শুনতে খুব হাস্যকর মনে হলেও, পৃথিবীর প্রাচীনতম সংখ্যা ব্যবস্থা কিন্তু সত্যি সত্যিই জন্ম নিয়েছিল একজন রাখালের হাতে। নিজের ভেড়াগুলো গুনে রাখার জন্য নিজের মতো করেই গণনার একটা পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিল সে। সেখান থেকেই মানবসভ্যতার ইতিহাসে শুরু হয় সংখ্যার পথচলা।
আমাদের আজকের জীবনে হিসাব রাখা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, দশ হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরের একজন মেষ পালকের জন্যও সেটা হয়তো ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে আমাদের জন্য কাজটা যত সহজ, সে সময় কাজটা তত সহজ ছিল না। সেই নাম না জানা মেষপালককে কেউ শিখিয়ে দেওয়ার ছিল না যে, একের পাশে শূন্য বসালে সেটা দশ হয়ে যায়। তাই নিজের ভেড়াগুলো সামলে রাখতে সে নিজেই একটা নিয়ম বানিয়ে নিল। ভেড়ার পালের প্রতিটা ভেড়ার জন্য একটা করে ছোট্ট পাথর নিয়ে একটা মাটির কৌটাতে জমানো শুরু করল। ভেড়ার সংখ্যা ঠিক আছে কিনা যাচাই করে নিতে সে ঠিক উলটো কাজটি করত। প্রতিটি ভেড়ার জন্য কৌটা থেকে একটি করে পাথর বাইরে সরিয়ে রেখে সে ঠিকঠিক মিলিয়ে নিত, তার ভেড়ার সংখ্যা ঠিক আছে কিনা।
সময় বদলাল, সুমেরীয়দের চিন্তা ভাবনারও উন্নতি হতে লাগল। অনেকগুলো ভেড়ার জন্য একটা একটা করে পাথর জমানো অনেক কঠিন কাজ। এবার তারা যেটা করল- পাথরের টুকরোগুলোর উপর ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন এঁকে দিল। যেমন, দুটো ভেড়া বোঝাতে পাথরের উপর ‘+’ চিহ্ন এঁকে দিত। দশটা ভেড়া বোঝাতে ব্যবহার করত আরেকটা চিহ্ন। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন ব্যবহার করত। কোনো কোনো জায়গায় এই পাথরের টুকরো গুলো তারা কৌটায় ভরে রাখত। আবার কোনো কোনো জায়গায় সেগুলো সুতোয় গেঁথে রাখত।
কেউ যেন পাথরের টুকরো গুলো এদিক সেদিক করতে না পারে, সে জন্য তারা এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করল। যে কৌটার ভেতর পাথরগুলো রাখা হবে, সেটা আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করে নেওয়ার আগে সেগুলোর গায়ে কিছু চিহ্ন বসিয়ে নিত। ভেতরের পাথর গুলোর গায়ে যে চিহ্নগুলো থাকবে, কৌটার গায়েও তারা সেই সব চিহ্নের ছাপ বসিয়ে নিত। এরপর কৌটার ভেতরে পাথরগুলো রেখে সেটার মুখ বন্ধ করে, কাঁচামাটির কৌটাটিকে পুড়িয়ে নেওয়া হত।
পরে দেখা গেল, কৌটা আর তেমন খোলার দরকার নেই। কৌটার গায়ে বসানো চিহ্ন গুলো দিয়েই বেশ কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। কৌটার গায়ে বসানো ওই চিহ্ন গুলোই হয়ে থাকল পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংখ্যা।
স্থায়ী গণনার জন্য যেহেতু মাটির উপর বসানো চিহ্নই যথেষ্ট, ধীরে ধীরে পাথর কৌটার প্রথাও উঠে যেতে লাগল। বরং মাটির বড় বড় টুকরোয় দাগ দিয়ে দিয়ে গণনার কাজ করা হতে লাগল। তারপর সেটা আগুনে পুড়িয়ে স্থায়ী করে নেওয়া হত। এখান থেকেই মেসোপটেমিয়ার বিখ্যার ক্লে ট্যাবলেট গুলোর যাত্রা শুরু। সেখান থেকেই পাওয়া যায় পৃথিবীর প্রথম স্থানীয় মান ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা আর ব্যবিলনের ষাট ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা।
তবে এগুলো কিন্তু হুট করে একদিনে হয়নি। পাথর কৌটা ব্যবহারের ধারণা খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দের। বদলে মাটির ট্যাবলেটে (clay tablet) টালিচিহ্ন দিয়ে গুনে রাখার প্রচলন হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০-২০০০ অব্দের দিকের।
প্রায় ৬০০০ বছর ধরে সুমেরের লোকজন এই পদ্ধতিতে গণনা করার কাজ করেছে। অথচ আমাদের আধুনিক সংখ্যা ব্যবস্থাটি কিন্তু এখনও ২০০০ বছরেও পা দেয়নি!
লেখকঃ অভিক রায়।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।