আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা

এখন তো অনেক গরম পড়েছে। প্রচণ্ড গরমে আপনারা সবাই ঘেমে নেয়ে একেবারে গোসল করে ফেলেছেন। আর রোদের মাঝে একটু হাঁটতেই একেবারে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন, তাই না? কেন এমন হচ্ছে জানেন? কেন আবার! চলে এসেছে খররৌদ্র আর ভীষণ গরমের বৈশাখ মাস! মানে চলে এসেছে নতুন আরেকটা বছরই। তো এইবার কি করা যায়, বৈশাখ কে তো বরণ করে নিতেই হবে, হাজার হোক, বাংলা বছরের প্রথম মাস বলে কথা! চলেন আমরা ঘুরে আসি এমন কোন জায়গা থেকে যেখানে 'পহেলা বৈশাখ' কে বরণ করার প্রস্তুতি চলছে। কোথায় যাওয়া যায়, বলেন তো?

হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের চারুকলা অনুষদে। ওখানেই তো সব প্রস্তুতি হচ্ছে। ২৫শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে সেই প্রস্তুতি। চলবে বৈশাখের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। আর আমাদের নিজেদের নববর্ষের উৎসব এটা, যেমন তেমন হলে তো আর চলবে না! খুব ধুমধাম করে আর খুব ঘটা করেই পালন করতে হবে, তাই না?

আচ্ছা, সবাই মিলে আপনারা কখনো কোনো কাজ করেছেন? যারা করেছেন, তারাই কেবল জানেন, সবাই মিলে কাজ করার কতো মজা। কোনো অনুষ্ঠান যখন সবাই মিলে পালন করা হয়, তখন যে কত্তো মজা হয়! তাই পহেলা বৈশাখও আমরা সবাই মিলেই বরণ করে নেই।


hybridknowledge.info hybridknowledge.info

এমনই চিন্তা থেকে ১৯৮৯ সালে আর্ট কলেজের শিক্ষক আর ছাত্র ছাত্রীরা মিলে পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে একটা র‌্যালি বের করার চিন্তা করেন। ভাবছেন, এই আর্ট কলেজ আবার কোনটা? আসলে আমাদের সবার প্রিয় শাহবাগের চারুকলা। এটা তো আগে আর্ট কলেজই ছিলো। এই কিছুদিন আগে এটা চারুকলা ইন্সটিটিউট হয়েছে। আর এখন তো এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষদই। যেমন, বিজ্ঞানের একটা অনুষদ আছে, আবার ব্যবসায় শিক্ষার একটা অনুষদ আছে, সেরকম চারুকলা অনুষদ। ওরা সেই র‌্যালির জন্য বানালো হরেক রকমের মুখোশ, বড়ো বড়ো আকারের নানান পশু পাখির পুতুল, আরো কতো কী! আর এভাবেই শুরু হলো মঙ্গল শোভাযাত্রার।


তখনো কিন্তু সেই র‌্যালির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। তাহলে কখন এই র‌্যালিটার এই সুন্দর মিষ্টি নাম দেয়া হলো? তার পরের বছর, ১৯৯০ সালে। ১৯৮৯ সালে আমাদের দেশের রাজনীতিতে খুব টালমাটাল একটা বছর গেলো। এরশাদের সৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এরশাদ দেশের সেনানায়ক ছিলেন, মানে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। আর সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে তিনি দেশের পুরো ক্ষমতাই নিয়ে নিয়েছিলেন। আর এরশাদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন তিনি অত্যাচার আর দমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন সবাই ভাবলো, বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠানও হয়ে উঠুক একটা প্রতিবাদ। আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক এই উৎসব হয়ে উঠলো আমাদের প্রতিবাদের হাতিয়ার। বছরের প্রথম দিনে সবাই অমঙ্গলকে দেশ থেকে দূর করার জন্য, অশুভ আর অশুচিকে প্রতিহত করার জন্য একাট্টা হয়ে নতুন দিনের নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধলো। সবার মিলিত এই শোভাযাত্রার বা র‌্যালির নাম দেয়া হলো 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'।


মঙ্গল শোভাযাত্রায় কিন্তু অনেক পুতুল, ফেস্টুন আর মুখোশ ব্যবহার করা হয়। আর এই পুতুল, ফেস্টুন আর মুখোশগুলো কিন্তু এমনি এমনি তৈরি করা হয় না। এগুলোরও কিন্তু অর্থ আছে। এগুলো আমাদের গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতিকেও তুলে ধরে। তুলে ধরে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে। আমাদের পটচিত্র, আমাদের গ্রামীণ জীবন, আমাদের লোকজ সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপকরণকেই পুতুল, ফেস্টুন আর মুখোশের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। যেমন ধরেন, এবারে নাকি মঙ্গল শোভাযাত্রার সবচেয়ে বড়ো পুতুল বানানো হবে কুমিরের। ভাবছেন, কুমির আবার আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হলো কিভাবে? আগে কিন্তু আমাদের দেশের নদীতে নদীতে থাকতো কুমির। মিঠা পানির কুমির আর ঘড়িয়ালে ভর্তি ছিলো আমাদের নদীগুলো। কিন্তু এখন ওরা হারিয়েই যেতে বসেছে। শুধু তাই না, ওরা কিন্তু আমাদের লোকজ সাহিত্যেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যদি কখনো আপনাদের পটচিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়, সেখানে দেখবে কুমিরের ছবি আছেই। অনেকে হয়তো ভাবছো, এই পটচিত্রটা আবার কি জিনিস? আগে শিল্পীরা বিভিন্ন গল্পকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো ছবি আঁকতো। সেই ছবিগুলো দিয়ে তারা মানুষকে নানা গল্প বলতো। এই যেমন ধরো কালিঘাটের পটচিত্র।


এই মুখোশ আর পুতুলগুলো কিন্তু মাঝে মাঝে আবার প্রতিবাদের হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। যেমন একবার বানানো হলো অনেকগুলো ঝাঁটা। আর সেই ঝাঁটাগুলো হাতে নিয়ে পহেলা বৈশাখের সকালে আর্ট কলেজ থেকে বের করা হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা।


তো, মঙ্গল শোভাযাত্রার গল্প তো অনেকই শুনলেন। এবার কি ঠিক করলে? যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায়? তাহলে কিন্তু অনেক সকালে উঠতে হবে। আর সেজেগুজে তোমাকে সকাল ৭টার আগে চলে যেতে হবে চারুকলাতে। নয়তো তোমাকে ছাড়াই মঙ্গল শোভাযাত্রা বেরিয়ে পরবে, আর ঘুরে আসবে ঢাকা শহরের নানা রাস্তা। তবে শেষমেশ আবার ফিরে আসবে ঐ চারুকলাতেই। কারণ, চারুকলাই তো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্মস্থান।

লেখকঃ ঋতি।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।