আপনারা যারা বিশ্বের খবরা খবর নিয়মিত রাখেন, তাদের অনেকেই খবরটা পড়ে ফেলেছেন। লোনসাম জর্জ মারা গেছে। যারা খবরটি পড়েন নাই, তারা তো ভাবছেন কোথাকার কোন জর্জ মারা গেলো, তা নিয়ে এতো হট্টগোলের কী আছে! আসলে লোনসাম জর্জ তো মানুষই না, ও একটা কচ্ছপ। ভাবছেন, একটা কচ্ছপের নাম জর্জ দেয়া হয়েছে, সেটা না হয় মানা গেলো, কিন্তু সে নামের আগে আবার "লোনসাম" জুড়ে দেয়া হলো কেন? কারণ, লোনসাম জর্জ ছিলো পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপদের শেষ বংশধর। আর ওর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলো আরো একটি প্রজাতির কচ্ছপ।
লোনসাম জর্জের গল্প তো আমরা শুনবোই। তার আগে শুনে নেই ওর বাসার গল্প, পিন্টা দ্বীপের গল্প। এই পিন্টা দ্বীপ ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের একটা দ্বীপ। এই গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বিখ্যাত আরো একটা কারণে। চার্লস ডারউইনের নাম মনে আছে? আরে, যিনি প্রাণীদের বিবর্তনতত্ত (!) আবিষ্কার করেছিলেন। ডারউইনের সেই তত্ত (!) অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয় সাগরে। সে সব অদ্ভূত দর্শন প্রাণী থেকে ক্রমে মাছের সৃষ্টি হয়। এই মাছই আবার ডাঙায় থাকার প্রয়োজনে বিবর্তিত হয়ে সরীসৃপ হয়। ডাঙায় আসার পর সরীসৃপের আরো বিবর্তন হয়। আস্তে আস্তে স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব হয়। তারপর একসময় মানুষের উদ্ভব হয়। তো, ডারউইন জাহাজে করে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন নানা দেশে নানা দ্বীপে। সে সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন অনেক আজব আজব প্রাণী আর গাছপালা। সবকিছু বিচার বিশেষণ করে তারপর তিনি একটা বই লেখেন "দি অরিজিন অফ স্পিসিস" ১৮৫৯ সালে। এই বইটিতেই তিনি বিখ্যাত বিবর্তনতত্তের কথা লেখেন। তো এর আগে তিনি যে সব দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, তারই একটা হলো এই গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ।
বইটি প্রকাশের ঠিক ১০০ বছর পূর্তিতে, ১৯৫৯ সালে দ্বীপটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় চার্লস ডারউইন রিসার্চ স্টেশন। এই স্টেশনটি আসলে চার্লস ডারউইন ফাউন্ডেশনের হেডকোয়ার্টার। ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিসেফ আর ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়নের অধীনে। ফাউন্ডেশনটি গ্যালাপাগোস দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। এবার আসা যাক মূল গল্পে। এক সময় পিন্টা দ্বীপে অনেক কচ্ছপ ছিল। একদিন মানুষ এসে দ্বীপটিতে জনবসতি গড়লো। আর তারপর যা হয়, না জেনে না বুঝে মানুষ এমন সব কাজ করে বসলো, যার ফলে পুরো দ্বীপটির ইকোসিস্টেমে সমস্যা হয়ে গেলো। পিন্টা দ্বীপে অবশ্য মানুষ গুরুতর কিছু করেনি। শুধু মানুষের আগমনে দ্বীপটিতে "ফেরাল" ছাগলেরও আমদানি হলো। ভাবছেন, এই ফেরাল ছাগল আবার কোন জাতের ছাগল? ফেরাল আসলে ছাগলের কোন জাতের নাম না, এটা বায়োলজির একটা টার্ম। কোনো প্রাণীকে মানুষ পোষ মানানোর পর, কোনো কারণে সেটা আবারও জঙ্গলে ফিরে গিয়ে বন্য জীবন যাপন করতে শুর করলে, সেই প্রাণীকে বলে ফেরাল। মানে, জনবসতি গড়ার সময় মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো ছাগল। আর সংখ্যায় বেড়ে যাওয়ার কারণে, কিংবা পালিয়ে গিয়ে সেই ছাগলগুলোরই একটা অংশ পিন্টা দ্বীপের বনে গিয়ে থাকতে শুর করলো।
ভাবছেন, ছাগল তো একটা নিরীহ প্রাণী। ও বনে গিয়ে থাকলেই কী, আর না থাকলেই বা কী! উহু, ইকোসিস্টেম পড়েননি? প্রত্যেকটা এলাকার নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেম থাকে। কে কি খাবে, কাকে খাবে, সেই অনুযায়ী পশু পাখি, গাছপালা, সব নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকে। আমাদের সুন্দরবনের কথাই ধরেন না, সেখানে বাঘ হরিণকে খায়। আবার হরিণ গাছের পাতা খায়। এখন আপনি যদি গাছ কেটে ফেলেন, হরিণ খেতে পাবে না; ফলে হরিণের সংখ্যা কমে যাবে। আবার বাঘ হরিণ খায়, সুতরাং হরিণ কমে গেলে বাঘও খেতে পাবে না, ফলে বাঘও কমে যাবে। এভাবে প্রতিটা বনে প্রাকৃতিকভাবেই খাবারের ভারসাম্য করা থাকে। এই ব্যবস্থাটাকেই বলে ইকোসিস্টেম।
ছাগল এসে পিন্টা দ্বীপের এই ইকোসিস্টেমে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিলো। ফলে কমে যেতে শুরু করলো পিন্টা দ্বীপের অনেক প্রাণী। আর পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপ তো একরকম হারিয়েই গেলো। সবাই ধরেই নিয়েছিল, হারিয়ে গেছে পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপ। হঠাৎই একদিন আশার আলো দেখা গেল, আশার আলো দেখালেন হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানি জোসেফ ভ্যাগভোলজি। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি দ্বীপটিতে এই প্রজাতির একটি কচ্ছপ খুঁজে পান। কচ্ছপটির নাম রাখা হয় জর্জ। এই প্রজাতির একমাত্র কচ্ছপ বলে ওর নামের শুরতে জুড়ে যায় "লোনসাম"। সব মিলিয়ে ও লোনসাম জর্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ছাগল এসে পিন্টা দ্বীপের এই ইকোসিস্টেমে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিলো। ফলে কমে যেতে শুরু করলো পিন্টা দ্বীপের অনেক প্রাণী। আর পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপ তো একরকম হারিয়েই গেলো। সবাই ধরেই নিয়েছিল, হারিয়ে গেছে পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপ। হঠাৎই একদিন আশার আলো দেখা গেল, আশার আলো দেখালেন হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানি জোসেফ ভ্যাগভোলজি। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি দ্বীপটিতে এই প্রজাতির একটি কচ্ছপ খুঁজে পান। কচ্ছপটির নাম রাখা হয় জর্জ। এই প্রজাতির একমাত্র কচ্ছপ বলে ওর নামের শুরতে জুড়ে যায় "লোনসাম"। সব মিলিয়ে ও লোনসাম জর্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
জর্জকে পরে নিয়ে আসা হয় চার্লস ডারউইন রিসার্চ স্টেশনে, পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপদের সর্বশেষ বংশধরকে যেন অকালেই হারাতে না হয়, সেজন্য। তারপর শুরু হয় জর্জের জন্য সঙ্গিনী খোঁজার পালা। পিন্টা দ্বীপের একটা মেয়ে কচ্ছপ পাওয়া গেলে হয়তো বাঁচানো যাবে কচ্ছপদের এই প্রজাতিটিকে। কিন্তু ওই যে বললাম, জর্জই এই প্রজাতির সর্বশেষ কচ্ছপ! পাওয়া গেলো না ওর কোনো সঙ্গী।
এবার খোঁজা শুরু হলো, কোন প্রজাতির কচ্ছপের সঙ্গে ওদের খুব মিল আছে। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জেরই আরেকটা দ্বীপের নাম ইসাবেলা। সেই দ্বীপের কচ্ছপের সঙ্গে পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া গেল। আর তাই জর্জের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়া হলো ওই প্রজাতির কয়েকটা কচ্ছপ।
২০০৮ সালের জুলাই মাস। জর্জের এক সঙ্গিনী কচ্ছপ ১৩টা ডিম পাড়লো। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেই খাঁটি পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপ না হলেও, পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপের হাইব্রিড অন্তত পাওয়া যাবে। এখন শুধু ডিম ফোটার অপেক্ষা। নভেম্বর মাসে এল দুঃসংবাদ, ডিমগুলোর অধিকাংশই ওজন হারাচ্ছে। সম্ভবত সেই ডিমগুলো থেকে কোনো বাচ্চা হবে না। ডিসেম্বরে পাওয়া গেলো আসল দুঃসংবাদ, একটি ডিমও ফোটেনি। অর্থাৎ, সেবারে পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপের কোনো হাইব্রিড সন্তান হলো না। এরকম আরেকটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো ২০০৯ সালেও। কিন্তু এবারের ৫টা ডিমও ফুটলো না। পিন্টা দ্বীপের একমাত্র কচ্ছপই রয়ে গেলো লোনসাম জর্জ। ওর নামের মতোই ও থেকে গেলো একাকী।
২০১২ সালের ২৪ জুন। গ্যালাপাগোস দ্বীপে তখন সকাল ৮টা বাজে। গ্যালাপাগোস ন্যাশনাল পার্কের ডিরেক্টর এডউইন নাউলা ঘোষণা করলেন, "মারা গেছে লোনসাম জর্জ"। সেই সঙ্গে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলো কচ্ছপের আরো একটি প্রজাতি, পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপদের আর কোনো বংশধর রইলো না এই পৃথিবীতে। জর্জের ৪০ বছরের কিউরেটর ফস্টা লেরেনা খুঁজে পেয়েছেন মৃত জর্জকে। খুব সম্ভবত স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছিলো জর্জের। ওর বয়স হয়েছিলো প্রায় ১০০ বছর। কিন্তু ধারণা করা হয়, পিন্টা দ্বীপের কচ্ছপদের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল প্রায় ২০০ বছর। সেই হিসেবে তো জর্জ মারা গেলো যুবক থাকতেই! সে কী আর স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে?
কি, মন খারাপ করে দিলাম নাকি? খবরটা শুনে আমারও খুব মন খারাপ হয়েছে। আর তাই ঠিক করেছি, আর যাতে কোনো প্রাণী হারিয়ে না যায়, হারিয়ে না যায় কোনো গাছ কিংবা লতা গুল্ম, সেজন্যে সতর্ক থাকবো। অন্যদেরকেও সতর্ক হতে বলবো এ ব্যাপারে। কী, আছেন তো আমার সঙ্গে?
লেখকঃ নাবীল আর জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
লেখকঃ নাবীল আর জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
onek kosto pylam
উত্তরমুছুনএকটা প্রজাতি হারিয়ে গেল... :(
মুছুন