ভয়ংকর সুন্দরী শুঁয়োপোকা ।। Terrible Beautiful Caterpillar

আমাদের বাসার ভিতরে, আশেপাশে, বাগানে, দেয়ালে, মাঠে নানা জায়গায় প্রতিদিন কতো পোকাই না আমরা দেখি। সব পোকার নাম কি আর বলতে পারা যায়? এই বিশাল পৃথিবীতে কতো প্রজাতিরই যে পোকা মাকড় আছে! কিছু আছে দেখতে খুবই সুন্দর, কিছু দেখতে একদম কুৎসিত, কিছু পোকা মারাত্মক বিষাক্ত হলেও অদ্ভুত সুন্দর। আবার কিছু কিছু পোকার আলাদা আলাদা জাতও আছে। এই যেমন ধরেন শুঁয়োপোকা। এদের আবার অনেকগুলো প্রজাতি আছে। কিছু আছে খুবই সুন্দর। আপনি চাইলেই হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। আবার কিছু আছে খুব কুৎসিত, দেখলেই ঘেন্না লাগবে। আবার এমনও শুঁয়োপোকা আছে যেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর, কিন্তু এতোই বিষাক্ত যে হাত দিয়ে ছোঁয়াও যাবে না। আপনারা জানেন কি, এই শুঁয়োপোকারই কিছু প্রজাতির পরবর্তী প্রজন্মই হচ্ছে স্বপ্নের মতো রঙিন আর আশ্চর্য সুন্দর প্রজাপতি? ওই শুঁয়োপোকা গুলোকে বলা হয় মথ। না, আজকে আমরা প্রজাপতির গল্প শুনবো না, শুনবো আশ্চর্য সুন্দর আর ভীষণই বিষাক্ত কিছু শুঁয়োপোকার গল্প।


সেডেল্-ব্যাক শুঁয়োপোকাঃ
এই শুঁয়োপোকা খুবই অলস, গদাই লস্করি চালে চলাফেরা করে। এর শরীর সবুজ ও বাদামী রঙের শরীরের মাঝখানে বেগুনী ও বাদামী ফোঁটা ফোঁটা থাকায় এটিকে দেখতে দেখায় ঘোড়ার পিঠে থাকা জিনের মতো। যখন এই পোকাটি সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে তখন এটি এক ইঞ্চি লম্বা আর ৩-৪ ইঞ্চি চওড়া হয়। এর কিন্তু শিংও আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না? এর শরীরের দুই পাশে দু’টি লোমে ঢাকা মাংসের শিং থাকে। লোম দিয়ে ঢাকা থাকায় শিংগুলোকে অবশ্য দেখা যায় না। এই শিং দুটি কিন্তু খুবই বিষাক্ত, আর যেখানে খুশি সে তার এই দুটি শিং বাইরে লম্বা করে বের করতে পারে। যদি কোনোভাবে এটি কারো শরীরে লাগে তবে তো কথাই নাই। শরীরের যেখানে লাগবে সেখানে ফুলে উঠবে, বমি বমি ভাব হবে আর চামড়ায় ফুসকুঁড়ি উঠবে। আর একবার আপনাকে যদি ঢুঁস দিয়েই বসে, তবে পুরো একদিন আপনাকে ভোগাবে এই সুন্দর শুঁয়োপোকার শিংয়ের গুঁতো। এই বিষাক্ত শুঁয়োপোকাটি আমাদের ঘরের ফুলের টবে, বাগানে, মাঠে কি জঙ্গলে, সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। এটি গাছে, ঝোপে ঝাড়ে থাকে আর ওখানে থেকেই যা পায় তা খায়।


ছিনাবার মথ শুঁয়োপোকাঃ
এই প্রজাতির শুঁয়োপোকাটি প্রথম প্রথম ফ্যাকাশে হলুদ রঙের থাকে। পরে যখন পুরোপুরি বেড়ে ওঠে তখন এর রঙ হয় গাঢ় হলুদ অথবা কমলা আর কালো কালো ডোরাকাটা। এরা থাকে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর উত্তর আমেরিকার কিছু বিষাক্ত গাছে। এদের কিন্তু ক্ষুধা খুব বেশি। যাকে বলে একদম রাক্ষুসে ক্ষুধা। একসাথে পুরো এলাকার আগাছা খেয়ে ফেলতে পারে এরা! শিকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা কী করে জানেন? সবাই মিলে একসঙ্গে থাকে। কী বুদ্ধিমান ওরা, চিন্তা করেন!


রাজা শুঁয়োপোকাঃ
এই হলুদ, কালো ও সাদা রঙের ডোরাকাটা দাগের শুঁয়োপোকাটি আকারে খুবই ছোট। এই শুঁয়োপোকারও একজোড়া কালো সরু সুতার মতো শিং আছে। আর এরা বাড়েও খুব দ্রুত। দুধের মতো রসওয়ালা একজাতের উদ্ভিদ ছাড়া এরা আর কিচ্ছু খায় না। পুরোপুরি বেড়ে ওঠার পর এটি লম্বায় হয় ২ ইঞ্চি। দেখতে খুব সুন্দর হলে কি হবে, এরা এতই বিষাক্ত যে, কোনো পাখিও ওদেরকে খায় না! ওরা যেই উদ্ভিদ খেয়ে বাঁচে, সেই গাছটাও যে বিষাক্ত! তবে বিষাক্ত হলে কী হবে। যখন এরা প্রজাপতি হয়ে যায়, তখন দেখতে অনেক সুন্দর হয়! ওদের মতো সুন্দর প্রজাপতি আর একটিও হয় না। তাই একে বলা হয় প্রজাপতিদের রাজা।


জিপসি মথ শুঁয়োপোকাঃ
মে মাস থেকে জুলাই এর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই জিপসি শুঁয়োপোকাদের দেখা যায়। সদ্য ডিম ফুটে বের হওয়া এই শুঁয়োপোকা দেখতে কালো হয় আর পুরো গায়ে শক্ত ছোট ছোট লোম থাকে। বুড়ো শুঁয়োপোকাদের পিঠে পাঁচ জোড়া নীল আর ছয় জোড়া লাল ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। আর থাকে অল্প কিছু লোম। অল্প লোম বলে আবার অবজ্ঞা করবেন না। এই লোমগুলোই কিন্তু ওদের মোক্ষম মারণাস্ত্র। এই লোমে ছোঁয়া লাগলে ব্যথা তো হয়ই, সেই সঙ্গে চামড়ায় নানা ধরনের সমস্যাও হয়। আর ওদের প্রিয় খাবার কি জানেন? ম্যাপল গাছ, ওক গাছ, এইসব গাছের পাতা।


ব্যাগ শেল্টার শুঁয়োপোকাঃ
ওদের কিন্তু একটা বিশেষ নাম আছে, মিছিল করা শুঁয়োপোকা! কারণ, ওরা যখন হাঁটে তখন রীতিমতো মিছিল করে হাঁটে। মিছিলে যেরকম মানুষ একজনের পিছে আরেকজন লাইন করে থাকে, ঠিক সেরকম। আর কী জানেন, শুঁয়োপোকাদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত। তাই এদের কোনভাবেই স্পর্শ করা পুরোপুরি নিষেধ। যেই ওদের স্পর্শ করবেন, সাথে সাথে আপনার শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হবে। এই শুঁয়োপোকাদের শরীরের বিষে এমন কিছু উপাদান আছে যা একজন মানুষের শরীরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে তাকে মেরে ফেলতে পর্যন্ত পারে! আর এর শরীর স্পর্শ না করে যদি শুধু এর লোম স্পর্শ করেন, তবু রক্ষা নেই, আপনার গায়ে ফুসকুঁড়ি আর চুলকানি হবেই। এদের গায়ের রং গাঢ় বাদামি আর মাথার রঙও বাদামি। এরা বাদামি রঙের রেশমের তৈরি থলের ভিতর বাস করে আর বের হয়ে আসে রাতে, তাও শুধুই খাওয়ার জন্য। অয়াটল গাছে এদের বিশ্রাম নিতে অথবা লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ওরা এই গাছে শুধু বিশ্রামই নেয় না, এই গাছের পাতাও খায়।


পাস শুঁয়োপোকাঃ
উত্তর আমেরিকার সবচাইতে বিষাক্ত শুঁয়োপোকা হচ্ছে এই পাস শুঁয়োপোকা বা পশমি শুঁয়োপোকা। এর তুলার মতো তুলতুলে লোমে ঢাকা শরীর দেখে বোকা বনে যেতে হয়, একটা শুঁয়োপোকা এত্তো সুন্দরও হতে পারে! এর একটা কারণও আছে। এদের গায়ের লোমের নিচেই যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য বিষাক্ত শিং! আর কোনো জায়গায় একবার স্পর্শ করলেই হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে শিংগুলো বিষ ছড়িয়ে দেয়।আর শুরু হয়ে যায় মাথাব্যথা আর বমি বমি ভাব। আর তা কয়েকদিন স্থায়ীও হয়। তবে এর লম্বা নরম সুন্দর লোমগুলো মোটেও ক্ষতিকর না। এর গায়ের রঙ সাদা, সোনালী আর বাদামি। এক ইঞ্চি লম্বা এই শুঁয়োপোকা মূলত সিট্রাস, ওক ইত্যাদি গাছে থাকে। এছাড়া বাগানের গাছগাছড়াতেও এদেরকে দেখা যায়।


স্ট্রিঙ্গিং রোজ শুঁয়োপোকাঃ
এই শুঁয়োপোকাটি যেমন ছোট্ট, তেমন রঙিন আর সেইরকম সুন্দর। আকারে এরা এক ইঞ্চিও হবে কিনা সন্দেহ। এদের গায়ের রং লাল, কমলা আর হলুদ, আর তার উপরে থাকে বেগুনী আর সবুজ রঙের ছোপ। এটা এতই বিষাক্ত যে, বলা হয় এর গায়ের উজ্জ্বল রঙ আসলে আপনাকে সাবধান করার জন্য। গায়ের উজ্জ্বল রং যেন সবসময় আপনাকে এই বলে সাবধান করতে থাকে, কেবল দেখেন, ভুলেও ছুঁতে যাবেন না। তবেই আপনার খবর হয়ে যাবে! এই রঙিন শুঁয়োপোকাটিরও শিং আছে, আর সে শিং বিষাক্তও বটে। শিং স্পর্শ করা মাত্রই চামড়ায় বিষ ছড়িয়ে যায়, ফুসকুঁড়ি ওঠে। চেরী, আপেল, ম্যাপেল, ওক ইত্যাদি গাছে এরা বাস করে।


হাইকোরী টুসোক শুঁয়োপোকাঃ
এই সাদা কালো শুঁয়োপোকাটির শরীর ধুসর সাদা লোমে ঢাকা। পাশে আবার কালো কালো দাগও আছে। এর কিন্তু শিং নেই। এর অস্ত্র হলো লোম! ওদের সামনে ও পিছনে লম্বা তীক্ষ্ণ আর কালো দুইটি লোম আছে। এই লোমজোড়া খুবই বিষাক্ত। এই লোম গায়ে লাগলে চামড়ায় ফুসকুঁড়ি তো হয়ই, এমনকি চামড়া একেবারে নষ্টই হয়ে যেতে পারে! ওদেরকে অবশ্য সারা বছর দেখা যায় না। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ কানাডা ও উত্তর আমেরিকার কিছু অংশে দেখা যায়। বাকি সময় যে ওরা কোথায় লুকিয়ে থাকে, কে জানে!


লু মথ শুঁয়োপোকাঃ
এই শুঁয়োপোকাটির কিন্তু একটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য আছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর গায়ের রঙও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথমে ওর গায়ের রং থাকে কমলা। আর বড় হলে তা হয়ে যায় হালকা সবুজ। আর সেই সাথে সাদা দাগ ছড়িয়ে যায় পুরো শরীর জুড়ে। এটাকে তো তাহলে গিরগিটি শুঁয়োপোকা বলা যায়, কি বলেন? ২ ইঞ্চি লম্বা এই শুঁয়োপোকাটির শিং থেকে আবার দুই ধরনের বিষ বের হয়। হালকা ছোঁয়াতেই এই বিষ শরীর একদম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরা সব ধরনের গাছেই বাস করে। চেরী, ম্যাপেল, ওক, নাশপাতি- এসব গাছের পাতা খায়। আর ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেকোনো খোলা মাঠে অথবা ভুট্টা ক্ষেতে এরা ঘুরে বেড়ায়।

তো, খুব তো সুন্দর সুন্দর আর ভীষণ ভয়ানক ভয়ানক সব শুঁয়োপোকাদের গল্প শুনলেন! এখন নিশ্চয়ই শুঁয়োপোকাদের ধরার আগে কয়েকবার করে ভাববেন, ওটা বিষাক্ত নাকি বিষাক্ত নয়! তবে এই ভয়ানক শুঁয়োপোকাগুলোই কিন্তু পরে পরীর মতো সুন্দর একেকটা প্রজাপতি হয়ে যায়। আর তখন ওদের ধরলেও কিচ্ছুই হয় না। ওরা তো তখন আর শুঁয়োপোকা থাকে না, হয়ে যায় প্রজাপতি!

লেখকঃ সীমা।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info