ডানা নেই তবু ডানাহীন ওড়া ।। Wingless Flying

প্রাণী জগতে যারা উড়তে পারে তাদের বলা হয় পাখি। পাখিদের ডানা আছে। সেই ডানা বাতাসে মেলে তারা উড়ে বেড়ায় আকাশে। তবে ব্যাতিক্রমও আছে। ডানা থাকার পরও এমন অনেক পাখি আছে যারা উড়তে পারে না। আমরা একেবারে সোজা হিসেবে জানি যে যেইসব প্রাণীর ডানা নেই, যারা পাখি নয়, তারা উড়তে পারে না। তবে পাখিদের যেমন ব্যাতিক্রম আছে মানে ডানা থাকার পরও যেমন অনেক পাখি উড়তে পারে না। তেমনি ব্যাতিক্রম আছে প্রাণীদের ক্ষেত্রেও। মানে ডানা নেই, পাখি নয় এমন অনেক প্রাণী আছে; যারা ডানা ছাড়াই পাখির মতো উড়ে বেড়াতে পারে। বাতাসে ভেসে পাড়ি দিতে পারে বহু দূরের পথও। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্য। প্রাণীজগতে এমন অনেক প্রাণীই আছে যারা ডানা ছাড়াই উড়তে পারে প্রায় পাখিদেরই মতো!

এসব প্রাণীদের বলা হয়ে থাকে ‘উড়ুক্কু’। পৃথিবী জুড়ে এমন প্রাণীর সংখ্যা প্রচুর। উড়ুক্কু প্রাণীরা জন্মগতভাবে ডানাহীন হলেও এমন কিছু দৈহিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যার মাধ্যমে তারা বেশ সাবলীল ভাবেই উড়ে বেড়াতে পারে। এসব প্রাণীদের একেক জনের উড়ে বেড়াবার কৌশল আবার একেক রকমের। নিজেদের প্রয়োজনে এরা নিজেদের মতো করেই ওড়ার কৌশল তৈরী করে নিয়েছে। এসব কৌশল করে তারা উড়ে বেড়ায়। তবে এসব প্রাণীদের ওড়াকে ঠিক ওড়া বলা যায়! যায় না। কারণ উড়ুক্কু প্রাণীরা নিজেদের কৌশলের মাধ্যমে লম্ফ ঝম্ফ মানে লাফ ঝাঁপ দিয়ে স্বল্প সীমার কোন দূরত্ব ওড়ার মতো করে পাড়ি দেয়। বাতাসে ভেসে এই পাড়ি দেয়াটাকেই ওড়া বলে মনে হয়। উড়ুক্কু প্রাণীরা বনে জঙ্গলে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাবার জন্য কিংবা দুই গাছের মধ্যকার দূরত্ব পাড়ি দেয়ার জন্যই এই ওড়ার কৌশল ব্যবহার করে। উড়ুক্কু প্রাণীদের এই বাতাসে ভেসে থাকার কৌশলগুলো বেশ মজার। এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীজুড়ে বসবাসকারী অসংখ্য উড়ুক্কু প্রাণীর মধ্যে কয়েকটির খোঁজ খবর।

উড়ু সাপঃ
সাপ হচ্ছে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। বুকে ভর দিয়ে চলা ফেরা করে সাপ। সেই সাপকে যদি দেখা যায় বাতাসে ভেসে বেড়াতে তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? যেমনই দাঁড়াক, পৃথিবীতে এমন প্রজাতির সাপ আছে যারা বাতাসে ভেসে পথ পাড়ি দিতে পারে। আর এমন কিন্তু সাপ আমাদের দেশেও দেখতে পাওয়া যায়। এই সাপদের বলা হয়ে থাকে- উড়ুক্কু সাপ।


এই উড়ুক্কু সাপ বিশেষ এক কৌশল অবলম্বন করে বাতাসে ভেসে থাকার জন্য। শিকার ধরার জন্য অথবা এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাবার জন্যই প্রধানত এসব উড়ুক্কু সাপ বাতাসে ভেসে বেড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে। তাদের শারীরিক গঠনও একটু আলাদা ধরনের। একটু ব্যাতিক্রমী! আর তা ব্যবহার করে এসব সাপেরা নিজের শরীরটাকে প্রথমে একেবারে কুঁচকে ফেলে তারপর লেজের শেষ মাথা দিয়ে বিশেষভাবে অনেক জোরে মাটিতে ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কায় যে গতি উৎপন্ন হয় তা ব্যবহার করেই এরা মাথাটাকে শূণ্যের দিকে দিয়ে শরীরের ভর টেনে নেয় সামনের দিকে। একটু কঠিন মনে হচ্ছে তাই না! ওদের কিন্তু কঠিন লাগে না! তো, এই সামনের টান আর পেছনের ধাক্কায় এরা বাতাসে ভেসে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। গায়ের ওজন হালকা হওয়ায় এরা বেশ অনেক দূর পর্যন্তই ভেসে যেতে পারে। আর শারীরিক গঠন বিশেষ রকমের হওয়ায় ভাসমান অবস্থাতেও নিজের ওপর সে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। এর কারণে ভাসতে ভাসতে গিয়ে সে যেখানে নামতে চায় সেখানেই নামতে পারে। এভাবেই ভেসে ভেসে উড়ুক্কু সাপেরা দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জের মানুষরা চোখের সামনে দেখা হঠাৎ উড়ে যাওয়া এই উড়ুক্কু সাপদের রহস্যময় অশুভ বিষয়ও মনে করে! কিন্তু আসলে তো এরা সাপই, তবে উড়ুক্কু এই যা বিশেষত্ব!

উড়ে যায় গিরগিটিঃ
উড়ুক্কু প্রাণীদের মধ্যে কিন্তু গিরগিটি অন্যতম। গিরগিটিকে কেউ কেউ আবার লুপ্ত সেইসব ডাইনোসরদেরই কাছের আত্মীয় স্বজন মনে করে। এদের চামড়া মোটা, ঠিক যাকে বলে গন্ডারের চামড়ার মতো! তো এই মোটা চামড়া আর ভাবলেশহীন ভাবভঙ্গি দেখেই সম্ভবত এদেরকে খানিকটা ডাইনোসরের মতো মনে হতে পারে। এদের বাতাসে ভেসে যাওয়া দেখে অবশ্য সিনেমায় দেখা ডাইনোসরদের ওড়াওড়ির কথাই মনে হয়। কিন্তু মনে হলেও তা একেবারে ভুল ধারণা। এরা কোনো ডাইনোসরের প্রজাতি নয়।


গিরগিটি আছে নানান প্রজাতির। তার মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি আবার কৌশল করে ভেসে মানে উড়ে বেড়াতে পারে। যে সব গিরগিটি ভেসে ভেসে উড়ে বেড়াতে পারে তারা দৈহিক ভাবে কিছু বিশেষত্বের অধিকারী। যে সব গিরগিটিরা বাতাসে ভেসে বেড়ায় তাদের শরীরের দুই পাশে থাকে একটু বাড়তি চামড়া। এই চামড়া অনেকটা পাখির ডানার মতো কাজে দেয়। এই চামড়া আবার উড়ুক্কু গিরগিটিরা ভাঁজ করে লুকিয়ে রাখতে পারে তাদেও শরীরের দুইপাশে। বোঝেন কাণ্ড! তো শুধুমাত্র যখন বাতাসে ভেসে বেড়ানোর প্রয়োজন হয় তখনই এই অংশটুকু বের করে এরা আকাশে ভাসে!

উড়ুক্কু গিরগিটিরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়ার জন্যই আসলে বাতাসে ভেসে থাকার এই সক্ষমতা ব্যবহার করে। কোনো গাছের ওপরের দিকের ডাল থেকে এই গিরগিটিরা প্রথমে লাফ দেয় শূণ্যে। তারপর তার শরীরের দুপাশে ভাঁজ করে রাখা চামড়া মেলে দেয় দুপাশে, পাখির মতো। তারপর বাতাসের গতি এবং শরীরের ভর মানে ওজনকে কাজে লাগিয়ে সে ঘুরে উড়ে বেড়ায় এদিক সেদিক।

এমনভাবে বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে এই গিরগিটিরা প্রায় বারোশো মিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। তারপর ডানার মতো চামড়া নাড়িযে-চাড়িয়ে নেমে যেতে পারে ইচ্ছেমতো জায়গায়।

উড়তে পারে ব্যাঙওঃ
পেছনের দুই পায়ে ভর করে বেঢপ শরীর নিয়ে বসে গোল গোল বড় দুটি চোখ মেলে ব্যাঙ যখন তাকিয়ে থাকে আর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে ডাকে, তখনই যেন শরীরটা কেমন করে ওঠে। সেই ব্যাঙ যদি আবার সুপারম্যানের মতো বাতাসে ভেসে বেড়ায় তবে তাকে দেখতে কেমন লাগবে?


যেমনই লাগুক, এমন ব্যাঙ কিন্তু আসলেই আছে এই পৃথিবীতে। ব্যাঙ আছে নানা প্রজাতির। তার মধ্যে একটা প্রজাতি হচ্ছে ‘গেছো ব্যাঙ’, গাছে গাছেই থাকে আরকি! এই গেছো ব্যাঙেরা আসলে থাকে ঝোপে ঝাড়ে, বনে বাদাড়ে, গাছে গাছে। এরা কিছু বিশেষ ধরনের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। অন্যান্য ব্যাঙের চাইতে দেখতে এরা অবশ্য একটু কমই বেঢপ আকৃতির হয়। এদের হাত পা একটু বেশীই লম্বা লম্বা ধরনের আর সেই লম্বা লম্বা হাত পায়ের সাহায্যে সে ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ে শূণ্যে।

বাতাসে ভেসে সে এভাবে পাড়ি দিতে পারে অনেকটা পথ। তারপর আবার যেখানে খুশি সেখানে নেমে আসতে পারে নির্বিঘ্নে। আর এর জন্য তার পায়ের নিচে থাকে বিশেষ গ্রন্থি। যার মাধ্যমে সে অনেকটা টিকটিকির মতো যে কোন জায়গা বেয়ে নেমে উঠে যেতে পারে। পারে আকাশ থেকে নেমে আসার সময় গাছের গায়ে লেপ্টে যেতেও।

লেমুরের ওড়াওড়িঃ
যেসব প্রাণী ভেসে ভেসে পথ পাড়ি দিতে পারে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লেমুর। লেমুর আসলে বানর প্রজাতির প্রাণী। তবে এর দৈহিক গঠনের কারণেই তাকে দেখায় বানর থেকে পুরোপুরিই আলাদা। লেমুরের হাত পা চারটা আর লেজ একটা। তবে ব্যাতিক্রমটা হচ্ছে তার কানের নিচ থেকে ছড়িয়ে দু’ হাতের কব্জি আর দুই পায়ের গোড়ালি হয়ে লেজের আগা পর্যন্ত একটু বিশাল চামড়া জোড়া দেয়া আছে। আর এর কারণেই সে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে অনেকটা পাখির মতোই।


লেমুর থাকে গাছে গাছে। উচুঁ উচুঁ গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে নিজের হাত পা লেজ সব ছড়িয়ে দেয়। আর তখন যে চামড়াটা দিয়ে এসব যুক্ত থাকে সেই চামড়াটা যায় ছড়িয়ে । লেমুর তখন হয়ে যায় একটা লোমঅলা ঘুড়ির মতো। কি হাসছেন তাই না! লোমওলা ঘুড়ি শুনে। যদি কখনো লেমুরকে উড়তে দেখো! একবার মিলিয়ে নিও তো! বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে ঘুড়ির মতোই সে শরীরটা শূণ্যে ভাসিয়ে উড়ে বেড়াতে পারে বেশ কিছুটা পথ। তারপর আবার নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি সেখানে হাত পা গুটিয়ে নেমে পড়ে ধীরে।


উড়তে পারে পেঙ্গুইনওঃ
পেঙ্গুইনরা দেখতে অনেকটা পাখির মতো হলেও কিন্তু এরা পাখি নয়। ভূড়িদার ভারি শরীরের পেঙ্গুইনের ডানা তার দেহের তুলনায় আকারে অনেক ছোট। তো আমরা ভাবতাম এই ছোট ডানায় অতবড় শরীরটাকে শূণ্যে ভাসানো প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। কিন্তু সম্প্রতি একটি ঘটনার পর সবার এ ধারনা অনেকটা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদ সংস্থা বিবিসি’র একজন ক্যামেরাম্যান কিং জর্জ আইল্যান্ডের ওপর একটি তথ্যচিত্র বানানোর সময় হঠাৎ তার ক্যামেরায় দেখেন, এক ঝাঁক পেঙ্গুইন তাদের ডানা মেলে উড়ে চলেছে আকাশ দিয়ে! গবেষকরা ধারনা করছেন এইসব পেঙ্গুইনরা এভাবে উড়ে অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগর থেকে উড়োপথে পাড়ি দিয়ে যায় আমাজনের রেইনফরেস্টে। অবিশ্বাস্য হলেও এ ঘটনা সত্য। একবার ভেবে দেখেন তো বিশাল সেই থলথলে শরীরটা নিয়ে অমন ছোট্ট দুটি ডানা মেলে আকাশ জুড়ে উড়ছে শাদা কালো সব পেঙ্গুইন! শুধু তাই নয় তারা পাড়ি দিচ্ছে হাজার হাজার মাইল। অবিশ্বাস্য এ ঘটনা কি করে সম্ভব তা নিয়ে এখন চলছে জোর গবেষণা!


দূরন্ত উড়ন্ত কাঠবেড়ালীঃ
সুকুমার রায়ের সেই আবোল তাবোলের ‘ছিলো রুমাল হয়ে গেলো একটা বেড়াল’ নয় কিন্তু। কাঠবেড়ালী বিড়াল প্রজাতির প্রাণী হলেও এদের দৈহিক গঠন একেবারেই ভিন্ন এবং এদের বসবাস গাছে। গাছের এডাল ওডাল সারাদিন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়ায়। কাঠবেড়ালীর লেজ তার শরীরের চাইতে বড় এবং লোমশ। আবার, এমন কিছু কাঁঠবেড়ালী আছে যারা বাতাসে ভাসতে পারে। আর এ ক্ষমতা তারা এগাছ থেকে ওগাছে যাবার জন্য ব্যবহার করে। এ জন্য কাঁঠ বেড়ালীরা কোন গাছের উঁচু ডাল থেকে লাফিযে পড়ে তারপর শূণ্যে ভাসতে থাকে। পানিতে নৌকার যেমন দিক নির্ণয় করা হয় বৈঠার সাহায্যে, তেমনি কাঠবেড়ালীরা তাদের মোটা লোমশ লেজটাকে বৈঠর মতোই ব্যবহার করে বাতাসে ভেসে থাকার সময় দিক ঠিক করার কাজে। লেজের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করে কিছুদূর গিয়ে কাঁঠবেড়ালী কাছের যে কোন স্থানে নেমে আসে। আর এ সময় বেড়ালের মতো কাঁঠবেড়ালীর পায়ের নিচে থাকা নরম মাংসপিন্ড তাকে সাহায্য করে নির্বিঘ্নে নেমে আসার জন্য।

লেখকঃ শাকিল ফারুক।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info