অলিম্পিক ।। Olympic

গল্পের শুরু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, ৭৭৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে। গ্রিসের অলিম্পিয়ায় একটা খেলাধুলার উৎসব হতো। সেখানে খেলতো শুধু গ্রিক ভাষাভাষি মুক্ত মানুষেরা। ভাবছেন ‘মুক্ত মানুষ’, সে আবার কী! সে যুগে মানুষে মানুষে ভেদাভেদটা অনেক বেশি ছিল। যাদের টাকা বেশি ছিল, আভিজাত্যের অহঙ্কার ছিল, তারা, যাদের ওসব নেই তাদের কিনে বন্দী করে রাখতো। বন্দীরা থাকতো দাস হয়ে। মনিব যা বলতো তা করতে হতো তাদের। সেই দাস বা বন্দীরা গ্রিসের ওই ক্রীড়া উৎসবে যোগ দিতে পারতো না। সেখানে আনন্দ লুটতো শুধু মনিব বা মুক্ত মানুষরা।


একটা মাত্র খেলা হতো তখন। স্টাডে বা ফুটরেস। নাম শুনে বুঝতে পারছেন কেমন ছিল খেলাটা? বলতে পারেন এক ধরনের দৌড় প্রতিযোগিতা। স্টাডে যে জায়গাটায় হতো সেটাকেও বলা হতো স্টাডে। একসময় স্টাডে হয়ে গেল স্টেডিয়াম। কেমন করে? সেই বর্ণনা আজ থাক। এটুকু বুঝতে পারছেন তো এখন যে কোনো মাঠ দেয়াল বা গ্যালারিতে ঘিরে দিলেই যে আমরা তাকে স্টেডিয়াম বলি, ওই স্টেডিয়াম শব্দটা এসেছে কোথা থেকে? এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে অলিম্পিয়া থেকেই এসেছে অলিম্পিক শব্দটা? আসলে কি জানেন, আজকের অলিম্পিক যেমন স্রেফ খেলাধুলার প্রতিযোগিতা, সেই প্রাচীন আমলের অলিম্পিক কিন্তু শুধু তা ছিল না। তখন ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই অলিম্পিয়ার ওই উৎসবের আয়োজন করতেন গ্রিসবাসীরা। ৩৯৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ওভাবেই চলেছে। তারপর একসময় বন্ধ হয়ে যায় অলিম্পিক।


এ যুগের অলিম্পিক, অর্থাৎ আধুনিক অলিম্পিকের পথ চলা শুরু ১৮৯৬ সালে। ১১২ বছর হয়ে গেছে। এক অর্থে মরে যাওয়া খেলাধুলার ছোট্ট একটি আয়োজনকে যে ১৫০৩ বছর পর, ৩৯৩ সালে আবার বাঁচিয়ে তুলে নতুন রূপ দেয়া হলো তার মূল কৃতিত্ব ব্যারন পিয়েরে দা কুবার্তিন নামের এক ভদ্রলোকের। ফরাসী এই ভদ্রলোকের প্রস্তাবে অন্যরা সায় দিয়ে এগিয়ে আসাতেই ১৮৯৬ সালে বসেছিল আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর। প্রাচীন আর আধুনিক অলিম্পিকের পার্থক্য কী? মিলিয়ে দেখলে পরিবর্তনটা আপনাদেরও চোখে পড়বে। দু’একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন কুবার্তিনের অলিম্পিক জীর্ণ পুরাতনকে কত বর্জন করেছে। শুধু ভাবেন, প্রাচীন অলিম্পিকে অংশ নিতো শুধু গ্রিসের অভিজাত শ্রেণী আর আধুনিক অলিম্পিকে অংশ নেয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সেরা ক্রীড়াবিদরা। প্রাচীন অলিম্পিকে ক্রীড়াবিদরা মাঠ ভর্তি দর্শকের সামনে দৌড়াতো বস্ত্রহীন হয়ে। আর এখন? পোষাকের কত বাহার! আরও পার্থক্য খুঁজলে উঠে আসবে আয়োজক প্রসঙ্গ। সে আমলে গ্রিসই ছিল অলিম্পিকের স্থায়ী ঠিকানা। আধুনিক অলিম্পিকের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, তাই গত আসরের আয়োজক ছিল গ্রিসের এথেন্স আর এবার চীনের বেইজিং। অলিম্পিক কবে হবে , এ প্রশ্নের সহজ উত্তর আছে। লিপইয়ারে, প্রতি চার বছর পরপর হয় অলিম্পিক। লিপইয়ার কি এটা যারা জানেন না, তাদের কিন্তু এই অলিম্পিক দিয়েই বোঝানোর একটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন! এমন অনেক কিছুই শিখতে পারেন, শেখাতে পারেন অলিম্পিক থেকে। শেখা যায় ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মীতা। ক্রীড়াবিশ্বের এই মহাযজ্ঞে বিশ্বমানচিত্রে প্রায় অপরিচিত দেশগুলোর সগর্ব অংশগ্রহণ দেখে বুঝতে পারো “জেতা নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা” এই আপ্তবাক্যের মর্মার্থ। আবার সব প্রতিকূলতাকে জয় করে কী করে খ্যাতির শিখরে ওঠা যায় তার দৃষ্টান্তও খুঁজে নেয়া যায় অলিম্পিক থেকে। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে ইথিওপিয়ার আবেবে বিকিলা কিভাবে খালিপায়ে দৌড়ে ম্যারাথন জিতেছিলেন, সেবারই যুক্তরাষ্ট্রের উইলমা রুডলফ কিভাবে পোলিওকে জয় করে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিন তিনটি সোনা, ১৯৮৮’র লসএঞ্জেলস অলিম্পিকে গ্রেগ লুগানিস কী অসম সাহসিকতায় একবার বোর্ডে পড়ে মাথা ফাটিয়েও শেষ পর্যন্ত জিতে নিয়েছিলেন সিপ্রংবোর্ড ডাইভিংয়ের সোনা। অলিম্পিক এমন এক জাদু যা দেখে ছেলে বুড়ো সবাই ওড়াতে থাকে কল্পনার ফানুস। এবার গরীব দেশের মেসার্ট ডিফার (ইথিওপিয়া), কেনেনিসা বিকেলে (ইথিওপিয়া), এজকিয়েল কেমবোইদের (কেনিয়া) কাউকে বিজয়স্তম্ভে দেখলে পৃথিবীর কোন সুযোগ বঞ্চিতের না আকাশ ছোঁয়ার সাধ জাগবে! সাঁতার, ওয়াটারপোলো দেখলে এ দেশের অনেকের মনই শৈশবে ফিরে যাবে। ফেন্সিং (বলতে পারেন তলোয়ারযুদ্ধ) দেখে কোনো কিশোর মনে রূপকথার বীর রাজপুত্তুর হওয়ার সাধ জাগতেই পারে, ইকুয়েস্ট্রিয়ান দেখে রবি কবির ‘বীরপুরুষ’ ফিরে আসতেই পারে। এ যে অলিম্পিক!


এক নজরে বিগত বেইজিং অলিম্পিকঃ
  • মোট অংশগ্রহনকারী দেশঃ ২০৩টি
  • মোট ক্রীড়াবিদঃ ১০,৭০৮ জন
  • মোট ভেন্যুঃ ৩৭টি
  • মোট ডিসিপ্লিনঃ ৩৪টি
  • মোট ইভেন্টঃ ৩০২টি
  • এ পর্যন্ত আয়োজকদের মোট ব্যয়ঃ প্রায় ১৬০,০০০০০০০০০০ ডলার (১৬০ বিলিয়ন ডলার)
মাসকটঃ
৫টি মাসকট ছিল গত অলিম্পিকে। বেইবেই, জিংজিং, ইংইং, নিনি আর হুয়ানহুয়ান। বেইবেই একটি মাছ, জিংজিং একটি পান্ডা, ইংইং মৃগ হরিণ, নিনি হলো আবাবিল পাখি আর হুয়ান হুয়ান অলিম্পিক শিখা।

অলিম্পিকে প্রথমঃ
প্রথম অলিম্পিক আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর ১৮৯৬ সালে, এথেন্সে হলে কী হবে, প্রথম অলিম্পিক হয়েছিল কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রাচীন অলিম্পিকের প্রথম আসর সত্যিই বসেছিল সেই ৭৭৬ খৃষ্ট পূর্বাব্দে। সেই অলিম্পিকে খেলা ছিল মাত্র একটি। কী সেটা বলতে পারবেন? ফুটরেস! হ্যাঁ, এক ধরনের দৌড়।

অলিম্পিকে মহিলাঃ
অলিম্পিকে মেয়েদের অংশ নেয়ার সুযোগ শুরুতে ছিল না। মেয়েরা প্রথম সুযোগ পায় ১৯০০ সালে। সেবার শুধু টেনিস আর গলফে অংশ নিয়েছিলেন ১১জন মহিলা।

পদকের আগমনঃ
আজ সব খেলায় বা খেলার বাইরেও সব প্রতিযোগিতায় যেমন প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে গলায় সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জের পদক তুলে দিতে দেখো অলিম্পিকে একসময় কিন্ত সোনা, রূপা দূরের কথা খাতা কলমও দেয়া হতো না। প্রাচীন অলিম্পিকে বিজয়ীকে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হতো জলপাই গাছের ডাল। আধুনিক অলিম্পিকে কোনো প্রতিযোগিতার তিন সেরাকে সোনা, রূপা আর ব্রোঞ্জ দেয়া শুরু হয় ১৯০৮ সালের আসর থেকে। এর আগে ১৮৯৬, ১৯০০ আর ১৯০৪ সালেও পদক দেয়া হয়েছে, তবে শুধু রূপা আর ব্রোঞ্জ। প্রথম হলে রূপা আর দ্বিতীয় হলে ব্রোঞ্জ। তখন তৃতীয় হলে জুটতো শুধু হাততালি!


পতাকাঃ
অলিম্পিকের কিন্তু নিজস্ব পতাকা আছে। সেটা কোন আসর থেকে ওড়ে বলতে পারেন? ১৯২০ সালের আসর থেকে।

অলিম্পিক প্রতীকঃ
অলিম্পিক এলেই খবরের কাগজে, টেলিভিশনে বা নানা ওয়েবসাইটে পাঁচটি বৃত্ত পাশাপাশি রেখে তৈরি একটা প্রতীক আপনাদের অনেকেই হয়তো দেখে থাকবেন। ওটা কিন্তু অলিম্পিক প্রতীক। আমরা একে ‘অলিম্পিক রিং’ নামেই চিনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলাধুলার উৎসবে অলিম্পিক রিংয়ের আগমন ১৯২০ সালে।

অলিম্পিক মশালঃ
অলিম্পিক শুরুর বার্তা নিয়ে মশালের ছুটে বেড়ানোর খবর আজ কে না জানে। প্রতিটি আসর শুরুর আগেই এ খবর বেশ গুরুত্ব পায়। তা অলিম্পিকের এই বার্তাবাহক কবে থেকে কাজ শুরু করেছে জানেন? ১৯২৪ সাল থেকে।

অলিম্পিকের কিছু মজার রেকর্ডঃ
সবচেয়ে কম বয়সী আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট একটি ছেলে। নাম দিমিত্রিওস লাউন্ড্রাস। গ্রিসের এই কিশোরের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। ওই বয়সেই সে নেমে পড়েছিল জিমনাস্টিকসে বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে। সেই থেকে দিমিত্রিওস লাউন্ড্রাস নামটা এখন ইতিহাসের অংশ। তার চেয়ে কম বয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ে যে এখনো অলিম্পিকের কোনো ইভেন্টে অংশ নিতে পারেনি! সবচেয়ে বেশি বয়সী লাউন্ড্রাস যদি বাচ্চা ছেলে হয় তাহলে অস্কার সোয়ানকে কী বলতে পারি? নিশ্চয়ই বুড়ো! ১৯২০ সালের আসরে অংশ নেয়ার সময় তার বয়স ছিল ৭২ বছর ২৮০ দিন। ওই বয়সেই অলিম্পিকে তার ষষ্ঠ পদক জিতে আসরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বয়সী ক্রীড়াবিদ হয়ে যান সোয়ান।

সবচেয়ে বেশি পুরস্কারঃ
১৯৬৪ সাল। রাশিয়া তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সে দেশের জিমনাস্ট লারিসা লাতিনিনা সেবার যে কীর্তি গড়েছিলেন ৪৪ বছর পরও তা অম্লান। তার আগে ১৯৫৬ আর ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে ৬টি পদক জিতেছিলেন লাতিনিনা। ১৯৬৪’র আসরে ৬টি পদক পেলেই হ্যাটট্রিক, এমন সুযোগ লাতিনিনা হাতছাড়া করলেন না, সেই সুবাদে হয়ে গেলেন অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পদক পাওয়া ক্রীড়াবিদ। তিন আসরে ৬+৬+৬ = ১৮ টি পদক, লারিসা লাতিনিনার মতো এতগুলো অলিম্পিক পদক এখনো আর কেউ জিততে পারেননি।

লেখকঃ আশীষ চক্রবর্তী।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info