AK-47 এর ইতিহাস ।। History Of AK-47


প্রথমে AK-47 এর নাম করন নিয়ে আসি। "A" আসে রাশিয়ান শব্দ "Avtomat" থেকে যার বাংলা মানে "স্বয়ংক্রিয়" আর "K" আসে এই অস্ত্রের প্রস্তুত কারক "Kalashnikov" (কালাশনিকভ) এর নাম থেকে, আর "47" আসে এই অস্ত্রের প্রস্তুত সাল থেকে অর্থাৎ "1947" সালকে কেন্দ্র করে। এই সবগুলি মিলে এই অস্ত্রের নামকরন করা হয় "AK-47"।

একে ৪৭ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এটি একটি গ্যাস পরিচালিত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এর ডিজাইনার রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) মিখাইল কালাশনিকভ। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটিরও অধিক এই অস্ত্র বিক্রি হয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ টিরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে এটি ব্যাবহৃত হচ্ছে। যা কিনা দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় রাইফেল। একে ৪৭ এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন এর সহজ ব্যবহার, নির্ভরতা ও রক্ষানাবেক্ষন ইত্যাদি। এটাকে বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক রাইফেল বলা হয়। ১৯৫১ সাল থেকে এখনও এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সৈন্যদের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটি জলে ভিজিয়ে, ধুলাতে রেখে বা এর উপর দিয়ে রাস্তা মেরামতের রোলার চালানোর পরও এটিকে আগের মতই ব্যাবহার করা যায়, যা এর সমপর্যায়ের অন্যান্য অস্ত্রের ক্ষেত্রে অসম্ভব।

বিশ্বের প্রথম একে ৪৭
একে ৪৭ এর অন্যতম বৈশিষ্ট হল এর বুলেট এর মারাত্বক ভেদন ক্ষমতা, এটি ৭.৬২*৩৯ মিঃমিঃ বুলেটকে ৭১৫ মিটার/সেকেন্ডে ছুড়ে যা ৮ ইঞ্চি কাঠ এবং ৫ ইঞ্চি কনক্রিট ভেদ করতে পারে। এছাড়া এতে কষ্টমাইজ বুলেট ব্যবহার করা যায়। এতে সিঙ্গেল শট, ব্রাস্ট অব ফায়ার এবং গ্রেনেড ছুড়ার সুবিধা আছে । নির্ভরতার দিক দিয়ে আজও একে ৪৭ অনন্য। একে ৪৭ এ কখনো ব্যাক ফায়ার হয় না। এটিকে দুনিয়ার যেকোন স্থানে ব্যবহার করা যায়। তীব্র শীত, গরম, ভেজা আবহওয়াতেই এর কিছু হয় না। অন্যান্য রাইফেলের তুলনায় একে ৪৭ জ্যাম হবার রেটও কম। বর্তমান বিশ্বের সব দেশই একে ৪৭ বা এর বিভিন্ন সংস্করনের রাইফেল ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে একে ৪৭ এর চাইনিজ সংস্করন টাইপ ৫৬ ব্যবহৃত হয়।

মিখাইল কালাশনিকভ, ১৯৪৯
কালাশনিকভের পূর্ণ নাম মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। তিনি সাবেক সোভিয়েট সেনাবাহিনীর একজন লে. জেনারেল। ১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর সাইবেরিয়ার আলতাই অঞ্চলে কুরিয়া নামে একটি গ্রামে কৃষক পরিবারে তার জন্ম। তিমোফেল ও আলেকসান্দ্রা কালাশনিকভ দম্পতির তিনি সপ্তদশ সন্তান। ১৯৩৮ সালে তিনি সোভিয়েট রেড আর্মিতে যোগদান করেন। ২৪ তম ট্যাংক রেজিমেন্টের সিনিয়র ট্যাংক কমান্ডার হিসাবে পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৪১ সালের অক্টোবরে ব্রায়ানস্কে তিনি জার্মান বাহিনীর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। আহত হওয়ায় তিনি ৬ মাস ছুটিতে ছিলেন। ছুটিতে থাকা কালে একটি নয়া কারবাইন তৈরির ধারণা তার মাথায় আসে। নিজের ধারণাকে কাজে লাগাতে তিনি মাতাই অস্ত্র কারখানায় যান। কর্তৃপক্ষ তাকে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দেয়। তিনি আমেরিকান এম-১ এবং জার্মান এসআইজি-৪৪ এর ডিজাইনের সর্বোত্তম কৌশলের সমন্বয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৪ সালে তিনি একটি কারবাইনের ডিজাইন তৈরি করেন। যৌবনে ইজভেস্ক অস্ত্র কারখানায় ডিজাইন নিয়ে ব্যস্ত মিখাইল কালাশনিকভ। কিন্তু তার ডিজাইন কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি। তবে ব্যর্থ হলেও তিনি দমে যাননি। ১৯৪৬ সালে তার উদ্ভাবিত একে ৪৭ রাইফেলের পূর্ববর্তী সংস্করণ "একে ৪৬"। সরকারিভাবে সামরিক বাহিনীতে পরীক্ষা করা হয়। ১৯৪৭ সালে রেড আর্মির কয়েকটি নির্দিষ্ট ইউনিটে তার রাইফেল গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৯ সালে প্রতি মিনিটে ৬ শত গুলিবর্ষণে সক্ষম তার উদ্ভাবিত রাইফেল সোভিয়েট সেনাবাহিনীতে পূর্ণমাত্রায় চালু করা হয়।

M-16
দুই বছরের মধ্যে একে ৪৭ সোভিয়েট সেনাবাহিনীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সে সময় থেকে এ রাইফেল সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি অন্যতম রপ্তানি সামগ্রীতে পরিণত হয়। একে ৪৭ রাইফেল অত্যন্ত কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য হওয়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এম ১৬ রাইফেল ফেলে দিয়ে এ অস্ত্র গ্রহণ করে।

এ পর্যন্ত এক কোটির বেশি একে ৪৭ রাইফেল নির্মাণ করা হয়েছে। ৫০টির বেশি দেশ এবং অসংখ্য গেরিলা গ্রুপ এ অস্ত্র ব্যবহার করছে। তবে সাবেক ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশ গুলোতে পাইরেসি হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতি হয় ২ শত কোটি ডলার। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সোভিয়েট যুগে একে ৪৭ রাইফেলের প্যাটেন্ট সংরক্ষণ না করায় কালাশনিকভ আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১৯৯১ সালে স্বত্ব সংরক্ষণ করার আইনি লড়াইয়ে তিনি হেরে যান। ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি উদমার্টিয়ার ইজভেস্কে বসবাস করছেন। ৭ দশমিক ৬২ এমএম ক্যালিবারের এ রাইফেল উদ্ভাবনের জন্য তিনি স্টালিন মেডেল লাভ করেন।

স্টালিন মেডেল
ও আরো একটি কথা, উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ এখনো জীবিত। গত ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর জন্মদিনে রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ তার হাতে "হিরো অব রাশা" পদক তুলে দেন। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে কালাশনিকভ নিজের লেখা একটি দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি করেন। বর্তমানে তার বয়স ৯১ বছর। এ বয়সেও তিনি প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮ টায় ইজভেস্ক অস্ত্র কারখানায় কাজ করতে যান। এ অস্ত্র কারখানায় তিনি কালাশনিকভ রাইফেলের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন। প্রধান অস্ত্র ডিজাইনার হিসাবে সপ্তাহে তিনি চারদিন কাজ করেন। আরেকটি অজানা বিষয় মারণাস্ত্রের জনক কালাশনিকভ একজন সৌখিন কবি।


বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ডিজাইনের একে ৪৭ রাইফেল পাওয়া যায়। কিন্তু সব গুলি কিন্তু রাশিয়ার তৈরি না। বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার এই অস্ত্র অন্যান্ন দেশের হাতে পরায় এবং তারা এই অস্ত্রের কার্যক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে নিজেরাই এই অস্ত্র বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে যার ফলে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের একে ৪৭ এর দেখা মেলে। এদের মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় হাংগেরিয়ান একে ৪৭।

হাংগেরিয়ান AMD-65 ভার্সনের AK-47
১৯৫৬ সালে রাশিয়া আর হাংগেরির মধ্যেকার যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হলে, হাংগেরিয়ানদের হাতে সর্ব প্রথম এই অস্ত্র আসে, আর এর পর থেকে তারা নিজেরাই এই অস্ত্র বানাতে থাকে। আর বলাই বাহুল্য যে, রাশিয়ানদের তুলনায় বর্তমানে হাংগেরিয়ানদের AMD-65 ভার্সনের একে ৪৭, বর্তমান বাজারে রাশিয়ান একে ৪৭ থেকে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু এই জনপ্রিয়তায় ভাগ বসায় চায়না।

চাইনিজ একে ৪৭
১৯৮৮-১৯৮৯ সালের মধ্যে প্রথম চায়না তার AKS-762 ভার্সনের একে ৪৭ বানানো শুরু করে। খুব কম দাম হওয়ায় আর কার্যক্ষমতা অন্যান্ন একে ৪৭ এর মত হওয়ার কারনে খুব সহজেই এটি তারাতারি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আর বিগত বছর গুলি ধরে এটি বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় একে ৪৭। বেশি না ব্লাক মার্কেট থেকে ২৭০ থেকে ৩০০ ডলারের বিনিময়ে আপনি চাইনিজ একে ৪৭ কিনতে পারবেন।

কার্যপ্রনালি
একে ৪৭ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ১৯৮৩ সালে মোজাম্বিক তাদের জাতীয় পতাকায় একে ৪৭ ব্যাবহার করা শুরু করে।

মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকা
একে ৪৭ যদিও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের জগতে বৈপ্লব ঘটিয়েছিল কিন্তু এর ব্যাবহার যুদ্ধ ক্ষেত্রে যতটা না হয় তার থেকে বেশি ব্যাবহৃত হয় অন্যায় কাজের জন্য। আমেরিকায় এপর্যন্ত যত ব্যাংক ডাকাতি, স্কুলে অস্ত্রধারির আক্রমন সহ সকল মাফিয়াদের কাছে এই একে ৪৭ এর বহুল ব্যাবহার পাওয়া যায়। এছাড়া সারা বিশ্বে সব থেকে ব্লাক মার্কেটে বিক্রিত অস্ত্র এই একে ৪৭। জংগি সংগঠন গুলির কাছেও এই একে ৪৭ সব থেকে জনপ্রিয় অস্ত্র।

AK-12
১৯৪৭ সাল থেকে যে একে ৪৭ যাত্রা শুরু করেছিল তার এই পথ যাত্রা থামাবার জন্য রাশিয়ানরা ২০১২ সালে আরেকটি অস্ত্র বাজারে আনে, যার নাম "একে ১২"। এটি বর্তমানে রাশিয়ান আর্মিদের মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহৃত হয়, আর একে ৪৭ এর বিকল্প হিসেবে। একে ৪৭ মূল সমস্যা ছিল এর লক্ষ্য ভেদ (Target) করার ক্ষমতা অন্যান্য স্বংক্রিয় রাইফেলের তুলনায় কম কিন্তু এই একে ১২ রাইফেলে সেই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। এটি একে ৪৭ এর মত কার্যকর আবার লক্ষ্য ভেদ করতে অন্যান্ন যে কোন স্বংক্রিয় রাইফেলের থেকে বেশি কার্যকর। ২০১৩ সালের মধ্যে এটি সাধারন জনগনের ক্রয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তবে এবার রাশিয়া এর প্যাটেন্ট নিজেদের নামে রেখেছে ফলে এই অস্ত্র অন্য কোন দেশ বানাতে পারবে না বর্তমানে একে ৪৭ এর মত।

অচিরেই আরেকটি মৃত্যু অস্ত্র আসতে যাচ্ছে।

লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info