মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নানা পদ্ধতি

পৃথিবীর দেশে দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রয়োগ নিয়ে নানা কথা আছে। আজ আমি সে সব পদ্ধতি ও তার ব্যবহার বিধি নিয়ে আলোচনা করব। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি গুলো নীচে ধারাবাহিক ভাবে দেওয়া হল।


০১) লিথেল ইনজেকশন প্রয়োগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
১৯৪০ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী তার শত্রুদের বিপক্ষে এই মরণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ১৯৮২ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে এই পদ্ধতি রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল থেকে চীনে এই পদ্ধতি চালু হয়। এখন অনেক দেশে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। শরীরে '100 meq Potassium Chloride' প্রবেশ করিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিটি প্রচণ্ড ব্যথায় চটপট করতে থাকে ও বুকে হাত চাপড়িয়ে ভয়ানক ব্যথার মাধ্যমে দীর্ঘক্ষণ পরে মারা যায়। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি পরিবর্তন করে তিনটি ইনজেকশনের ব্যবস্থা করা হয়। সেগুলো পর পর তিন ধাপে প্রয়োগ করা হয়।
  • 5g Pentothol (Sodium Thiopental), এটি মানুষকে কোমায় নিয়ে যায়।
  • 100mg Pavulon (Pancuronium Bromide), এটি মানুষকে প্যারালাইজড করে দেয়।
  • 100 mEq Potassium Chloride, এটি হৃৎপিণ্ডকে হঠাৎ করে বন্ধ দেয়।
পর পর তিন ধাপে এই ইনজেকশন গুলো দেওয়া হয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায় আক্রান্ত ব্যক্তি হাত নাড়াচাড়া কিংবা চিৎকার করেনি, তবে এই ইনজেকশন পদ্ধতি ব্যবহারে শরীরের বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ অঙ্গে কুড়ালের ন্যায় আঘাতের পর আঘাতের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোকে নিস্তেজ করে।


২) গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যুদণ্ডঃ
১৯২১ নাভাদায় এই পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করা হয়। সুদীর্ঘ ৫০ বছর যাবত মানুষ হত্যার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনী এই গ্যাস ব্যাপক আকারে ব্যাবহার করে। জার্মানি থেকে ইহুদী নিধনে হিটলার বাহিনী এই পদ্ধতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবহার করেছে। এটি দেখতে সিলিন্ডার আকৃতির একটি ছোট্ট কক্ষের মত, বাহিরের বাতাস ভিতরে কিংবা ভিতরের বাতাস বাহিরে আসতে পারেনা। চারিদিকে স্থানে স্থানে কাঁচের জানালা বসানো থাকে, যাতে করে বাহিরে বসে ভিতরের মানুষটির মৃত্যুর দশা দেখা যায়। সিলিন্ডারের বাহিরে একটি রশি টাঙ্গানো থাকে, রশিতে টান মারলে ভিতরে কায়দা করে বসানো পটাসিয়াম সায়ানাইডের ট্যাবলেটটি নীচে রক্ষিত সালফিউরিক এসিডের বাটিতে পড়ে যায়। সালফিউরিক এসিড ট্যাবলেটের বাহিরের আবরণী ধ্বংস করে দেয় এবং আস্তে আস্তে সায়ানাইড গ্যাস নির্গত হতে থাকে। ফলে ভিতরে অবস্থিত মানুষটি ভয়ানক চিৎকার করতে থাকে, তাড়াতাড়ি মরে যাবার জন্য সে দেওয়ালের সাথে নিজের মাথায় আঘাত করতে থাকে, অক্সিজেনের অভাবে বুক ফুলে উঠে, চোখ দুটি কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। পাটাতনের উপর ভয়ানক ভাবে আছড়াতে থাকে এক পর্যায়ে শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়।

পরে এই পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করা হয়। আধুনিক প্রক্রিয়ায় মানুষটিকে একটি বিছানায় শুইয়ে হাত, পা, মাথা, কোমর, হাঁটু ইত্যাদি শক্ত করে বেধে রাখা হয়। পরে আগের পদ্ধতিতে গ্যাস ছাড়া হয়, এতে মানুষটি আর নড়া চড়া করতে পারেনা এবং ওই বিছানাতেই মারা যায়। বিরাট চিমনীতে ঢুকিয়ে হিটলার ২৫০০ মানুষকে এভাবে একত্রে হত্যা করার ইতিহাস আছে। পরবর্তীতে এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেবার পদ্ধতিকে আদালতের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্ধ করা হয়।


৩) ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
এই পদ্ধতি আমেরিকায় আবিষ্কৃত। ১৮৯০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু কার্যকর করার বেলায় এই পদ্ধতি বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে। আমেরিকার দশটি অঙ্গরাজ্যে এই পদ্ধতি এখনও চালু আছে ২০০৪ এবং ২০০৬ সালেও আমেরিকায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে মানুষটিকে তাপ নিরোধক ও বিদ্যুৎ অপরিবাহী একটি চেয়ারে বসানো হয়। তার হাত, পা, বুক, হাঁটু শক্ত করে চেয়ারের সাথে বাঁধা হয়। তারপর ইলেকট্রিকের একটি সংযোগ মাথায় অন্যটি পায়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। একটি কাঁচ যুক্ত বদ্ধ কক্ষে মানুষটিকে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে বাহির থেকে ইলেকট্রিকের সুইচ দেওয়া হয়। মুহূর্তেই ২০০০ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ মানুষটির দেহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে মানুষটির দেহাভ্যন্তরে ১৪০ ডিগ্রীর অধিক তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড তাপে শরীরের অভ্যন্তরে সমূদয় অন্ত্রগুলো এক নিমিষে পুড়ে যায়। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে মানুষটি এক মুহূর্ত নড়া চড়ার করার সুযোগ পায়না। তবে শরীরের বাহ্যিক গঠন আকার এত বেশী পরিমাণ বীভৎস ও দুর্গন্ধযুক্ত হয় যা বাহিরের মানুষের কাছেই চরম নিষ্ঠুর মনে হয়। এটা মূলত মানুষকে সরাসরি পুড়িয়ে হত্যা। তাই আমেরিকার অনেক অঙ্গ রাজ্যে এই পদ্ধতির বদলে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করাকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করে।


৪) ফায়ারিং স্কোয়াড তথা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
এটি একটি পুরানো পদ্ধতি, আমেরিকাতে এই পদ্ধতির ব্যবহার আছে। সামরিক বাহিনীতে এই নিয়মে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এই পদ্ধতিতে মানুষটিকে চোখ-হাত বেঁধে একটি শক্ত স্টিলের পাটাতন দিয়ে নির্মিত চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। যাতে গুলি পিছন থেকে ভেদ করে বাহিরে গিয়ে নতুন অঘটন ঘটাতে না পারে। অতঃপর পাঁচজন শুটার পাঁচটি গুলি ভর্তি রাইফেল হাতে নেন।

নির্দেশকারীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র সবাই চেয়ারে আটকানো মানুষটির হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি ছুড়েন। এতে তার হৃৎপিণ্ড এবং হৃৎপিণ্ডের আশে পাশের অঙ্গ যেমন: ফুসফুস, যকৃত, অম্লাশয় মুহূর্তে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। অসম্ভব কষ্ট পেয়ে মানুষটি মারা যায়। দৃশ্যত মানুষটিকে সাথে সাথেই নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখা যায়, তবে প্রাণবায়ু বের হতে আরও সময় নেয়। কেননা তখনও ব্রেন সচল থাকে এবং মানুষটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। এই সময়ের মাঝে তার পিপাসার সাথে সাথে ভয়ানক মৃত্যু কষ্ট অনুভূত হয়। কেননা এটা এক প্রকার আঘাতের মাধ্যমে মৃত্যু।

এখানে উল্লেখ্য পাঁচটি রাইফেলের চারটিতে তাজা গুলি একটিতে ফাঁকা গুলি থাকে। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তি চারটি গুলির আঘাতে মারা যায়। অন্যদিকে পাঁচজন শুটারের মাঝে একজন শুটার তার হত্যাকারী নয়। কে হত্যাকারী নয় তা নির্ণয় করা ও সম্ভব নয়। ফলে সবাই দাবী করতে পারে নিহত ব্যক্তি অন্তত তার গুলিতে মারা যায়নি।


৫) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
এটি একটি পুরাতন পদ্ধতি। ব্রিটিশেরা এই পদ্ধতি ব্যবহারে দুনিয়া বিখ্যাত। ১৭৫৭ সালে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর ৫১ হাজার মুসলিম আলেমকে এই পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন পার্কে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পরও দীর্ঘদিন লাশ ঝুলিয়ে রাখত। লাশের পচা মাংস পোকা, মাছি খাওয়ার পরে শুধু হাড়গুলো গাছে ঝুলত। ব্রিটিশ থেকে প্রাপ্ত সূত্রে এই পদ্ধতি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র এখনও এই চালু আছে।

ফাঁসি কার্যকর করার জন্য একটি ষ্টেজ তৈরি করা হয়। ষ্টেজ পাটাতনের এক জায়গায় মানুষ নীচে পড়ে যেতে পারে এমন ধরনের ছোট একটি দরজা থাকে, সেই দরজার উপর দাঁড় করানো হয় মানুষটিকে। ইঙ্গিত কারীর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র জল্লাদ একটি লিভারে টান মারে এতে পাটাতনের দরজা নীচের দিকে খুলে যায়। ফলে মানুষটি সেই ফাঁক দিয়ে নীচে পড়ে যায় এবং রশিতে টান খেয়ে গলায় ফাঁস লেগে মারা যায়। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে অনেকগুলো ধাপ সতর্কতার সহিত পার করতে হয়। যেমন, যে রশিতে ঝুলানো হবে তা হতে হবে যেমনি মজবুত তেমনি পিচ্ছিল। রশি যে বীমের সাথে বাঁধানো হবে তা হতে হবে শক্ত এবং আসামীর ওজন সওয়ার মত মজবুত। রশি লম্বায় বেশী নয় আবার কমও নয় কেননা বেশী হলে আসামী মাটিতে পড়ে যাবে কম হলে মৃত দেহ নামাতে সমস্যা হবে ইত্যাদি।

ফাঁসির মাধ্যমে কেউ যখন আত্মহত্যা করে তখন তার শ্বাসনালীতে চাপ পড়ে এবং অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। আত্মহত্যার সময়ে যখন ঝুলে পড়ে তখন সে বাঁচতে চায় এবং হাত উপরে তুলে রশি ধরতে চায় কিন্তু হাত দুটো বেশী উপরে তুলতে পারেনা। তাই মৃত্যুর পর হাত দুটো ইংরেজি ‘টি’ আকৃতির ন্যায় হয়ে পড়ে। চোখ দুটো বেরিয়ে আসে, কখনও চোখ ফেটে রক্ত বের হয়। জিহ্বা বের লম্বা হয়ে আসে ইত্যাদি। তবে ফাঁসির কাষ্ঠে যখন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সেখানে যাতে আসামীর ঘাড় ভেঙ্গে যায় এটার প্রতি বেশী নজর দেওয়া হয়। ঘাড় ভাঙ্গলে তো ভাল কথা তবে কখনও পুরো মাথাটাই ছিঁড়ে যায়। যেহেতু মাথাটি নিদিষ্ট নিয়মে ছিঁড়ে না তাই অনেক সময় এটাকে জোড়া লাগানো যায়না। কথা হল মাথা যদি ছিঁড়ে যায় তিনি অপেক্ষাকৃত কষ্ট কম পান, যদি যার ঘাড় ভেঙ্গে যায় তিনি একটু বেশী কষ্ট পান, যদি কণ্ঠনালীতে চাপ খেয়ে মরেন তবে অসম্ভব ছটফট করতে করতেই মারা যায়। হাত দুটো বাঁধা অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ লাশকে লটকায়ে রাখা হয় সর্বশেষে লাশ নামিয়ে ঘাড়ের মূল রগটি কেটে মৃত্যুকে শতভাগ নিশ্চিত করা হয়।


৬) পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
একটি একটি পুরানো প্রথা। বাইবেলের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী বিবৃতি যোহন ৮.৭ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘যে পাপ করেনি তাকেই প্রথম পাথরটি নিক্ষেপ করতে দাও’। এখানে বিতর্ক হচ্ছিল মৃত্যু নিয়ে, কিভাবে হত্যা করা হবে তার পদ্ধতি নিয়ে নয়। অর্থাৎ তদানীন্তন সমাজে এই প্রথা চালু ছিল, নূতন কিছু নয়। ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারী নারী-পুরুষ দু’জনকেই পাথর মেরে হত্যার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য ইসলাম ধর্মে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে যাকে যেভাবে হত্যা করেছে, তাকেও সেভাবেই হত্যা কর, আর এটাই হবে তার জন্য উপযুক্ত বিচার। তবে বিবাহিত নারী-পুরুষ যদি পরনারী কিংবা পরপুরুষের সাথে ব্যভিচার করে তাকে পাথর মেরে হত্যা কর।


৭) শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি, এটা গিলোটিন পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন যুগে প্রথমে মানুষটিকে একটি বেদির উপর শোয়ানে হত। অতঃপর গলার মত গোল আকৃতির কাষ্ঠ নির্মিত একটি গোলাকার ফাঁকে মানুষের মাথা ঢুকানো হত। শোয়ানো অবস্থায় শরীরকে শক্ত করে বাঁধা হত। তার গলা বরাবর উপরে বিরাট আকৃতির লৌহ নির্মিত ব্লেড ঝুলানো থাকে। ঝুলন্ত ব্লেডের নিয়ন্ত্রণ থাকে একটি লিভারের মাধ্যমে আটকানো রশিতে। জল্লাদের ইঙ্গিত পেয়ে সেই রশি ঢিল করা মাত্র ভারী লোহা নির্মিত ব্লেড আসামীর গলা বরাবর আছড়ে পড়ে। এতে মুহূর্তেই মাথা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। এই পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে পরে তরবারির মাধ্যমে শিরোচ্ছেদ প্রথায় পরিণত হয়েছে। এই পদ্ধতিতে মানুষটির মাথা আলাদা হওয়া মাত্র, সে ধরনের কষ্ট অনুভব করেনা যা অন্য দণ্ড বাস্তবায়নে হয়। কেননা প্রাণীরা সমুদয় ব্যথা, বেদনা, কষ্ট অনুভব মগজের মাধ্যমে। যেহেতু এই নিয়মে মাথা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেহেতু অনুভূতির সমুদয় সংযোগ ও মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।


৮) ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
এটা একটা পুরাতন পদ্ধতি, খৃষ্টানেরা বিশ্বাস করে এই পদ্ধতিতে তাদের ধর্মের প্রবক্তা যীশুকে এই ভাবে হত্যা করা হয়েছে। মুসলমানেরা এই বক্তব্যের নীতিগত বিরোধিতা করলেও যীশুর জীবন কালে এই পদ্ধতি তখনকার সমাজে প্রচলিত ছিল এটা প্রমাণিত হয়। এই পদ্ধতিতে ইংরেজি টি আকৃতির একটি কাষ্ঠ ফলকে আসামীর হাত পায়ে বড় আকৃতির পেরেক মেরে দেয়া হয়। তারপর মানুষ সহ কাষ্ঠ ফলকটিকে রোদের প্রখরতায় মাটিতে গেঁড়ে দেওয়া হয়। তীব্র যন্ত্রণায় আস্তে আস্তে রক্ত শুন্যতায় একদিন কিংবা তারও কম সময়ে মানুষটি মারা যেত। এই শাস্তি মূলত মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য ব্যবহৃত হত।

৯) শূলী বিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
পারস্যের রাজা দারায়ুস এই প্রথা চালু করেন। তার বিরোধী ও শত্রু নির্মূলে তিনি এই পদ্ধতি রাজদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে এই প্রথাকে রোমান শাসক বর্গ চরম অপপ্রয়োগ করেন। মূলত এই বীভৎস পদ্ধতি ব্যবহার করে সরকারের বিরোধী শক্তির মনে আতঙ্ক ধরাই মূল উদ্দেশ্য হত। প্রথমে একটি ধারাল খুঁটি শক্ত করে মাটিতে পোঁতা হত, তারপর মানুষটিকে সেই খুঁটির সূচালো মাথায় বসিয়ে দেওয়া হত। এভাবে মানুষটির নিজের ওজনে আস্তে আস্তে পুরো খুঁটি শরীরে প্রবেশ করত। কলিজা, ফুসফুস ভেদ করে খুঁটির মাথা বুক কিংবা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত। এভাবে তীব্র যন্ত্রণায় কানফাটা আওয়াজে মানুষটি ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত। যদি মানুষটির শাস্তির পরিমাণ আরো ভয়ানক করার দরকার পড়ত, তাহলে খুঁটির মাথা ভোঁতা, অমসৃণ ও অসমতল করা হত। তাহলে পুরো খুঁটি শরীরে পরিপূর্ণ বিদ্ধ হতে বেশী সময় নিত। এভাবে রাজ কর্মচারীরা তার মৃত্যু উপভোগ করত!

১০) আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরঃ
জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রথাটি মধ্যযুগে ইউরোপে চালু ছিল। এই যুগটাকেই মূলত মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলা হয়। বিজ্ঞান পড়া কিংবা গবেষণা করার কারণে বহু বিজ্ঞানীকে এভাবে মরতে হয়েছিল। প্রথমে মাটিতে বড় আকৃতির একটি খুঁটি পোতা হয়, তার চারিপাশে লাকড়ির স্তূপ করা হয়। অতঃপর লাকড়ির স্তূপের উপরে দণ্ডায়মান খুঁটির সাথে মানুষটিকে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়া হত। অথবা লাকড়ির স্তূপের মাঝখানে একটি খালি জায়গা বানানো হত সেখানে মানুষটিকে বসিয়ে তার উপরে আরো লাকড়ি বসিয়ে তাতে আগুন লাগানো হত। এভাবে মানুষটিকে জীবন্ত দগ্ধ করে পুড়িয়ে মারা হত।

আরেকটি মৃত্যুর কথা সকলেই জানে সেটা হল বলী প্রথা। এটি প্রাচীন ভারতে বহুল ব্যবহৃত একটি প্রথার নাম। অজানা অচেনা মানুষ কোন জনবসতির উপর দিয়ে গেলে, তাকে ধরে বলীর জন্য নির্বাচিত করা হত। বলী দেবার পদ্ধতি হল, মানুষটিকে কয়েকজনে শক্ত করে চেপে ধরবে অথবা রশি দিয়ে বেঁধে শক্ত কাঠের উপর মাথা রেখে কোন প্রতিমার সামনে এক কোপে শরীর থেকে মাথা দ্বিখণ্ডিত করা। এটা কোন দণ্ডের নাম নয়। কেননা উপরে যতগুলো প্রথার কথা বলা হয়েছে সেখানে মৃত ব্যক্তিকে জানানো হত তোমার এই অপরাধের কারণে তোমাকে হত্যা করা হচ্ছে। আর বলীর ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি জানতেন না, তার কোন অপরাধের কারণে তিনি মারা যাচ্ছেন!

পথে-ঘাটে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে, প্রতিপক্ষ উৎখাতে, বিরোধী দল নির্মূলে, শত্রু নিধনে বহু ভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ফেনীতে আওয়ামীলীগ-বিএনপির সংঘাতে আক্রান্ত একজনকে ধরে মাটিতে ফেলে ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার বিভিন্ন যায়গা ফুটো করে বীভৎস কায়দায় হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে নিহত ব্যক্তির মানুষেরা প্রতিপক্ষের আরেক জনকে ধরে স’মিলের প্লেটে শুইয়ে সরাসরি তক্তা চিরানোর মত করে পৈচাশিক কায়দায় দুই টুকরো করে ফেলে। ২৮শে অক্টোবরে মানুষকে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মত নির্দয় ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এসব হল হত্যাকাণ্ড যা উপরে বর্ণিত মৃত্যুদণ্ডের সাথে সম্পর্কিত নয়। বিচারকের রায় অনুযায়ী দণ্ড কার্যকর করলেই সেটিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বলা হয়। তাই এখানে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন প্রাপ্ত হত্যাকাণ্ডের নিয়ম, ধরণ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সভ্য জমানায় ও মানুষ ভেবে চলছে কিভাবে মানুষ হত্যা করা যায়, এজন্য অভিনব ও নতুন নতুন পদ্ধতি বের করা হচ্ছে। তার কোনটি মানুষকে নির্যাতন করে মারার উদ্দেশ্যে আবার কোনটি মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিয়ে সহজভাবে মারার জন্য। বেশীর ভাগ মানুষ ব্যথিত হয় দণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিটির মৃত্যু দৃশ্য দেখে। তবে খুব কম সংখ্যক মানুষ ব্যথিত হয় যিনি মারা যাবেন তার মৃত্যু কষ্ট নিয়ে। মৃত্যু এমন এক অনিবার্য সত্য যার সাথে সবার নিশ্চিত সাক্ষাৎ হবে। সেজন্য প্রত্যেকের মৃত্যু প্রত্যক্ষ উচিত। নতুবা মানুষের হৃদয় থেকে বিবেক তিরোহিত হয়ে যায় এবং তাদের জীবনে সর্বদা সত্যের উপর মিথ্যা বিজয়ী হয়।

লেখকঃ নজরুল ইসলাম টিপু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info