মহাপ্রাচীরের গল্প

পৃথিবীতে একটা দেশ আছে, যে দেশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেশটির পুরো উত্তর সীমান্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ২১,১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীরটি পরিচিত "চীনের মহাপ্রাচীর" নামে।


আপনারা কি কখনও দেয়াল টপকে স্কুল পালানোর কথা ভেবেছেন? স্কুল বা বাড়ির চারপাশে দেয়াল থাকে। দেয়াল থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবনের চারপাশেও। যেন কেউ হঠাৎ ঢুকে পড়তে না পারে, সে জন্যই বাড়ির চারপাশে দেয়াল দেওয়া। দেয়াল থাকে জেলখানার চারপাশেও। সে ভীষণ উঁচু দেয়াল। যাতে কয়েদিরা পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য এমন ব্যবস্থা। এমন একটা দেশও কিন্তু আছে, যে দেশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা; সে দেশটির নাম চীন।



আকৃতির দিক থেকে বিশাল একটি দেশ। দেশটির পুরো উত্তর সীমান্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীরটি পরিচিত ‘চীনের মহাপ্রাচীর’ নামে। ছোটখাটো দেয়াল নয়, সে প্রাচীর ভীষণ উঁচু। আর এত চওড়া যে, পাঁচজন ঘোড়সওয়ার পাশাপাশি যেতে পারে। পাহাড়ের উপর দিয়ে এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল অনেক আগে।

চীনদেশে সভ্যতার শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। সে সভ্যতা পরিচিত ছিল চীন সভ্যতা বা চৈনিক সভ্যতা নামে। চীনের উত্তর প্রান্তে ছিল ছোট বড় কয়েকটি রাজ্য। এসব রাজ্যের পরেই নানা যাযাবর জাতির বাস। এরা ছিল জাত লুটেরা, চীনের রাজ্যগুলোর সীমানা পেরিয়ে প্রায়ই হামলা চালাত। লুট করে নিয়ে যেত ক্ষেতের ফসল আর গবাদি পশু। মাঝেমধ্যে গ্রামবাসীদেরও ধরে নিয়ে যেত। ওদের দমন করাও ছিল মুশকিল, ওরা যে আবার দুর্ধর্ষ যোদ্ধাও ছিল। এই যাযাবর লুটেরাদের হাত থেকে রাজ্য ও রাজ্যের মানুষকে বাঁচাতে শুরু হল সীমান্তে দেয়াল তোলা আর দুর্গ স্থাপন। এভাবেই শুরু হল চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ।


খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, মানে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার আটশত বছর আগে, এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। তবে ২২০ থেকে ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীরের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ নির্মাণ করেন চীনের সম্রাট ছিন শি হুয়াং। তিনি চীনের ছোট বড় রাজ্য গুলো দখল করে এক বিরাট চীন সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আর সে জন্যই বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা খণ্ড খণ্ড প্রাচীর গুলো জোড়া দিয়ে তিনি উত্তর সীমান্ত জুড়ে মহাপ্রাচীর গড়ে তোলেন।


চিন রাজবংশের সম্রাট শি হুয়াং এই প্রাচীরের মধ্যে দুর্গও গড়ে তোলেন। সেই দুর্গে সৈন্যরা সীমান্ত পাহারা দিত। শত্রুর দেখা পেলে ধোঁয়া দিয়ে সংকেত দিত।

সম্রাট শিহুয়াংয়ের পর ছিন, হান এবং সুই রাজবংশের বিভিন্ন সম্রাটরাও প্রাচীরের নানা অংশ নির্মাণ করেন বা মেরামত করেন।

তবে এত লম্বা একটা প্রাচীর, তার দেখভাল করা তো সোজা কাজ নয়! এ জন্য প্রাচীরের অনেক অংশ নানা জায়গায় ভেঙে পড়েছিল। পরে মধ্যযুগে মিং সম্রাটরা এই প্রাচীর পুনর্নিমাণ করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ মেরামত করেন।


চীনের এই মহাপ্রাচীর শুধু যে যাযাবর লুটেরাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করত, তাই নয়। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের জন্যও এই প্রাচীর বেশ কার্যকর ছিল।

পাথর, কাঠের ফ্রেমে কাদামাটি ভরে এবং পোড়ামাটির ইট দিয়ে গড়া হয়েছিল মহাপ্রাচীর। সেই যুগের হাতিয়ার বলতে তো ছিল শাবল, কোদাল, ছোট ছোট খুরপি, হাতুড়ি, বাটালি, ছেনি এই সব। সেই সব হাতিয়ার নিয়ে পাহাড়ের উপর পাথর ইট দিয়ে এই প্রাচীর গড়ে তোলা যে কী ভীষণ কঠিন কাজ ছিল, তা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন। এমনকি এই কর্মযজ্ঞ সাধন করতে গিয়ে কত শ্রমিক যে প্রাণ হারায়, তার লেখাজোখা নেই।

শুধু পাহাড়ের উপর দিয়েই নয়, এই প্রাচীর গিয়েছে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর স্তেপ, মরুভূমি আর নদীর উপর দিয়েও। নদীর উপর দিয়ে সেতুর মতো গিয়েছে এই প্রাচীর।

চীনের এই মহাপ্রাচীরকে কল্পনা করা হয় এক বিশাল ড্রাগনের সঙ্গে। পূর্বে শাংহাইকুয়ান থেকে পশ্চিমে টপলেক পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। শুরু আর শেষের দিকে মহাপ্রাচীরকে দেওয়া হয়েছে ড্রাগনের মাথা আর লেজের আকৃতি। ড্রাগনের লেজ গিয়ে নেমেছে সমুদ্রের পানিতে।


এখন তো চীনের এই মহাপ্রাচীর বা গ্রেট ওয়াল পর্যটকদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয় এক জায়গা। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। পর্যটকদের জন্য কিছু কিছু অংশে গ্রেট ওয়ালের উপর চড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের একদম কাছ ঘেঁষেই গিয়েছে গ্রেট ওয়াল। বেইজিং থেকে যারা গ্রেট ওয়াল দেখতে যান, তারা সাধারণত গ্রেট ওয়ালের ‘বাদালিং’ অংশে চড়েন।


মহাপ্রাচীরের এই অংশটি পাহাড়ের উপর। ২৬ ফুট উঁচু পাথরের দেয়াল। ১৬ ফুট চওড়া। পাহাড় বেয়ে প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য রয়েছে কয়েকশ’ ধাপ সিঁড়ি। তবে সবাই তো আর এত লম্বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারবে না; তাদের জন্য রয়েছে কেবল কার নয়তো পুলি দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা।

বাদালিংয়ে গ্রেট ওয়ালের উপরে উঠলে দেখা যায়, চারদিকে পাহাড়ের সারি। তার উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে প্রাচীর। ঠিক যেন ড্রাগনের লম্বা লেজ। শত শত মানুষ সেই প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন।


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আসেন গ্রেট ওয়াল দেখতে। কারণ এর চারপাশের আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের ভিড় থাকে বেশি। তবে শীতে যখন তুষার পড়ে, গ্রেট ওয়াল আর পাহাড়ের সারি তুষারে ঢাকা পড়ে যায়, তখন অন্যরকম এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। তুষার ঢাকা শীতের গ্রেট ওয়াল দেখতেও তখন ভিড় জমায় পর্যটকরা। সারা বছরই গ্রেট ওয়ালের উপর ভীষণ বেগে বাতাস বইতে থাকে। শরৎ আর শীতে তো কথাই নেই। তীব্র হিমেল বাতাসে প্রাচীরের উপর থেকে পড়ে যাওয়াও তখন একেবারেই অসম্ভব নয়। তবু সেই হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে গ্রেট ওয়াল দেখতে আসেন অসংখ্য পর্যটক। কারন? আশ্চর্য সৌন্দর্য, আর উঁচু ও ভীষণ দীর্ঘ মহাপ্রাচীরের রোমাঞ্চকর হাতছানি।

লেখকঃ শান্তা মারিয়া।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info