পাহাড়ি সিংহের বিচিত্র জীবন


মাউণ্টেন লায়ন বা পাহাড়ি সিংহ নামটি শুনলেই বোঝা যায় এদের বাস রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে। এদেরকে কুগার বা পুমাও বলা হয়ে থাকে। চেহারা সুরতে মাউণ্টেন লায়নরা হুবহু বনবিড়ালের জাত ভাই। তবে সাড়ে আট ফুট লম্বা, একহারা গড়নের এই সিংহগুলো কিন্তু বেজায় ভীতু। তারা পারতপক্ষে মানুষের ধারে কাছে আসতে চায় না। একান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষের ওপর হামলাও চালায় না। একবার একটি কিশোর বয়সী ছেলে মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল এরকম একটি মাউণ্টেন লায়ন বা কুগারের। ছেলেটি ভেবেছিলো এবার তার আর রক্ষা নেই। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি সিংহটি ছেলেটিকে কিছু করেনি। কেনো করেনি সে রহস্য অজ্ঞাতই থেকে গেছে।


পাহাড়ি সিংহদের সর্বাধিক বাস হচ্ছে রকি মাউণ্টেন এলাকায়। তবে যখন ইউরোপিয়ানরা প্রথম এ দেশে আসে, তখন নর্থ এবং সাউথ আমেরিকাতেও প্রচুর পাহাড়ি সিংহদের বিচরণ ছিলো। এদের দেখা যেতো মরুভূমি জলা এবং জঙ্গলে। সাগর উপকূলেও ওদের বাস ছিলো। সেখান থেকে তারা পাহাড়ে উঠে আসে। ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদীরা ওদের ক্যাট মাউণ্ট, পুমা, প্যান্থার, কুগার ইত্যাদি নাম দেয়।

পাহাড়ি সিংহদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য যথেচ্ছ ভাবে ‘মাউণ্ট লায়ন’ নিধনযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। তারা যেখানে এই প্রাণীদের দেখা পেতো, সাথে সাথে হত্যা করতে দ্বিধা করতো না। বর্তমানে, আমেরিকার মাউণ্টেন লায়নদের প্রায় সবাই পূর্বাঞ্চলে চলে গেছে। ফোরিডায় কিছু প্রাণী আছে, যাদের পরিচিতি ‘ফোরিডা প্যান্থার’ বলে। এদের অস্তিত্বও এখন হুমকির মুখে। বর্তমানে টেক্সাস থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার গোটা অঞ্চলে শুধুমাত্র শিকারের সময় ছাড়া কুগার বা মাউণ্টেন লায়নদের হত্যা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। তবে জানমালের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠলে কুগারদের বিশেষ অনুমতি নিয়ে হত্যা করা চলে।


সাধারণত মাউণ্টেন লায়নরা ছয় থেকে সাড়ে আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে (লম্বা লেজসহ)। মেয়ে সিংহের ওজন ১০০ পাউন্ড, পুরুষরা সর্বাধিক ২০০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ক্যালিফোর্নিয়ায় বর্তমানে ৬ হাজারের মতো মাউণ্টেন লায়ন আছে। সংখ্যাটা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এদের দেখা পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ খুব কমই এরা জনসম্মুখে আসে। সাধারণত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদের বিচরণের সময়। তবে খুব বেশি খিদে বা তেষ্টা পেলে দিনের বেলাতেও মাউণ্টেন লায়নরা চলে আসে গোপন আশ্রয় ছেড়ে। আর এদের যখন খিদে পায়, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হরিণ শিকার করেই খায়। এদের ছোট ছোট দাঁতগুলো সাংঘাতিক ধারালো।

মাউণ্টেন লায়নরা একা ঘুরে বেড়াতেই ভালবাসে। আর এদের প্রত্যেকের নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্র আছে, যেখানে তারা ঘুরে বেড়ায়, শিকার করে। আর এই বিচরণক্ষেত্রটির পরিধি হয়ে থাকে দশ মাইল বা তারও বেশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা যখন শিকার করে তখন ঐ শিকারটি যে তাদের একান্ত নিজস্ব তা বোঝানোর জন্য শিকারের গায়ে লতাপাতার স্তুপ তৈরি করে তাতে হিসু করে দেয়।

মাউণ্টেন লায়নরা একাচোরা স্বভাবের হলেও বাচ্চা কাচ্চা সঙ্গে থাকলে কখনও একা কোথাও যায় না। বাচ্চার নিরাপত্তার খাতিরে দলবেঁধে বের হয় মা। সিংহ শাবক জন্ম নেয়ার ১০ দিন পর্যন্ত তার চোখের পাতাই সে মেলতে পারে না। পুরো একটা বছর বাচ্চাগুলো মা’র সঙ্গেই থাকে, পায়ে পায়ে ঘোরে। শেষে নিজেরাই নিজেদের শিকারের চারণভূমি খুঁজে নেয়।


মাউণ্টেন লায়নদের নিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। একবার একটি মেয়ে সিংহকে একদল গবেষণাবিদ ধরে ফেলেছিলেন সুকৌশলে। রকি মাউণ্টেন, পাহাড়ি সিংহদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্রে তারা ট্রেনিং দেয়া কুকুর নিয়ে গিয়েছিলেন। কুকুরগুলো তাড়া করে একটি পাহাড়ি সিংহকে। তাড়া খেয়ে সিংহটি উপায় না দেখে একটি গাছ বেয়ে তরতর করে উঠে যায় ওপরে, নিচে বৃত্তাকারে কুকুরের দল গর্জন করতে থাকে। এমন সময় শিকারী বেশে ওখানে হাজির হয়ে যান কয়েকটি লোক। তারা গুলি ছোঁড়েন সিংহটিকে টার্গেট করে। তবে তাদের বন্দুকে গুলির বদলে ছিলো ওষুধ মাখানো ছোট বর্শা। তীর বা বর্ষার আঘাত খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় মাউণ্টেন লায়নটি। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় শহরে। যারা ওকে ধরে এনেছিলেন, তাঁরা ছিলেন ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্ট। তারা পাহাড়ি সিংহটির ওজন মেপে গলায় একটি ‘কলার’ পরিয়ে দেন। কলারের ভেতরে ছিলো ছোট্ট একটি রেডিও ট্রান্সমিটার। এই ট্রান্সমিটারটির সাহায্যে গবেষণাবিদরা জানতে পেরেছেন মাউণ্টেন লায়নটির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে, কোথায় কী শিকার করেছে, কী খেয়েছে ইত্যাদি। মাউণ্টেন লায়নরা রকি মাউণ্টেনে মোটামুটি বহাল তবিয়তে আছে।


তবে রকি মাউণ্টেনে যারা ‘হাইকিং’ (পাহাড় চড়া) করতে যায়, তাদের জন্য বিশেষভাবে বলা আছে, সতর্কভাবে চলাফেরা করার জন্য। কারণ কিছুদিন আগেও একটি ১০ বছরের ছেলেকে মেরে ফেলেছে একটি কুগার। ছেলেটি তার বাবা-মা’কে ছেড়ে নিজেই মাতব্বরী করে আগে আগে একটি ট্রেইলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো। সম্ভবত তার অনুপ্রবেশ সহ্য করতে পারেনি মাউণ্টেন লায়নটি। ফলে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে বেচারাকে।

লেখকঃ অনীশ দাস অপু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info