ডাকটিকিট আর পোস্টকার্ড ।। Stamps & Postcards


আপনারা কেউ কি ডাকটিকিট জমান? কিংবা পোস্টকার্ড? অনেকেই হয়তো জমান না। কিন্তু আপনাদের আব্বু আম্মু, কিংবা বড়ো ভাই বোনদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা ঠিকই ডাকটিকিট নয়তো পোস্টকার্ড জমাতো। এখন তো তোমরা আর চিঠিও লেখেন না, পোস্টকার্ডও পাঠান না। তাই এগুলো জমানোর যে কত্তো মজা, তাও আপনারা জানো না। কিন্তু জানো, পৃথিবীতে এখনো মানুষের শখের তালিকায় এগুলো উপরের দিকেই আছে। ঠিকঠিক করে বললে, ডাকটিকিট আর পোস্টকার্ড জমানো শখের তালিকায় ৩ নম্বরে আছে। শুধু তাই নয়, এগুলোর উপর আলাদা একটা শাস্ত্রও আছে, নাম ‘ডেলটিওলোজি’। ডেলটিওলোজিতে মূলত পোস্টকার্ড নিয়ে পড়াশোনা করা হয়। আমরা ডাকটিকিট আর পোস্টকার্ড কিভাবে জন্ম নিলো, সেই গল্প শুনে আসি।


ডাকটিকিটের জন্ম হলো যেভাবেঃ
আচ্ছা, চিঠি পাঠানোর আগে মানুষ কিভাবে খবর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠাতো, বলেন তো? ঐ যে, পায়রা উড়িয়ে, কিংবা হাতে হাতে চিঠি পাঠিয়ে। কিন্তু সে তো অনেক হ্যাপা। তাই সবাই চিন্তা করতে লাগলো, কিভাবে আরো সহজে খবর পাঠানো যায়। ধরেন, আপনি চট্টগ্রামে একটা খবর পাঠাবেন। সেজন্য তোমাকে বসে বসে অপেক্ষা করতে হবে, কবে কেউ যাবে চট্টগ্রামে। এ কী সহ্য করা যায়! সেজন্য চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা তো হলো, কিন্তু ডাকটিকিট তো তখনো বানানো হয়নি। পরে ১৮৬০ সালে উইলিয়াম ডকোরা নামে একলোক ‘লন্ডন পেনি পোস্ট’ নামে এক ধরনের ব্যবস্থা প্রচলন করলো। এই ব্যবস্থায় যে কেউ চাইলেই কোনো খবর বা হালকা কোনো জিনিস লন্ডনের যে কোনো জায়গায় পাঠাতে পারতো। আর তার জন্য সবাইকে এক পেনি মানে ওখানকার এক পয়সার একটা স্ট্যাম্প বা ডাকটিকিট কিনতে হতো।


কিন্তু সেই ডাকটিকিট তো আর সরকারিভাবে বের করা হয়নি। পরে ১৮৩৫ সালে স্যার রোল্যান্ড হিল নামে এক বৃটিশ ভদ্রলোক বৃটেনে ডাক ব্যবস্থার এক মাস্টারপ্ল্যান করতে শুরু করলেন। আর ১৮৪০ সালে সেই মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবেই প্রবর্তন করা হলো ডাকটিকিট। ১ মে বাজারে ছাড়া হলো পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ডাকটিকিট, ব্ল্যাক পেনি। সাদাকালো ডাকটিকিটটিতে ছিলো রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি আবক্ষ ছবি, ছবিতে রাণীমা কিন্তু মুকুটও পরে ছিলেন। আর তার দুই দিন পরেই বাজারে ছাড়া হয় টু পেন্স ব্লু, ২ পেনির নীল রঙের ডাকটিকিট; এটাতেও ছিলো রাণীমা’র ছবি।

আর কী আশ্চর্য! ডাকটিকিট বের করার পর থেকেই চিঠি পাঠানো হু হু করে বেড়ে গেলো। ১৮৪০ এর আগের দশকে যেখানে মোট চিঠি পাঠানো হয়েছিলো মোটে সাড়ে সাত কোটি, সেখানে ডাকটিকিটের প্রচলন হওয়ার পরের দশকে চিঠি চালাচালি হলো ৩৫ কোটি!

এরই মধ্যে সব বড়ো বড়ো দেশেই ডাকটিকিটের প্রচলন হয়ে গেছে। একে একে ডাকটিকিট ছেড়েছে সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, আমেরিকা। আর ব্রাজিলের ডাকটিকিটের নামটাও ছিলো খুব মজার, ‘বুল’স আই’।


১৮৫০ সালে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেও ডাকটিকিট চালু হয়ে গেলো। এর পরের দশ বছরের মধ্যেই ডাকটিকিটের প্রচলন হয়ে গেলো পৃথিবীর সব দেশেই। আর এখন ডাকটিকিট ছাড়া তো চিঠি পাঠানোর কথা চিন্তাই করা যায় না। এমনিক ডাকটিকিট ছাড়া কোনো কিছুই পাঠানো যায় না। এয়ারমেইল করতে হলেও আপনাকে ডাকটিকিট লাগাতে হবে। সেজন্য অবশ্য আলাদা ডাকটিকিট লাগে।

এরমধ্যে অবশ্য ডাকটিকিটকে আরেকটা সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। প্রথম যখন ডাকটিকিট বানানো হয়েছিলো, তখন ডাকটিকিট কাঁচি দিয়ে কাটতে হতো। মানে এখন যেমন ডাকটিকিটের চারপাশে ছেঁড়ার জন্য ছিদ্র করা থাকতো, তখন সেটা করা থাকতো না। আরে, করবে কিভাবে, অমন করে ছিদ্র করার কোনো যন্ত্রই যে তখন ছিলো না!


এ নিয়ে তো সবাই ভীষণ বিপদে পড়ে গেলো। কি করা যায়? যারা পোস্ট অফিসে কাজ করতো, ওদেরকে তো সারা দিন হাজার হাজার ডাকটিকিট ছিঁড়তে হতো। আর তাই করতে গিয়ে কত্তো ডাকটিকিট যে নষ্ট হতো! সবাই তখন গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে বসে গেলো, কিভাবে ডাকটিকিটগুলোকে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যায়। এবারও উদ্ধার করলেন এক বৃটিশ ভদ্রলোক। ডাকটিকিট আবিষ্কারের প্রায় দশ বছর পর হেনরি আর্চার নামের এই বৃটিশ অমন ছিদ্র করার এক যন্ত্র তৈরি করলেন। এভাবে ছিদ্র করাকে বলা হয় ‘পারফোরেশন’। আর এখন তো অমন করে ছিদ্র করা না থাকলে, ডাকটিকিটের চারপাশে অমন ডিজাইন না থাকলে সেটাকে ডাকটিকিটই মনে হয় না!


বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটঃ
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় কবে, বলেনতো? ১৬ ডিসেম্বর? উঁহু, ওটাতো আমাদের বিজয়ের দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকেই আসলে আমরা স্বাধীন। সেই হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই আমরা স্বাধীন। আর একটা স্বাধীন দেশের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চাই সরকার। সেটাও হলো ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। আর আগেই পড়েছো, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ডাক পাঠানোর জন্য চাই ডাকটিকিট। তো বাংলাদেশেরও তো ডাকটিকিট চাই, তাইনা? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ডিজাইনার বিমান মল্লিক ডিজাইন করলেন মোটমাট ৮ টি ডাকটিকিট। আর সেই ৮টা টিকিট প্রকাশিত হলো ২৯ জুলাই ১৯৭১। বাংলাদেশের মানচিত্র, বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়াও আরো কয়েকটি মোটিফ ছিলো সেই টিকিটগুলোতো।


এবার এলো পোস্টকার্ডঃ
পৃথিবীর প্রথম স্ট্যাম্প বা ডাকটিকিটের নাম মনে আছে? ব্ল্যাক পেনি। ইংল্যান্ডের রাণীর ছবিওয়ালা এই ডাকটিকিট বসিয়েই থিওডোর হুক বলে এক লোক বানিয়েছিলো পৃথিবীর প্রথম পোস্টকার্ড। তবে সে কিন্তু এই পোস্টকার্ডটি বানিয়েছিলো স্রেফ মজা করে। পোস্টকার্ডটি সে পাঠিয়েছিলো নিজের ঠিকানাতেই। আর ছবি হিসেবে ছিলো পোস্টঅফিসের একটা ক্যারিকেচার, মানে কার্টুন আরকি!


তখনো কিন্তু পোস্টকার্ডগুলো এখনকার মতো হয়নি। খামের উপরে একটা ছবি এঁকে সেটাকেই পাঠানো হতো। বেশি আঁকা হতো কমিকস কিংবা মিউজিক্যাল ছবি। তখনো সরকারিভাবে পোস্টকার্ড বানানো শুরু হয়নি। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এরকম পোস্টকার্ড বানিয়ে বিক্রি করতো। পরে সরকারিভাবে পোস্টকার্ড বানানো শুরু হয়।

প্রথম হাঙ্গেরিতে সরকার পোস্টকার্ডগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর একে একে বিভিন্ন দেশে পোস্টকার্ডের চল শুরু হয়। আর প্রথম রঙিন পোস্টকার্ড বের করা হয় ১৮৮৯ সালে। এর আগে সব পোস্টকার্ডই হতো একরঙা।


এভাবে তো সত্যিকারের পোস্টকার্ডের চল শুরু হলো। পোস্টকার্ডের একপাশে সবাই অল্প করে কিছু লিখে পাঠাতেও শুরু করলো। তখন কার্ডগুলোর একপাশে শুধু ঠিকানা লেখা হতো। আরেকপাশে ছবিও থাকতো, আবার সেই পাশে আপনার যা লেখার তাও লিখতে হতো। এতে না ছবিটা সুন্দর থাকতো, না কথাগুলো মনমতো লেখা যেতো। খুবই সমস্যা। তখন বৃটিশরা প্রথম এই সমস্যা সমাধান করার জন্য নতুন ধরনের এক পোস্টকার্ড বের করলো। এই কার্ডের একপাশে থাকতো সুন্দর সুন্দর ছবি। আরেকপাশ দুই ভাগে ভাগ করা থাকতো। একপাশে ঠিকানা লিখতে হতো, আরেকপাশে যা লেখার তা লেখা হতো। এরপর একে একে ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকাসহ সব দেশগুলো পোস্টকার্ডের এই ফরম্যাটটাই মেনে নিলো। আর এই ফরম্যাটটাকে মানুষও এত্তো পছন্দ করলো! সবাই পোস্টকার্ড পাঠাতে শুরু করলো। কারণ, এতে যে অল্প করে চিঠিও লেখা যায়, আবার মনমতো একটা ছবিও পাঠানো যায়।


এরপর পোস্টকার্ডের যে নতুন ধরন আসলো, সেটার একটা খুব সুন্দর নামও দেয়া হয়েছে, ‘হোয়াইট বর্ডার কার্ডস’। এ সময় পোস্টকার্ডের ছবিগুলো আরো সুন্দর তো হলোই, সাথে পোস্টকার্ডগুলোতে বর্ডার দেয়াও শুরু হলো। সব পোস্টকার্ডের ছবিগুলোর চারপাশে সাদা রঙের বর্ডার দেয়া থাকতো। এরপর পোস্টকার্ডের কাগজেও পরিবর্তন আসলো। ব্যবহার করা শুরু হলো লিনেন কাগজ। ফলে পোস্টকার্ডগুলো আরো রঙিন আর উজ্জ্বল হলো।

আর চল্লিশের দশকে পোস্টকার্ডের কাগজ শেষবারের মতো পাল্টে গেলো। ব্যবহার করা শুরু হলো ফটোক্রোম পেপার। ব্যস, এবার কার্ডগুলো হলো যেমন সুন্দর, তেমনি চকচকে ঝকঝকে। এই কাগজের পোস্টকার্ডই কিন্তু আমরা এখনো ব্যবহার করছি।


আর পোস্টকার্ডগুলো যে শুধু কাগজেই তৈরি হয়, তা কিন্তু নয়। অনেক পোস্টকার্ড আবার কাঠ দিয়ে, প্লাস্টিক দিয়ে, চামড়া দিয়ে, সিল্ক দিয়ে, এমনকি বিভিন্ন ধাতু দিয়েও তৈরি করা হয়েছে! সেগুলো জমাতে পারলে কী দারুণ হতো, একবার চিন্তা করে দেখো! আর তার সাথে যদি থাকে দেশ বিদেশের রঙ বেরঙের হরেক রকম কতোগুলো ডাকটিকিট! উফ, ভাবতেই তো আমার কেমন খুশি খুশি লাগছে। কী, জমাতে ইচ্ছে করছে না ডাকটিকিট আর পোস্টকার্ড? আর এগুলো সম্পর্কে আরো জানারও কিন্তু বুদ্ধি আছে। আপনাকে সেজন্য সোজা চলে যেতে হবে পল্টনের ডাক বিভাগের অফিসে (জিপিও), সেখানে যে একটা আস্ত ডাক জাদুঘরই আছে!

লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

  1. Ami daaktikit,purono coin r note foreign note r coin,deshlai box collect Kori ..
    Egulo korte Amar khub bhalo lage

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এক কালে এই অভ্যাস আমার ছিল... কিন্তু কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে...

      মুছুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info