হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ।। Hans Christian Andersen

মনে আছে, সেই কুৎসিত হাঁসের ছানার গল্পটা? কিংবা থাম্বেলিনা গল্পটা? স্নো হোয়াইট অথবা ছোট্ট মৎস্যকুমারীর গল্প? এসব গল্প কে না জানে? এগুলোর কথা আবার নতুন করে বলার কী আছে? না, আজ ওই গল্পগুলোর কথা বলবো না, বলবো ওই গল্পগুলোর লেখকের কথা। নাম তার হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন। ডেনিশ, মানে ডেনমার্কের এই লেখক তার রূপকথাগুলোর জন্যই অমর হয়ে আছেন। তাই বলে কিন্তু ভেবেন না, তিনি অন্য কিছু লেখেননি; তার বিখ্যাত কিছু কবিতাও আছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটার নাম জেগ এর এন স্ক্যান্ডিনেভ, ইংরেজি করলে হয়- আই এম এ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান।

ভাবছেন, আজ হঠাৎ এই রূপকথার রাজপুত্রকে নিয়ে বসলাম কেন? আরে, ২ এপ্রিল যে তার জন্মদিন ছিল। আপনাদের জন্য যে লেখক এতো সুন্দর সুন্দর সব রূপকথা লিখে গেছেন, তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হবে না?

জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর আগে তো তার সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া দরকার, তাই না? তাহলে আর দেরি করে কাজ কী, চলেন শুরু করা যাক।


হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের জন্ম হয় ১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল, মঙ্গলবার; ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে। কিন্তু শহরের ঠিক কোথায় তার জন্ম হয়, সে কথা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। জানা যাবে কী করে, তার বাবা-মার তো তখনো কোনো স্থায়ী ঠিকানা-ই ছিল না! তার বাবা ছিলেন জুতোর কারিগর, আর মা ধোয়া-মোছার কাজ করতেন। সব মিলিয়ে তো বুঝতেই পারছেন, অ্যান্ডারসনরা বেশ গরিব ছিলেন। আর অ্যান্ডারসন ছিলেন বাবা মার একমাত্র সন্তান।

এখন গরিব ঘরের সন্তানদের ভাগ্যে কী জোটে, বলেন তো? ছোট্ট থাকতেই ওদের পড়াশুনা করা বাদ দিয়ে চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়। ঠিক একই কাজ করতে হলো অ্যান্ডারসনকেও; তিনিও বেরিয়ে পড়লেন টাকা রোজগারে ধান্দায়। শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রথমে কাজ করলেন এক কাপড়ের কারিগরের কাছে, এরপর এক নাবিকের কাছে।

এরই মধ্যে অ্যান্ডারসনের জীবনে দুটো বড় ঘটনা ঘটে গেল। তার বাবা নেপোলিয়নের নেতৃত্বে পেনিনসুলার যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে নেপোলিয়নের বেশিরভাগ যোদ্ধাই হয় মারা গিয়েছিলেন, নয়তো জখম হয়ে ফিরেছিলেন। অ্যান্ডারসনের বাবা বেঁচে ফিরলেও মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিলেন। সেই জখমের কারণেই তিনি মারা যান ১৮১৬ সালে। এর পর অ্যান্ডারসনের মা বেশিদিন একা একা থাকতে পারলেন না, দু’বছর পর তিনি আবার বিয়ে করলেন।


ওদিকে এসব শিক্ষানবিশী কাজ অ্যান্ডারসনের ভালো লাগছিল না। আপনি-ই বলেন, অ্যান্ডারসনের মতো কাউকে কী এসব কাজে মানায়? অনেক আগে, ওডেন্স শহরে তিনি একবার থিয়েটার দেখেছিলেন, যাকে বলে মঞ্চনাটক। আর সেই নাটক তাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। তিনি ভাবলেন, একটা থিয়েটারের দলেই যাওয়ার চেষ্টা করে দেখা যাক। এই ভেবে তিনি রওনা হলেন কোপেনহেগেনের পথে। সেখানকার রয়াল থিয়েটারে যদি তার একটা গতি হয়। এখন তো তার আর ওডেন্সে থাকারও তেমন দরকার নেই; বাবা নেই, মা-ও আরেকজনের সঙ্গে সংসার করছেন।

তখন ১৮১৯ সাল। রয়াল থিয়েটারের লোকজন তার প্রতিভা ঠিকই টের পেলেন। তবে প্রতিভা থাকলে কী হবে, বাবা-মা গরিব হওয়ায় যে তার পড়াশুনাই হয়নি! সুতরাং, প্রথমেই তার প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো।

১৮২২ সাল নাগাদ তিনি কয়েকটা নাটকেও কাজ করলেন। কিন্তু সফল হতে পারলেন না। তবে দলটির ম্যানেজার জোনাস কলিন তাকে পছন্দ করে ফেললেন। শুধু তাই না, তিনি অ্যান্ডারসনের অভিভাবকই হয়ে গেলেন। এই জোনাস কলিনই অ্যান্ডারসনের পড়াশুনার দায়িত্ব নিলেন। তিনি ভর্তি হলেন একটি গ্রামার স্কুলে। একবার স্কুল পরিবর্তনও করালেন। কিন্তু স্কুল তার ভাল লাগলো না। স্কুলের দিনগুলোই নাকি তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন ছিল! স্কুলের পরিবর্তে কলিন বাসায় অ্যান্ডারসনের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করলেন। আর ২৮ সালে পরীক্ষা দিয়ে পাসও করলেন অ্যান্ডারসন।


এর মধ্যেই কিন্তু অ্যান্ডারসনের একটা কবিতা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। ইংরেজিতে কবিতাটির নাম- দ্য ডাইং চাইল্ড। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ’২৭ সালে। আর তখনকার কোপেনহেগেনের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকাতেও নিয়মিতই তার কবিতা ছাপা হচ্ছিল।

১৮২৯ সালে অভিনীত হয় তার প্রথম নাটকও। বেশ জনপ্রিয়ও হয় নাটকটি। ’৩১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই। আর এ বছর তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই বের হয়। অ্যান্ডারসন বিখ্যাত মূলত দু’টি কারণে, তার রূপকথার জন্য তো তিনি বিখ্যাত-ই, আরেকটি কারণ আপনারা চিন্তাও করতে পারবে না- তার ভ্রমণ ডায়েরির জন্য (ট্রাভেলগ)। আর তার প্রথম ভ্রমণ ডায়েরিও প্রকাশিত হয় এ বছরই। জার্মানি ঘুরে এসে তিনি তার সেই ভ্রমণকাহিনী প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি ৩৩ সালে ভ্রমণের জন্য রাজার আর্থিক সহায়তাও পান। আর তা দিয়ে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ট্যুর দেন, জার্মানি- ফ্রান্স- ইতালি ট্যুর।


১৮৩৫ সাল অ্যান্ডারসনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর একটি। এ বছরেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম রূপকথার বই- এভেনটির, ফরটেল্ট ফর বর্ন। ইংরেজি করলে হয়- ফেইরি টেইলস, টোল্ড ফর চিল্ড্রেন। পরের দুই বছরে প্রকাশিত হয় তার আরো দুটি রূপকথার বই। তবে তখনই তার রূপকথাগুলো তেমন জনপ্রিয় হয়নি। বরং জনপ্রিয় হয়েছিল পরের কয়েক বছরে প্রকাশিত তার উপন্যাসদু’টি- ওটি এবং ওনলি এ ফিডলার। অবশ্য তার প্রথম উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছিল ’৩৫ সালেই, দ্য ইম্প্রোভাইজেটর।



তার রূপকথা গুলো প্রথম দিকে জনপ্রিয় না হলেও, লেখক হিসেবে মোটামুটি নামডাক হয়ে গিয়েছিল। আর তার রূপকথা লেখাও চলছিল। তবে তার প্রথমদিকের সবগুলো রূপকথার বইয়ের নামের শেষেই থাকত- টোল্ড ফর চিল্ড্রেন। ’৪৩ সালে প্রথম তার একটি রূপকথার বই বের হলো, যেটার নামে এই কথাগুলো লেখা ছিল না। মানে কী না সেটা ছিল বড়দের জন্য লেখা কবিতার বই।

’৪৫ সালে তার লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে প্রকাশ করা শুরু হয়। জার্মান ভাষায় প্রথম তার লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হয় ’৪৭ সালে। আর ফরাসি ভাষায় ’৪৮ সালে তার প্রথম যে লেখাটি অনুবাদ হয়, সেটি তো রূপকথাই ছিল।

চার্লস ডিকেন্সের নাম শুনেছো তো, যার অমর রচনা অলিভার টুইস্ট আর ডেভিড কপারফিল্ড? সেই চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে অ্যান্ডারসনের কিন্তু বেশ ভাব ছিল। ’৫৭ সালে তো অ্যান্ডারসন ইংল্যান্ডে গেলেন একরকম ডিকেন্সের বাসায় থাকতেই। ডিকেন্সের বাসায় তিনি ছিলেন প্রায় পাঁচ সপ্তাহ! এতোদিন অবশ্য থাকার কথা ছিলই না। কিন্তু ডিকেন্সের বাসার সবাই এমন করে ধরলো, তিনি আর না থেকে পারলেন না।


১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয় তার শেষ রূপকথা। আর লিখবেন কী করে, তিনি যে সে বছরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন; যাকে বলে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। তার শেষ দিনগুলো কেটেছিল এক বন্ধুর বাসায়। মরিৎজ নামের তার ওই বন্ধুটি ছিলেন ব্যাংকার। বলা হয়নি বুঝি, অ্যান্ডারসন যে জীবনে বিয়ে-ই করেননি। আর তাই তিনি যখন ভীষণ রোগে শয্যাশায়ী, তার সেবা-শুশ্রূষার ভার নিলেন তার বন্ধু মরিৎজ ও তার স্ত্রী। কোপেনহেগেন থেকে একটু দূরে অবস্থিত মরিৎজের রোলিঘেড নামের বাসায় কাটে অ্যান্ডারসনের শেষ দিনগুলো। অবশেষে, ১৮৭৫ সালে ৪ আগস্ট তিনি সেই বাসাতেই মারা যান।

মারা যাওয়ার আগেও কিন্তু তিনি ছোট্টদের কথা ভোলেননি একবারও। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তিনি এক কম্পোজারকে ডেকে নিজের অন্তেষ্টিক্রিয়া, যাকে ইংরেজিতে বলে ফিউনেরাল, সেই অনুষ্ঠানে বাজনা বাজানোর দায়িত্ব দিলেন। তাকে বলে দিলেন, বাজানোর সময় বিটগুলো যেন দ্রুত লয়ের হয়। সাধারণত এসব অনুষ্ঠান খুব গম্ভীর হয়, আর তাই বাজনাও হয় খুব ধীর লয়ের। লোকজন বিটের তালে তালে আস্তে আস্তে হাঁটে। কিন্তু তিনি তো ততোদিনে রূপকথা লিখে ছোটদের মধ্যেও খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছেন। সুতরাং, তার মৃত্যুর পরে কতো শিশু আসবে। ওরা কি আর ওভাবে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটতে পারবে? তাই তিনি আগে থেকেই কম্পোজারকে বলে দিলেন, বাজনা বাজাতে হবে দ্রুত লয়ে, যেন ছোটদের কষ্ট না হয়।


এবার শোনেন, পৃথিবীর কোথায় কোথায় এই রূপকথার রাজপুত্রের মূর্তি আছে। তিনি ছিলেন ড্যানিশ লেখক, তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন এই ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। সুতরাং, সেখানে তার মূর্তি তো থাকতেই হবে। সেখানে অবশ্য ঠিক তার নিজের মূর্তি নেই, আছে তার বিখ্যাত মৎসকন্যার মূর্তি- স্ট্যাচু অফ দি লিটল মারমেইড। তার নিজের মূর্তি আছে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক আর ক্যালিফোর্নিয়ায়; আছে স্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভা শহরেও।

এ তো গেল শুধু মূর্তির হিসাব। এবার আরো বড় হিসাব শোনেন। জাপানে তার নামে একটা আস্ত থিম পার্কই আছে। আর পোল্যান্ডে তার নামে আছে একটা আস্ত থিয়েটার, যেখানে অভিনয়ের পাশাপাশি পাপেট শো-ও হয়। ওদিকে ২০০৬ সালে চীনের সাংহাই শহরে রীতিমতো এলাহী কাণ্ড হয়ে গেছে। সেখানে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটা থিম পার্ক বানানো হয়েছে। আর এই পার্কটি শুধু তার নামেই করা হয়নি, পার্কটির সবগুলো রাইড তার জীবন আর রূপকথার গল্প নিয়ে বানানো হয়েছে।

লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info