হারাতে বসা পাখিগুলো ।। Almost Extinct Birds

একসময় মানুষের ঘুম ভাঙতো পাখির ডাক শুনে। আহা! কি মধুরই না ছিল সেই সব দিনগুলো। পাখির কলকাকলি শুনে ঘুম ভাঙলে মনটাই তো ভালো হয়ে যায়। অথচ আজকাল পাখিদের দেখা পাওয়াই মুশকিল। গ্রামে যদিও বা কিছু পাখি দেখতে পাওয়া যায়, ঢাকা শহরে তো এক কাক ছাড়া অন্য কোনো পাখি খুঁজে পাওয়াই ভার। এর মানে বুঝতে পারছো তোমরা? পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে দিন দিন পাখিরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী আমরাই, অর্থাৎ মানুষেরা। মানুষ পরিবেশ দূষণ করছে, বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে দিচ্ছে, আর বেচারা পাখিরা বাসা-বাড়ি হারাচ্ছে। আর নির্বিচারে পাখি শিকার তো আজো চলছে। এসব কারণেই পাখিরা দিন দিন সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু পাখি তো পৃথিবী থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর বিলুপ্তির পথে আছে অনেকগুলোই। এসব বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাখিদের মধ্যে অনেকগুলোর আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা পাখি অবশিষ্ট আছে। আচ্ছা, আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই এরকম বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি প্রজাতির পাখির সাথে।


স্পিক্স’স ম্যাকাওঃ
ম্যাকাও মানে যে টিয়া পাখি, এটা তো আপনার নিশ্চয়ই জানো, তাইনা? এই স্পিক্স’স ম্যাকাও-ও এক ধরনের টিয়ে। আর এদের স্পিক্স নামটা দেয়া হয়েছে এক জার্মান পরিবেশবিদের নামে; তার নাম ছিলো জোহান ব্যাপ্টিস্ট ভন স্পিক্স। তিনিই প্রথম এই পাখিটি আবিষ্কার করেছিলেন কিনা! হালকা নীল রঙের এই পাখীটি স্পিক্স সাহেব ব্রাজিলে খুজে পেয়েছিলেন সেই ১৮১৭ সালে। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে। কিন্তু ২০০০ সালের মধ্যেই এই পাখির সংখ্যা এতোটাই কমে গেলো যে এদের এখন আর দেখাই যায় না। আর এদের বিলুপ্তির প্রধান কারণটা কি জানো? বলছি দাড়ান, এই টিয়ে কিন্তু আবার যে সে গাছে থাকে না, ‘সারাইবেরা’ নামের এক ধরনের গাছ আছে, শুধু ওই গাছেই থাকে। অভিজাত পাখি কিনা! কিন্তু গোল বেধেছে, মানুষ এই সারাইবেরা গাছটা এতো এতো কাটতে লাগলো, যে ওরা আর থাকার জন্য সারাইবেরা গাছই খুঁজে পাচ্ছে না। আপনার যদি থাকার জায়গা-ই দেয়া না হয়, আপনি বাঁচবেন কি করে বলেন তো দেখি? সেই সাথে মানুষের শিকারও হচ্ছে এরা। বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও প্রায় ৮৫টি স্পিক্স’স ম্যাকাও আছে। আর তারাও এদেরকে খুব যত্ন করে সংরক্ষণ করছে যাতে এরা হারিয়ে না যায়।


সেবু ফ্লাওয়ারপ্যাকারঃ
সেবু ফ্লাওয়ারপ্যাকার পাখীটি একমাত্র ফিলিপাইনের সেবু দ্বীপেই পাওয়া যায়। সুন্দর এই পাখীটির নামের সাথেই ‘সেবু’ দ্বীপের নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে! হরেক রঙের এই সেবু ফ্লাওয়ারপ্যাকার দেখলে তুমি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। এর মাথাসহ শরীরের উপরের অংশটুকু কালো রঙের, পিঠে আর বুকের মাঝখানের কিছুটা অংশ লাল, পিঠের লাল রঙের পর থেকে একটা সবুজ রেখা আবার চলে গিয়েছে একেবারে লেজ পর্যন্ত। এদের লেজ আর পাখা কালচে নীল রঙের আর শরীরের নিচের অংশটুকু ধূসর অথবা সাদা রঙের হয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে, মানে গত শতকের গোড়ার দিকের কথা। তখন আর এই সুন্দর ফ্লাওয়ারপ্যাকারদের দেখাই পাওয়া যেতো না। সবাই তো ধরেই নিয়েছিলো, সুন্দর এই পাখিটিকে আর দেখা যাবে না। হঠাৎ করেই ১৯৯২ সালে সেবু ফ্লাওয়ারপ্যাকার আবার খুঁজে পাওয়া গেলো। ওই সেবু দ্বীপেরই তাবুনান নামের এক জায়গায়। সর্বশেষ ২০০৭ সালেও এই পাখি দেখা গিয়েছিলো। ২০০৫ সালের এক হিসাবে তখন সেবু ফ্লাওয়ারপ্যাকারদের সংখ্যা ছিল ৯০ কি ১০০টা। কিন্তু মানুষের উৎপাতের কারণে এই পাখি এখনও হুমকির সম্মুখীন।


হাওয়াইয়ান ক্রোঃ
হাওয়াইয়ান ক্রো আসলে যে কী, সে তো বুঝতেই পারছেন, এক ধরণের কাক। তবে নাম শুনে আবার ভেবে বসেন না যে, হাওয়া-বাতাসের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে! আসলে হয়েছে কি, এই বিশেষ জাতের কাক আবার একমাত্র হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জেই থাকে। অন্য কোথাও এরা থাকতেই চায় না। তাই ওদের নামের সাথে ‘হাওয়াই’ দ্বীপের নামও সেঁটে দেয়া হয়েছে। তবে এই হাওয়াইন ক্রো-এর কিন্তু আরেকটা নামও আছে- ‘আলালা’। কেমন অদ্ভুত নাম, তাইনা? এই নামের কিন্তু একটা মজার গল্পও আছে। ওদের এই অদ্ভূত নাম দিয়েছে হাওয়াইয়ের প্রাচীন অধিবাসীরা। ওরা মনে করতো, আলালা, মানে এই হাওয়াইয়ান কাক আসলে ওদের পারিবারিক দেবতা।

অন্যান্য কাকের মতই হাওয়াইয়ান ক্রো-এর রঙ-ও কালো। আর লম্বায় প্রায় ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। দুঃখের কথা কি জানেন? ২০০২ সালেই এই পাখি পৃথিবীর বন-জঙ্গল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করে। কী একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে এক-এক করে সব হাওয়াইন ক্রো মারা যেতে থাকে। তাই ২০০৫ সালে অনেক টাকা খরচ করে হাওয়াইয়ান এই কাকেদের বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। লাভ খুব একটা হয়েছে বলা যাবে না। এখন পৃথিবীতে প্রায় ৭৮টি ‘আলালা’ সংরক্ষিত অবস্থায় বেঁচে আছে।


ব্ল্যাক স্টিল্টঃ
আপনারা কখনও ‘রণ-পা’ দেখেছো। অনেকেই হয়তো দেখেছেন, কিন্তু এই খটোমটো নাম শুনে আর চিনতে পারছো না। ঐ যে, পায়ে লম্বা বাঁশের নকল পা লাগিয়ে সেই লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যায় না? ওই লম্বা লম্বা নকল পাকেই বলে রণ-পা। ব্ল্যাক স্টিল্ট পাখির লম্বা লম্বা পা দেখলে প্রথমেই আপনার এই রণ-পা-র কথাই মনে পড়বে। আর তাই ওর নামই দেয়া হয়েছে কালো রণ-পা। কেন, জানো না, স্টিল্ট মানে যে রণ-পা? এদের আরো একটা নাম আছে, সেই নামটা আবার বেশ মজার - ‘কাকি’!

এই পাখীটি আবার শুধু নিউজিল্যান্ডেই বাস করে। সেখানেও খুব বেশি নেই। বলা হয়, পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছে এই লম্বা-ঠ্যাঙে ব্ল্যাক স্টিল্ট। প্রায় ২০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এদের সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। তারপরও এদেরকে খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পানি দূষণ। ওরা আবার থাকে নদীর কাছাকাছি পলিমাটিতে। আর নদীর পানি দূষিত হলে ওরা সেখানে থাকবে কি করে, বলেন? এছাড়া কুকুর, বিড়াল আর অন্যান্য শিকারি প্রাণীদের আক্রমণেও ওরা প্রচুর মারা যায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৫টি ব্ল্যাক স্টিল্ট পাখিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।


কাকাপোঃ
কাকাপো নামের এই পাখীটি আবার দেখতে বেশ অদ্ভুত। বলতে পারো, এটা হলো গিয়ে পেঁচা আর টিয়াপাখির মিশ্রণ। পাখীটির সারা গায়ে টিয়াপাখির মত রঙবেরঙের পালক আছে ঠিকই, কিন্তু আকার-আকৃতিতে আর স্বভাব-চরিত্রে এটি একদম পেঁচার মত। নিশাচর এই পাখীটি কেবল নিউজিল্যান্ডেই দেখা যায়। কাকাপোর গায়ের পালকে রয়েছে হলুদ আর সবুজ রঙের ফুলঝুরি। বড়ো সড়ো ধূসর ঠোট, ছোট ছোট পা অথচ সেই তুলনায় বড়ো বড়ো পায়ের পাতা, ছোট্টো পাখা আর ছোট্টো একটা লেজ মিলিয়ে পাখিটিকে দেখতেও খুব আজব লাগে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো? কাকাপো-ই পৃথিবীর একমাত্র প্রজাতির টিয়াপাখি যেটি কিনা উড়তেই পারে না! তবে কাকাপো কিন্তু খুব দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠতে পারে, একদম বানরের মতো! আর আরো মজার কথা হচ্ছে, নামার সময় এরা আবার প্যারাশ্যুটের মতো ভাসতে ভাসতে নিচে নামতে পারে।


দ্য মরিশাস/ ইকো প্যারাকিটঃ
টিয়া পাখি চেনেন না, আপনাদের মধ্যে এমন বেরসিক কেউ নিশ্চয়ই নেই, তাইনা? এই মরিশাস বা ইকো প্যারাকিটও এক ধরনের টিয়া পাখি। তবে টিয়াপাখিদের যেরকম অনেক লম্বা একটা লেজ থাকে এদের লেজটা মোটেও সেরকম নয়। এদের লেজ লম্বায় অনেক ছোট হয়। স্থানীয়ভাবে এই পাখিকে ‘ক্যাটওভার’ নামেও ডাকা হয়। ১৯৮০ সালের দিকেই মরিশাস পাখি হুমকির মুখে পড়ে। কারণ, মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে এদের সব বাসস্থান ধ্বংস করে ফেলেছিলো। হয়তো এরা সত্যি সত্যিই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতো। কিন্তু পরে এদের সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপও নেয়া হয় এবং সেই পদক্ষেপও নেয় মানুষেরাই। ১৯৯০ সালের দিকে এদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো মাত্র ৫০-৬০টিতে। তবে এখন এদের সংখ্যা বেড়েছে। শুধু পশ্চিম মরিশাসের জঙ্গলেই ইকো প্যারাকিট আছে প্রায় ২৮০-৩০০টি।


পিংক পিজিয়নঃ
কবুতর তো আপনাদের খুবই পছন্দের একটা পাখি, তাই না? আপনাদের মতো কবুতর আমারও খুব পছন্দের পাখি। এমনিতেই কবুতর কত্তো সুন্দর, তার উপর যদি সেটা হয় গোলাপি রঙের, তাহলে তো রীতিমত মুগ্ধ হতে হয়। এদের মাথা, কাঁধ আর শরীরের নিচের অংশ গোলাপি পালকে ঢাকা থাকে। ঠোঁটটাও হয় গোলাপি রঙের। অবশ্য পিংক পিজিয়নের পাখা আর লেজ লালচে-বাদামী রঙের হয়। অসাধারণ সুন্দর এ পাখীটিও দিন দিন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাসস্থান ধ্বংসের কারণে আর শিকারি প্রাণীদের হাতে মারা পড়ে পড়ে এই পাখি ’৯০-র দশকে অনেক কমে গিয়েছিলো। পরে বিজ্ঞানীরা টের পেয়ে ওদের সংরক্ষণ করতে শুরু করেন। পাখিশুমারি অনুযায়ী, ২০০৫ সাল নাগাদ বন-জঙ্গলে পিংক পিজিয়ন ছিলো মাত্র ৩৬০টি।


মরিশাস কেস্ট্রেলঃ
আচ্ছা, মরিশাস দেশটা কোথায় তা কি আপনারা জানেন? মরিশাস হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপ দেশ। মরিশাস কেস্ট্রেল পাখী শুধু মরিশাসের জঙ্গলেই পাওয়া যায় তো, তাই এর নামের সঙ্গে দেশটির নামও জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই দেশে আরো একটি পাখি পাওয়া যেতো, ওরা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওই পাখির নাম ছিলো ডোডো। আপনারা যারা ডোডো পাখির গল্প শোনোনি, তাদেরকে আরেকদিন ডোডো পাখির গল্পও শোনাবো। আজকে কেস্ট্রেল পাখির গল্প শোনো।

মরিশাস কেস্ট্রেল পাখীটি আসলে এক ধরণের ঈগল। তবে এরা সাধারণ ঈগলের চেয়ে অনেক ছোট আকারের হয়। ছোট বলতে কিন্তু আবার একদম ছোট্টোটিও নয়। এদের লম্বা একটা লেজ আর প্রায় দেড় ফুটি ডানাও আছে। ডোডো পাখির মতো এই দুর্লভ পাখীটিও দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দায়ী কারা? আর কারা, মানুষেরা! সেই ১৯৯৪ সালেই পাখিটিকে বিলুপ্তপ্রায় বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। এখন বেঁচে আছে প্রায় ৮০০টি মরিশাস কেস্ট্রেল।

পাখিরা প্রকৃতির এক অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি। পাখিদের উপস্থিতি আমাদের চারপাশের প্রকৃতি আর পরিবেশকে অনেক সুন্দর করে তোলে। কিন্তু দিন দিন যেভাবে পাখিদের সংখ্যা কমছে তাতে দেখা যাবে যে একদিন পৃথিবীতে আর কোন পাখিই নেই। সেটা কি কারো ভালো লাগবে বলেন? সেই সাথে পরিবেশের উপরও খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। তাই প্রত্যেকের উচিত পাখি সংরক্ষণে অনেক সচেতন হওয়া।

লেখকঃ মেহেদী বাবু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info