বেড়ায়!


ভাবছেন, তাহলে নিশ্চয়ই নিচের পিঁপড়াগুলো নিশ্বাস না নিতে পেরে মারা যায়? মোটেই না। ওরা কক্ষণো মরে না। কারণ, ওদের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট লোমের একটা স্তর আছে। আর সেই লোমে কিছু বাতাস আটকে থাকে। ওরা পানিতে ডুবে গেলে সেই বাতাসে শ্বাস নিয়েই বেশ কাটিয়ে দিতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছে না? এটা পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা একবার একটা লাল পিঁপড়ার গায়ে ইলাস্টিক দিয়ে একটা ভারি জিনিস লাগিয়ে ওকে দিলো পানিতে ডুবিয়ে। ওরা আবার পানিতে ডোবে না কিনা! শুধু তাই নয়, ওরা পানির ওপর হাঁটতেও পারে! তো যখন ওকে পানিতে ডুবিয়ে দিলো, দেখে কি, পিঁপড়াটার পানির নিচেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওই বাতাস দিয়ে সে দিব্যি পানির নিচেও বেঁচে থাকছে।


আরো মজার ব্যাপার কি জানেন? এই ভেলা কখনো ডোবেও না। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করার জন্য এই ভেলা ডোবানোর জন্য রীতিমতো কসরতও করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এই ভেলা মোটেও ডোবে না। আর লাল পিঁপড়াদের এই বন্ধন আলগাও হয় না। হিসেব করে পাওয়া গেছে, ওরা একজন আরেকজনের হাত যে শক্তিতে ধরে, সেটা ওদের ওজনের তুলনায় ৪০০ গুণ বেশি শক্তিশালী! তবেই বলেন, সেই ভেলা আলগা হবেই বা কেন?


ওরা যে শুধু এই অদ্ভুত ভেলা বানিয়ে ভেসে বেড়ায় শুধু তাই নয়। ওরা এক অদ্ভুত গুচ্ছও তৈরি করে। দেখে মনে হয়, একটা বুদবুদের ভেতরে কতোগুলো পিঁপড়াকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেই গুচ্ছটা যে কতো অদ্ভূত আকারের হতে পারে! কখনো ব্রিজের মতো, কখনো টাওয়ারের মতো। আর এই গুচ্ছটা নিয়ে আপনি ইচ্ছেমতো নেড়েচেড়ে দেখতে পারবেন। টানাটানি করে নানান আকার দিতে পারবেন, বলের মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলতে পারবেন, ওদের বন্ধন মোটেও আলগা হবে না। একদম রাবারের বলের মতো! ওদের ভেলাটাও এরকমই একটা গুচ্ছ। তবে কী, এই গুচ্ছ আরো অনেক পিঁপড়াই বানাতে পারে। কিন্তু ভেলা ওরা ছাড়া আর কোনো পিঁপড়াই বানাতে পারে না।


ওদের এই গুচ্ছের সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন? এই গুচ্ছটা অনেকটা ঘন তরল পদার্থের মতো আচরণ করে। যেমন ধরেন অনেক ঘন করে চা বানালে তা যেমন হতো, ওদের গুচ্ছটাও তেমন। আপনি চাইলে এরকম একটা গুচ্ছ কেতলির মধ্যে ভরে চা ঢালার মতো করে কাপে লাল পিঁপড়া ঢালতে পারবেন!

এতোসব শুনে যারা মনে মনে চিন্তা করছেন, লাল পিঁপড়াদের বাসা পেলেই তাতে পানি ঢেলে ওদের লাল ভেলা দেখবেন, কিংবা লাল পিঁপড়া ধরে ধরে একসঙ্গে করে ওদের দিয়ে অদ্ভূত আকারের গুচ্ছ বানিয়ে নেবেন, সেই চিন্তা এখনি বাদ দেন। কেনো? ওদের ‘ফায়ার অ্যান্ট’ নামটার কথা মনে নেই! ওরা যখন আপনাকে কামড়াবে, তখন শুধু কামড়ই দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে আপনার গায়ে বিষও ঢেলে দেবে। আর সেই বিষ কিন্তু যেন তেন বিষ নয়। আর যদি একসঙ্গে অনেকগুলো কামড়ায়, তবেই হয়েছে! আপনাকে হয়তো হাসপাতালেই নিতে হবে। আর একটা ভেলা বা একটা গুচ্ছ বানাতে যতোগুলো লাল পিঁপড়া লাগে, ততোগুলো যদি কাউকে কামড়েই দেয়, তখন কিন্তু সে মারাও যেতে পারে। ওদের বিষ এমনই ভয়ঙ্কর!


তবে ওরা কামড়ালে ভয়েই মরে যাওয়ার দরকার নেই। এ রোগেরও ওষুধ আছে। যেখানে কামড়ে দেবে, সেখানে স্টেরয়েড ক্রিম বা অ্যালোভেরা মাখতে পারেন, আবার যদি ওষুধ খেতে চান সে ব্যবস্থাও আছে। তবে ভালো বুদ্ধি হলো, বেশি কামড়ে দিলে ডাক্তার দেখানো।

তো, খুব তো লাল পিঁপড়েদের কথা জানলেন। এবার থেকে কিন্তু লাল পিঁপড়েদের থেকে সাবধানে থাকবেন। ওদেরকে মোটেও ঘাঁটাতে যাবেন না। আর মজা করেও ওদের বাসা ভাঙার চিন্তা করবেন না। তবে বন্যায় কি পানির তোড়ে যদি ওদের বাসা কখনো ভেসেই যায়, তখন খুব করে খেয়াল করবেন। হয়তো ওদের সেই লাল ভেলাটা আপনিও দেখে ফেলতে পারবেন। তখন কিন্তু আবার ওদের ধরে খেলা করতে যাবেন না মোটেও। বাসা হারিয়ে তো তখন ওদের মন মেজাজ খুবই খারাপ থাকে। কি করতে কি করে বসে কে জানে!

লেখকঃ নাবিল।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info