তেভাগা'র রাণীমা ।। Tebhaga Queen

ছোট্ট একটি ভুল!
১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। পাকিস্তানী পুলিশের বর্বর হামলায় রাজশাহী জেলার (এখন চাঁপাই নবাবগঞ্জে) নাচোল থানার গ্রামকে গ্রাম পুড়ে গিয়েছিলো। সেদিন এক এক করে চৌদ্দটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ২ হাজার সিপাহী। মৃত্যভয় আর পুলিশের জুলুম নাচোলবাসীকে তাড়া করে ফিরছিলো তখন। তোমাদের মতো শিশু থেকে শুরু করে মা-নানুদের বয়সী নারীদেরকে মারতেও দ্বিধা করেনি ওরা। নিরীহ মানুষ গুলোকে বন্দুক দিয়ে গুলি করে আর হাতের লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করে নরপিশাচরা। কত জনকে যে হত্যা করে, তার ইয়ত্তা নেই।

এর ঠিক ২ দিন আগে ৫ জানুয়ারি হঠাৎ করেই নাচোল থানার পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ৫ জন সিপাহী তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চণ্ডীপুর গ্রামের ২ জন সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করতে আসে। ওখানে তখন সবাই ওদের অধিকারের আন্দোলনে নেমেছে। সেই অধিকারের আন্দোলনই তেভাগা আন্দোলন। খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা সবাই জড়ো হয়ে গেলো। ওরা তো ওই ২ জনকে গ্রেফতার করতেই দেবে না। আর পুলিশও তো ওদেরকে নিয়েই যাবে। উপর থেকে ওদের কাছে সেরকম নির্দেশই এসেছে। তখন হঠাৎ করেই একজন পুলিশ গ্রামবাসীদের একজনকে গুলি করে বসলো। লুটিয়ে পড়লো লোকটি। আর যায় কোথায়, সব গ্রামবাসী মিলে হামলে পড়লো ৬ পুলিশের উপর। মারা গেলো পুলিশ বাহিনীর ওই ৬ সদস্যই। এবার পুরো পুলিশ বাহিনী-ই রেগেমেগে উঠলো। চাষাভুষোদের কত্তো সাহস! না হয় পুলিশ ২ কৃষককে অন্যায়ভাবেই গ্রেফতার করতে গিয়েছিলো, তাই বলে চাষাভুষোরা ছয়-ছয়জন পুলিশকে মেরে ফেলবে!

আর তাই পুলিশের ২ হাজার সিপাহী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে লাগলো। যখন ওখানে গ্রামকে গ্রাম জ্বলছে তখন প্রাণ বাঁচাতে আর গ্রেফতার এড়াতে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্য তেভাগার বিল্পবী নেতারা দু’টো দলে ভাগ হয়ে গেলো। একটি দলের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনের সবার প্রিয় নেত্রী ইলা মিত্র। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাঁওতাল নেতা মাতলা সর্দার। এই দলটি রোহনপুর স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। তখনো তাদের পিছন থেকে ধাওয়া করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে আছে মিলিটারিরাও। জমিদার পরিবারের একজন হলেও নিজেকে আড়াল করতে ইলা মিত্র সাঁওতালি পোশাক পরেছিলেন। আর তিনি ঝরঝরে সাঁওতালী ভাষাও বলতে পারতেন। স্টেশনে পৌছানোর পরে তারা প্লাটফর্মে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় পুলিশে ছেঁয়ে গেছে সারা স্টেশনে। তারা এসেছে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে গ্রেফতার করতে। আর ইলা মিত্রও সাঁওতালি পোশাক পরে একেবারে খাঁটি সাঁওতালি নারী বনে গেছেন। তাকে জমিদার ঘরের মেয়ে বলে কে চিনবে? আর তার গাঁয়ের রংও সাঁওতালদের মতোই কালো ছিলো; রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির মতোই।

হঠাৎ-ই ছোট্ট একটা ভুল করে বসলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লেখাপড়া জানা মেয়ে ইলা। তার কোমরে একটা ঘড়ি গোঁজা ছিলো। তিনি যেই না সেটি বের করে নিচু হয়ে সময় দেখতে গেলেন, অমনি পুলিশের এক চর সন্দেহ করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সেখানকার সবাইকে পাকড়াও করে ফেললো। শেষ মুহূর্তে ধরা পরে গেলেন তেভাগা আন্দোলনের রাণী মা ইলা মিত্র।

এর আগের গল্পঃ তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
ভূমিহীন কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গত শতকের চল্লিশের দশকে এই ভূ-খন্ডে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকে চিরতরে থামিয়ে দিতে বরাবরের মতোই দমন পীড়নের পথে নেমেছিলো অভিযানে নেমেছিলো বৃটিশ শাসকরা। পরে পাকিস্তানিরাও একই পথ অবলম্বন করেছিলো। তো ইলা মিত্রের গল্প শোনার আগে এই আন্দোলনের গল্পও তো একটু শোনা দরকার, নাকি? তবে চলো শোনা যাক সেই আন্দোলনের গল্প।

বৃটিশরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করার আগে এদেশে কৃষি জমির মালিক ছিলো সাধারণ চাষীরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল খাজনা হিসেবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোষাগারে, মানে রাজাদেরকে দিতো। কিন্তু এই ব্যবস্থা পুরো উল্টে গেলো বৃটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করলে। নতুন আইনে চাষীদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী বৃটিশদের খাজনা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু জমিদারদের সঙ্গে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণী তৈরি হয়। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিতো। জোতদার শ্রেণী কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষককে দিলেও উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ারী'। আবার সূর্যাস্ত আইনের কারণে অনেক পুরোনো বনেদী জমিদার পরিবার তাদের জমিদারি হারাতে লাগলো। আর সেটা বেশি দামে কিনে নিলো কলকাতার অনেক উঠতি ব্যবসায়ী পরিবার। জমিদাররা তো তবু গ্রামে থাকতো। এই পরিবারগুলো গ্রামেও থাকতো না। জমিদারিতে জোতদার নিয়োগ করে কলকাতা থাকতো, আর মৌসুম শেষে এসে টাকা নিয়ে যেতো। আর অতিরিক্ত দামে কেনা জমিদারির টাকা শোধ করতে ওরা অতিরিক্ত করও চাপাতে শুরু করলো। ফলে দিন দিন গরিব কৃষকদের উপর অত্যাচার-অবিচার আর শোষণ-নির্যাতন বাড়তেই থাকলো।

ফলে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার বড়ো বড়ো কৃষক পরিবারগুলোও পরিণত হলো আধিয়ার কৃষক আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকদের মনে ক্ষোভ তৈরি করতে থাকে। এই ক্ষোভকে সংগঠিত করতেই ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব করে ‘ফাউন্ড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে চাষীদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের একভাগ রাজস্ব হিসেবে নেয়া। মানে, বাকি দুই ভাগই পাবে কৃষকরা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ সহ আরো নানা অন্যায় কর আদায় করা হতো। সব মিলিয়ে কৃষকদের আন্দোলন দিন দিন জোরালো হতে থাকে। চল্লিশের দশকে এই আন্দোলনের রাজশাহী অঞ্চলের নেতৃত্ব দেন আমাদের ইলা মিত্র।

ইলা মিত্র থেকে রাণীমাঃ
১৯৪২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (বাংলা ১৩৫০ সনে) সমগ্র বাংলায় এক বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকদের ওপর শোষণের মাত্রা আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এবার মরিয়া হয়ে ওঠে কৃষক সমাজ। বিশেষ করে হিন্দু ও সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত নাচোল এলাকায় তো অত্যাচারের মাত্রা ছিলো আরো বেশি। আর তাই এখানে আন্দোলনও দিন দিন জোরদার হতে থাকে। ইলা মিত্রের নেতৃত্বে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত মোট ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ নিজেদের বলে দাবি করতে শুরু করে। আর কৃষক যদি উৎপাদিত ধান থেকে চাল তৈরি করে তাহলে ২০ ধামা চালের মধ্যে ৭ ধামা ধান নেবেন শ্রমিকরা। আর ১৩ ধামা রাখবেন জমির মালিক।


ভাবছেন, সরল কৃষকরা এতো হিসাব কষলো কিভাবে? ওখানেই তো ইলা মিত্রের মতো নেতা-নেত্রীদের কৃতিত্ব। ইলা মিত্র কৃষকদের এই বিষয়ে সচেতন করতে পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজেই চষে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। কথা বলেছেন ক্ষেতমজুর, দিনমজুর, চাষী, ক্ষুদ্র কৃষক সবার সাথে। সবাইকে একাট্টা করেছেন। আর এই করতে গিয়ে কৃষক-মজুরেরা তাকে এতোই ভালোবেসে ফেললো, যে সবাই মিলে তার নাম দিলেন ‘রাণীমা’। শুধু তাই না, গ্রামের কবিয়ালরা তাকে নিয়ে গানও বেঁধেছিলেন,

‘লীলা মিত্রী নারী
আইন করলো জারি
আধি জমি তিকুতি ভাগ
জিন হলো সাত আরি ভাই
জিন হলো সাত আরি’


অল্প কথায় তেভাগার গল্পঃ
তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় যখন, তখন বৃটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান আর ভারত আলাদা হচ্ছে। ১৯৪৬-৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশ সূচনা করেন তেভাগা আন্দোলনের। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষীদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে ইলা মিত্রের স্বামী জমিদার পুত্র রামেন্দ্র মিত্রকে গ্রামের কৃষক সমাজের মধ্যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে কলকাতা থেকে রামচন্দ্রপুর হাটে পাঠানো হয়। আর স্বামীর সাথে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠিত করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন ইলা মিত্র নিজেও। ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে। এ সময় ইলা মিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত গ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান। তখন নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছিলেন।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর মিত্র পরিবারের জমিদারি অঞ্চল রামচন্দ্রপুর হাট পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার মুসলমানদের দেশ ‘পাকিস্তান’ ছেড়ে হিন্দুদের দেশ ‘ভারত’এ চলে গেলো। কিন্তু ইলা মিত্রের শাশুড়ি এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেন যাবে বলো, এটাই যে তাদের দেশ। পাকিস্তান হবার পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। তখনো যে কৃষকেরা তাদের তিন ভাগের দুই ভাগ ধানের অধিকার পায়নি। তখন আবার পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। আর মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হয়েই কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করে। কমিউনিস্ট পার্টিকে করা হয় নিষিদ্ধ। পার্টির শীর্ষ স্থানীয় যতো হিন্দু নেতা ছিলো, সবাইকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সরকারের এই দমননীতির ফলে কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলনের নেতারা আত্মগোপন করে কাজ করতে থাকেন। ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্রও নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করে ছিলেন।

হার না মানা রাণীমাঃ
ইলা মিত্রকে তো ট্রেন স্টেশন থেকে তাঁর বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ সহযোদ্ধা সহ গ্রেফতার করলো পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার অভিযোগ আনা হলো। এবার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ইলা মিত্র সহ অন্য সাঁওতালদের উপর শুরু হলো অমানুষিক নির্যাতন। বিশেষ করে ইলা মিত্রের উপর যে নির্যাতন করা হয়, সে মুখে বলার মতো নয়। নাচোল থানায় টানা ৪ দিন তাকে নির্যাতন করা হয়। আর এই ৪ দিনের বেশিরভাগ সময়েই তিনি ছিলেন অজ্ঞান অবস্থায়। যতোবার তাঁর জ্ঞান ফিরে এসেছিলো, ততোবার তাকে নতুন করে নির্যাতন করতে শুরু করেছিলো পাকিস্তানী পুলিশ।


এরপর ১০ জানুয়ারি তাকে নবাবগঞ্জ থানায় পাঠানো হয় মুমূর্ষু অবস্থায়। এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেশ ভালো ছিলেন। তিনি ইলা মিত্রের সেবা যত্নও করেন। এ প্রসঙ্গে ইলা মিত্র পরে বলেন, ‘নবাবগঞ্জ থানার ওসি মিস্টার রহমান আমাকে জানতেন। আমি যখন বেথুনে পড়ছি তখন তিনি স্কটিস চার্চ কলেজের ছাত্র। সেদিন আমার ১০৫ ডিগ্রি জ্বর ছিলো। আমার সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাচ্ছি। ওসি রহমান হঠাৎ করেই সেদিন রাতে আমার সেলে আসেন। আমার মাথায় পানি ঢালেন। তিনি আমাকে কিছু ফল খেতে দেন। আমি তার অধীনে ৭ দিন ছিলাম। সেদিন তিনি আমার সেবা না করলে আমি হয়তো মরেই যেতাম।’

এ সময় তার চিকিৎসা করেন ডাঃ আইয়ুব। এরপর তাকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করানোর জন্য জোরজবরদস্তি করা হয়। তিনি তো করবেনই না। করলেই তো উপরে যা খুশি তাই লিখে ইচ্ছেমতো তাঁর বিচার করতে পারবে পাকিস্তান সরকার। না পেরে তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে বছরই রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে কী পৈশাচিক উপায়ে নির্যাতন করা হয়েছে সে বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দী দেন। ৫ জানুয়ারি পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামী করে তার এই বিচার শুরু হয়েছিলো। তাকে অভিযুক্ত করে সাজাও দেয়া হয়। তবে এই অন্যায় রায়ের বিরুদ্ধে কুমিল্লার ডাকসাঁইটে অ্যাডভোকেট কামিনী কুমার দত্ত ঢাকা হাই কোর্টে আপিল ঠুকে দেন। আর কামিনী কুমার দত্তকে সহায়তা করেন কলকাতার আইনজীবী মিস্টার ইউসুফ জালাল।

জয় রাণীমার জয়!
বিচারক ইলিয়াস এবং বিচারক ইস্পাহানীর বেঞ্চে ১৯৫২ সালের ২২ এপ্রিল ইলা মজুমদারের আপিলের শুনানি শুরু হয়। সে সময়েও তিনি এতোটাই অসুস্থ ছিলেন, দাঁড়াতে কি হাঁটতে গেলেও তাঁকে অন্যের সাহায্য নিতে হতো। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ১৯৫৩ সালে ডাঃ এস কে আলমের নেতৃত্বে একটি বোর্ড গঠন করা হয়, শুধু তার চিকিৎসা করার জন্যই। ততোদিনে ঢাকায় মওলানা ভাসানীসহ ছাত্র ও সাধারণ জনতা তার মুক্তির দাবি তুলতে শুরু করেছে। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজে অসংখ্য লোক তাকে দেখতে যেতো।

শেষমেশ আর না পেরে চিকিৎসার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসার কাছে হার মানে পাকিস্তান সরকার। তাকে ঢাকা থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে তিনি আবারো লেখাপড়া করতে শুরু করেন। পরে প্রাইভেট ক্যান্ডিডেট হিসেবে ১৯৫৭ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন। পরে কলকাতা সিটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তখন তাঁর স্বামী সিপিআই-এ যোগ দিয়েছেন, জাঁকিয়ে রাজনীতি করছেন। তিনিও পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। সেখানেও তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। শুধু তাই না, ১৯৬৭-১৯৭৮ পর্যন্ত টানা চারবার পশ্চিম বঙ্গের লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। হবেন না, তিনি যে ‘রাণীমা’ ইলা মিত্র!


ব্যক্তিজীবনে রাণীমাঃ
ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্রের নাম ছিলো ইলা সেন। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীনস্থ বাংলার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। তাঁদের আদি নিবাস ছিলো তৎকালীন যশোর জেলার (এখনকার ঝিনাইদহের) বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁরা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এখান থেকেই ১৯৪৪ সালে বি এ পাশ করেন। পরে ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ পাশ করেন। কৈশোরে কিন্তু তিনি খেলাধুলায় ছিলেন খুবই ভালো। কতো ভালো জানো? ১৯৪০ সালে জাপান অলিম্পিকের জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন! তিনিই কিন্তু অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হওয়া প্রথম বাঙালি মেয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সেই অলিম্পিকটি বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার আর অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান আর অভিনয়েও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।

ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি এ পড়ছেন, তখনই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিলো ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে সে বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনিও এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের, মানে যারা পুরোনো ধ্যান-ধারণা নিয়েই পড়ে থাকে, তাদের গোঁড়া যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নতুন ধ্যান-ধারণা প্রচার করতে শুরু করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামের এক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতেই মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে যান।

১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। বিয়ের পর বেথুনের তুখোড় ছাত্রী ইলা সেন হয়ে গেলেন রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার বাড়ির বৌ ইলা মিত্র। কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। আর এই মিত্র পরিবার আবার ছিলো রক্ষণশীল হিন্দু জমিদার। আর তাই তিনি অন্দরমহলেই থাকতেন, মানে ঘরের ভিতরেই থাকতেন। তখনও তিনি মা হননি, তাই হাতে অফুরন্ত অবসর। এই বন্দী জীবনে মুক্তির স্বাদ নিয়ে এলো গ্রামবাসীর একটি প্রস্তাব। রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ির কাছেই কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলা হলো। গ্রামের সবাই রীতিমতো দাবি জানিয়ে বসলো, তাদের নিরক্ষর মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে বৌমা ইলা মিত্রকেই। বাড়ি থেকে অনুমতিও মিললো। কিন্তু বাড়ির চার'শ গজ দূরের স্কুলে যেতে হয় গরুর গাড়ি চড়ে। এভাবেই সংগ্রামী নেত্রী অন্দর মহল থেকে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর সমাজ সেবার কাজে।


এ সময়েই তিনি স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের কাছে জমিদার ও জোতদারের হাতে বাংলার চাষীদের নিদারুণ বঞ্চনা শোষণের কাহিনী শোনেন। আরো শোনেন এই শোষণের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলনের কথা। কমিউনিস্ট রামেন্দ্র মিত্র এর আগেই জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মোহ ত্যাগ করে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। রমেন্দ্র মিত্র ইলামিত্রকে তাঁদের কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। আর এরপরের ইতিহাসই তো তোমরা এতাক্ষণ শুনলে। কিভাবে তার নেতৃত্বে ১৯৪৬ থেকে ’৫০ সাল পর্যন্ত নবাবগঞ্জের নাচোলে তেভাগা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিলো, কিভাবে তিনি পালিয়ে যেতে গিয়েও শেষ মুুহুর্তে ধরা পড়ে যান, আর তারপর কী অমানুষিক নির্যাতনই না তাঁকে করা হয়েছিলো। শেষমেশ কিন্তু পাকিস্তানি সরকার তার কাছে নতি স্বীকারই করেছিলো। তাঁর সাঁওতালদের হাতে পুলিশ হত্যার বিচারে তিনি সাঁওতালদের পক্ষেই সাক্ষ্য দেন। আর এভাবেই সাঁওতালদের রাণীমা সন্তানের মতো ভালোবাসায় রক্ষা করেন সহজ-সরল সাঁওতাল কৃষকদের।

বাংলাদেশের সাঁওতাল কৃষকের এই চিরদিনের বন্ধু ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।

লেখকঃ রাশেদ শাওন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info