সে আজ থেকে প্রায় সোয়া তিনশত বছর আগের কথা। এখন ইউরোপের যে দেশটির নাম নেদারল্যান্ডস, সেই দেশের নাম তখন ছিলো হল্যান্ড। সেই দেশের ডেল্ফট শহরে থাকতেন এক বিজ্ঞানী, অ্যান্টনি লিউয়েনহুক। তিনি অবশ্য শুধুই বিজ্ঞানী ছিলেন না, ব্যবসাও করতেন।
আচ্ছা, বলেন তো, প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র কে বানিয়েছিলেন? গ্যালিলিও, ১৬১০ সালের দিকে। অনেকে অবশ্য বলেন, পৃথিবীর প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি বানানো হয়েছিলো আরো আগে। ১৫৯০ সালে নেদারল্যান্ডসের মিডেলবার্গের দুই চশমার কারিগর বানিয়েছিলেন সেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি। ভাবছেন, লিউয়েনহোয়েকের গল্প করতে করতে হঠাৎ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গল্প জুড়ে দিলাম কেন? কারণ, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের উন্নয়নে গ্যালিলিওর পরেই যার ভূমিকার কথা বলতে হয়, তিনিই লিউয়েনহুক। তার নিজের একটা শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিলো। তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি অবশ্য গ্যালিলিওর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো করে কাজ করতো না। ওনার অণুবীক্ষণ যন্ত্রটির সঙ্গে বরং কির্চার অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বেশ মিল ছিলো। কির্চা তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি বানিয়েছিলেন ১৬৪৬ সালে। লিউয়েনহুক তার অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে যে অনেক গবেষণা করতেন!
লিউয়েনহোয়েকের এক বিজ্ঞানী বন্ধু ছিলো, নাম রেইনার দি গ্রাফ। লিউয়েনহুক তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যে সব পরীক্ষা করতেন, সেই সব গবেষণার কথা এসে বলতেন গ্রাফের কাছে। এই "রেইনার দি গ্রাফ" কিন্তু বিজ্ঞানী ছিলেন। লন্ডনে বিজ্ঞানীদের এক অভিজাত সংগঠন "দি রয়াল সোসাইটি"। তিনি এই রয়াল সোসাইটির একজন সদস্য ছিলেন। গ্রাফ লিউয়েনহোয়েকের যে সব পরীক্ষা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো, সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন রয়াল সোসাইটিতে। কখনো হয়তো রয়াল সোসাইটি আরো বিশদ বিবরণ চেয়ে পাঠাতো। গ্রাফও বন্ধুর কাছ থেকে পরীক্ষার কথা আরো ভালোভাবে লিখিয়ে নিয়ে ফের চিঠি পাঠাতেন। লিউয়েনহোয়েকের এক মেয়ে ছিলো, নাম মারিয়া। মারিয়া তো বাবার পাগলামি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপরও সেদিন বাবার পাগলামি দেখে ও অবাক না হয়ে পারলো না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আর লিউয়েনহুক বারবার বৃষ্টির পানি ধরে ধরে পড়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী? কিছুক্ষণ পরে লিউয়েনহুক আর উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলেন না, মারিয়াকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন। ব্যাপারটা আসলেই অনেক বড়। লিউয়েনহুক সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের সন্ধান পেয়েছেন। যে জগতের কথা পৃথিবীর কোন মানুষ জানে না, সেই জগৎ খুঁজে বের করেছেন লিউয়েনহুক। মারিয়া গিয়ে দেখলো, বাবার অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির পানির ভেতর ছোট ছোট কী জানি সব কিলবিল করছে। কী কিলবিল করছে? আরকি, জীবাণু!
আরো বৃষ্টির পানি আনা হতে লাগলো। বারবার পরীক্ষা করতে লাগলেন লিউয়েনহুক। না, ঘটনা সত্যি। পানিতে আসলেই অসংখ্য জীবাণু কিলবিল করছে। কিন্তু এই জীবাণুরা বৃষ্টির পানিতে আসলো একমন করে? পরীক্ষা করতে করতে এক সময় দেখা গেল, পানি একদম পরিষ্কার। পানিতে কোন ধুলোবালিও নেই, কোন জীবাণুও নেই। তাহলে?
সেই পরিষ্কার পানি রেখে দেয়া হলো। চারদিন পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল, পানি ভর্তি ধুলোবালি আর জীবাণু। মানে পরিষ্কার, জীবাণুরা বৃষ্টির পানির সঙ্গে আকাশ থেকে পড়ে না, বরং ধুলোবালি আর ময়লার সংস্পর্শে জন্ম নেয়।
লিউয়েনহুক তো জীবাণু আবিষ্কার করে বসলেন, কিন্তু সে কথা তো পৃথিবীর মানুষকে জানানো দরকার। কিন্তু এমন পাগলাটে আবিষ্কারের কথা কে বিশ্বাস করবে? না জানলে আপনি কি বিশ্বাস করতেন? আপনি যে পানি খান, তাতে হাজার হাজার জীবাণু বাস করে? তিনি এবার তার বন্ধু গ্রাফের স্মরণাপন্ন হলেন। গ্রাফের মাধ্যমে জীবাণু সম্পর্কে তার সব গবেষণা সবিস্তারে লিখে পাঠালেন রয়াল সোসাইটিতে। চিঠি পেয়ে তো রয়াল সোসাইটিতেই হৈ চৈ পড়ে গেল। রয়াল সোসাইটি আরো বিশদভাবে ব্যাপারটা জানতে চায়। তাই তাদের লিউয়েনহোয়েকের অণুবীক্ষণ যন্ত্রটা দরকার। কিন্তু লিউয়েনহুক তো তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি কোনভাবেই হাতছাড়া করবেন না। তাহলে কী করা যায়? রয়াল সোসাইটি নিজেরাই একটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিলো। আর সেই দায়িত্ব দেয়া হলো রবার্ট হুককে। হুক তার সহকর্মীদের নিয়ে তৈরি করলেন একটা নিখুঁত অণুবীক্ষণ যন্ত্র। তারপর লেগে গেলেন জীবাণুদের জগতের সত্যতা নির্ণয় করতে। রবার্ট হুক ও তার সহকর্মীদের সেসব পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করার জন্য রয়াল সোসাইটির এক বিশেষ সভা ঘোষণা করা হলো, ১৬৭৭ সালের ১৫ নভেম্বর। গুরুগম্ভীর পরিবেশে শুরু হলো সভা। আর তাতে রবার্ট হুক ঘোষণা করলেন, লিউয়েনহুক জীবাণুদের যে জগতের কথা বলেছেন, তা সত্যি।
রয়াল সোসাইটি শুধু লিউয়েন হুকের এই আবিষ্কারই মেনে নিল না, তাকে সোসাইটির সদস্যও করে নিল। একটা রূপার কৌটায় সমিতির মানপত্র পৌঁছে গেল লিউয়েন হুকের ঠিকানায়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন লিউয়েন হুক। এমনকি তার গবেষণাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তখনকার রাশিয়ার জার বা সম্রাট পিটার দি গ্রেট। পরে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের রানীও। এরপরে তার আবিষ্কৃত জীবাণুলোক নিয়ে গবেষণা করে বিখ্যাত হয়েছেন অনেক বিজ্ঞানী। তাদের কয়েকজনকে আপনারাও চেনেন। লুই পাস্তুর, রবার্ট কুক, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তাদের সবার গবেষণার মূলেই আছে লিউয়েন হুকের জীবাণুলোক আবিষ্কার।
কি, জীবাণুদের জগৎ আবিষ্কারের গল্প শুনে কেমন লাগছে?
লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার ইচ্ছা
উত্তরমুছুনছিল আজ জানতে পারলাম
ধন্যবাদ :-)
কিছু জানাতে পেরেছি যেনে খুশি হলাম :)
মুছুনআপনার মন্তব্য লিখুন...পোষ্ট খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন