পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম ক্রুজ শিপ "ওয়েসিস অফ দ্যা সিজ"

টাইটানিকের সেই বিয়োগান্তক ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। একসময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিলো এই টাইটানিক। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথম যাত্রাতেই সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী জাহাজটি ডুবে গিয়েছিলো। প্রথম সমুদ্র যাত্রাতেই মধ্যরাতে এক সুবিশাল ডুবে থাকা বরফখন্ডের সঙ্গে ধাক্কায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলো তা আটলান্টিকের অতলান্তিক গভীরতায় অথচ এর ক্যাপ্টেন যাত্রা শুরুর সময় বেশ গর্ব করেই বলেছিলেন, "টাইটানিক কোনোদিনও ধ্বংস হবার নয়। এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরও এর কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারবেন না।" অনেকে তার এই দাম্ভিক উক্তিকেই টাইটানিক ডুবে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সেই ঘটনার প্রায় এক শতাব্দী পরে এবার নির্মিত হলো পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম ও বিলাসবহুল ক্রুজ শিপ "ওয়েসিস অফ দ্য সিজ"। সাগরের তো আর মরুদ্যান হয় না! একে বরং বলা যেতে পারে সাগরের বাগান কিংবা ভেসে থাকা সমুদ্র বাগান। নির্মাতা রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে আড়াই বছর সময় নিয়ে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। জানা গেছে, বিলাসবহুল এই জাহাজ আকারে টাইটানিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি বড়। এতোদিন পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ জাহাজ হিসেবে খ্যাত ছিলো ইনডিপেন্ডেন্স/ফ্রিডম অফ দ্যা সিজ যার তুলনায় ওয়েসিস অফ দ্যা সিজ পাক্কা ৭৫ ফুট বেশি লম্বা।



নির্মাণঃ
ওয়েসিস অফ দ্য সিজ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ফিনল্যান্ডে, ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এটি নির্মাণের অর্ডার দেয় রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল। প্রায় আড়াই বছর পর গত ২৮শে অক্টোবর জাহাজটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং জাহাজটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ানের কাছে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। ইতিহাসের বৃহত্তম এই জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে নামকরণ থেকে প্রতিটি স্তরে রয়েছে চমকপ্রদ সব তথ্য। নির্মাণ শুরুর আগে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান "নেম দ্যাট শিপ" নামের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলো। প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৯১ হাজার নাম সংগৃহীত হয়। এই বিপুল সংখ্যক নাম থেকে বেছে অবশেষে মিশিগানের জর্জ ওয়েজারের পাঠানো ওয়েসিস অফ দ্য সিজ এবং অ্যালিউর অফ দ্য সিজ নাম দু'টো নির্বাচন করা হয়। উল্লেখ্য, অ্যালিউর অফ দ্যা সিজ আবার ওয়েসিস অফ দ্যা সিজেরই অতিরিক্ত অংশ যা এখনো নির্মাণাধীন রয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে দু'টো জাহাজকেই একসঙ্গে জুড়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান। ওয়েসিস অফ দ্য সিজ লম্বায় সর্বমোট ১,১৮৭ ফিট এবং এর ওজন ২ লক্ষ ২৫ হাজার ২৮২ গ্রস টন।


বৈশিষ্ট্যঃ
ওয়েসিস অফ দ্য সিজ এর বৈশিষ্ট্যগুলো শুনলে চোখ ছানাবড়া হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইতিহাসের বৃহত্তম এই জাহাজে রয়েছে সর্বমোট ১৬টি ডেক, ২,৭০০টি সুসজ্জিত কক্ষ (স্টেয়ার রুম বা কেবিন) এবং ৬,৩০০জন যাত্রী এবং ২,১০০জন ক্রুর ধারণ ক্ষমতা। জাহাজের বৈশিষ্টগুলোকে সর্বমোট ৭টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক, পুল, ফিটনেস সেন্টার, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি।

ওয়েসিস অফ দ্য সিজ সর্বমোট ২০ তলাবিশিষ্ট জাহাজ, যা নিচু কোনো ব্রিজের নিচ দিয়ে যাবার সময় প্রয়োজনে গতিবেগ বাড়িয়ে পানিতে পুরো জাহাজের অবস্থান আরো নিচু করে ফেলতে পারে। ডেনমার্কের দি গ্রেট বেল্ট ব্রিজের উচ্চতা ওয়েসিস অফ দ্য সিজের চেয়ে মাত্র ১ ফুট বেশি। অথচ খুব সহজেই গতি বাড়িয়ে ওয়েসিস অফ দ্য সিজ অতিক্রম করেছে এই সেতু।

ওয়েসিস অফ দ্য সিজে রয়েছে একটি পার্ক বা উদ্যান, যেখানে ১২ হাজার গাছের চারা এবং ৫৬টি গাছ রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই প্রথম ভাসমান উদ্যান।

জাহাজের পেছনের অংশে রয়েছে ৭৫০টি আসনসমৃদ্ধ থিয়েটার যার মধ্যে রয়েছে সুইমিং পুল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাহাজের এই জায়গাটি দিনে ব্যবহৃত হয় সুইমিং পুল হিসেবেই অথচ রাতে ব্যবহৃত হয় সাগরের একটি থিয়েটার হিসেবে।

কেবিন বা থিয়েটার ছাড়াও জাহাজের প্রায় প্রতিটি অংশেই রয়েছে অসংখ্য বার, পোশাক ও বিভিন্ন দ্রব্যাদির দোকান আর রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও রয়েছে ভলিবল কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, চারটি বিশালাকৃতির সুইমিং পুল, জাহাজে আরো রয়েছে ইয়থ জোন, যেখানে আছে কম্পিউটার গেমিং ও সাইন্স ল্যাবরেটরিসহ নানান আকর্ষণীয় বিষয়, থিম পার্ক এবং বাচ্চাদের জন্য বিশেষ নার্সারি ও খেলাধূলার স্থান। আর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর জন্য সুদৃশ্য জায়গা তো আছেই।

বিলাসবহুল এই জাহাজে ভ্রমণের জন্য টিকিট মূল্য সর্বনিম্ন ১,২৯৯ ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪,৮২৯ ডলার পর্যন্ত।
আরো কিছু তথ্য,

বিনোদনঃ
জাহাজেই থাকছে ৪০জন পেশাদার মঞ্চ অভিনেতা। জাহাজের দুটি থিয়েটারে এরা রাতের অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন। এর একটি হবে ব্রডওয়ে স্টাইলের থিয়েটার। অপরটি হবে অপেক্ষাকৃত রোমাঞ্চকর অ্যাকুয়া থিয়েটারের। দুটি উইন্ডশিল্ড দিয়ে এটিতে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম আবহাওয়া। ১,৯৭২টি সূক্ষ্ম নল দিয়ে কনসার্ট হলে পানি স্প্রে করে তৈরি করা হবে স্বর্গীয় পরিবেশ। সঙ্গে অসংখ্য স্পটলাইটের কারসাজি তো রয়েছেই।

গ্রিডঃ
ভাসমান এই নগরীতে থাকছে একটি পুরোদস্তুর ইলেকট্রিক কোম্পানি। ইঞ্জিন থেকে আইস কিউব পর্যন্ত সবকিছুর প্রাণই হলো ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ দিয়ে এক লাখ বাড়ির চাহিদা মেটানো সম্ভব। এর ভেতর অবস্থিত ইলেকট্রিক তার আমেরিকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টানা সম্ভব।

তীক্ষ্ণ নজরঃ
২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রুজ শিপ থেকে নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় ৩০ জন। হারিয়ে যাওয়া ওই হতভাগ্যদের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সব সূত্র। এমন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে ওয়েসিস অফ দ্য সিজে না ঘটে, এ জন্য জাহাজের বিভিন্ন অংশে ১২৫০ টি সিসিটিভি ক্যামেরা সর্বক্ষণ নজর রাখবে চারপাশে।


সমালোচনাঃ
ইতিহাস তৈরী করেছে যে জাহাজ তাকে নিয়ে আবার খুব একটা খুশি নন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, জাহাজটি বায়ূ দূষণের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু করছে না বরং যে কোনো রিসোর্টের চেয়ে অধিক জ্বালানী খরচ করছে, যা মোটেই পরিবেশ বান্ধব নয়। অবশ্য এ কথার জবাবও দিয়েছে জাহাজের নির্মাতা ও প্রকৌশলীরা। তারা জানিয়েছেন, পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন দিক বিবেচনায় রেখেই জাহাজের নকশা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও যতোটা ধারণা হচ্ছে, ওয়েসিস অফ সিজ আসলে পরিবেশের জন্য ততেখানি অপকারী নয়। জাহাজের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে তা সমুদ্রের পানিতে না যায়। প্রকল্প প্রকৌশলী মিকো ইলাস জাহাজের নির্মাণস্থল তুর্কু ইয়ার্ডে বলেন "ওয়েসিস অফ দ্যা সিজ এযাবৎ কালের সর্বাধিক পরিবেশবান্ধব জাহাজ যার পরিবেশ দূষণ রোধের ক্ষমতা এ ধরনের অন্য যে কোনো জাহাজের তুলনায় অনেক অনেকগুণ বেশী।"


যাত্রাঃ
ফিনল্যান্ডে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ওয়েসিস অফ দ্য সিজ ২০০৯ এর ১৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেলে এসে পৌঁছায়। এখানে জাহাজে ১২,০০০ টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপন করা হয় এবং খুঁটিনাটি আরো কিছু কাজকর্ম সম্পন্ন করা হয়। জানা গেছে, আগামী ৫ই ডিসেম্বর এই ভাসমান বিস্ময়ের প্রথম যাত্রা শুরু হবে এই একই বন্দর থেকেই।

প্রায় এক শতাব্দী পর টাইটানিকের মতোই বেশ ধুমধামের সঙ্গেই যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে ওয়েসিস অফ দ্যা সিজ। তবে এবারও এর ভাগ্যে টাইটানিকেরই মতোই পরিণতি লেখা রয়েছে কী না ওয়েসিস অফ দ্যা সিজের কপালে, তা কেউ না জানলেও টাইটানিকের দূর্দশা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওয়েসিস অফ সিজের ক্যাপটেন হয়তো গর্ব করে কিছু বলেননি। তবুও জাহাজের ইতিহাসের বিস্ময়কর সৃষ্টি ওয়েসিস অফ দ্যা সিজের আসন্ন যাত্রার দিকে তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্বই।

লেখকঃ মোঃ আমিনুল ইসলাম সজীব।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info