পৃথিবীর প্রথম নারীর মহাকাশজয়


পৃথিবীর কোনো মানুষ হিসেবে মহাকাশে যাওয়ার ব্যাপারটি যেন স্বপ্নের মতোই। মহাশূন্যে ভ্রমণকারী অনেক পুরুষের সঙ্গে নারীরাও আছেন। এখন পর্যন্ত অসংখ্য নারী গিয়েছেন মহাকাশ ভ্রমণে। তবে প্রথম যিনি মহাকাশে গিয়েছেন, তার অবদান অবিস্মরণীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন পৃথিবীর মহাকাশজয়ী নারী হিসেব প্রথম নাম লেখান ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা।

তেরেস্কোভার জন্ম ১৯৩৭ সালের ৬ মার্চ, রাশিয়ার ছোট্ট একটি গ্রাম মাসলেননিকোভায়। তার বাবা ছিলেন একজন ট্রাক্টর চালক আর মা কাপড়কলের একজন শ্রমিক। আট বছর বয়সে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্কুল ছেড়ে টায়ার কারখানায় কাজ শুরু করেন। করেসপন্ডেস কোর্সের মাধ্যমে পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিল তার প্যারস্যুট ঝাঁপের প্রতি বিশেষ আগ্রহ।

বুকোভস্কোই এয়ারফোর্স একাডেমি থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালের ২১ মে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি প্রথম প্যারাস্যুট নিয়ে ওড়েন। প্যারস্যুটে ওড়ার ক্ষমতা তাকে প্রথম নারী হিসেবে মহাশূন্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। সেদিন সোভিয়েত রাশিয়া স্পুতনিক-১ নামের কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠানোর মধ্যে দিয়ে সূচনা করে মহাকাশজয়ের। ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর রাশিয়া মহাকাশ অভিযানে লাইকা নামের একটি কুকুরকে পাঠায়। লাইকাই পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা প্রথম প্রাণী। এরপর ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে নিরাপদে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত মহাকাশ জয়ে নারীর কোনো অবদান ছিল না।


এপ্রিল মাস। চারদিকে তখন হইচই আর আলোচনা। দেশে বিদেশে একই কথা। ইউরি গ্যাগারিন নামের ২৭ বছর বয়সী এক যুবক মহাকাশ জয় করেছেন। পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে এক ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ভেসেছেন তিনি।

খবরটা শুনে রাশিয়ার মাসলেননিকোভা গ্রামের এক মা তার মেয়েকে বললেন, “ছেলেরা তো মহাকাশের অভিজ্ঞতা নিয়ে এল, এবার নিশ্চয়ই মেয়েরা যাবে।”

ঘরে তার ২৪ বছর বয়েসী এক তরুণী মেয়ে। মায়ের কথা কানে এসে বিঁধল মেয়েটির। ঠিক কানে নয় যেন বুকে এসেই বিঁধল। তারপর গিয়ে মিশল স্বপ্নে। ধ্যান জ্ঞানই যেন তার হয়েছিল সেই মহাকাশে যাওয়া। কোনো একদিন একটি মেয়ে যদি আকাশ জয় করে, তবে সেই মেয়েটি হব আমি, এমনই এক স্বপ্ন বাসা বাঁধল তার মনে।

এরই মধ্যে রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা থেকে ঘোষণা হল, বিশ্বের প্রথম নারী হিসেবে একজনকে মহাকাশ ভ্রমণে পাঠানো হবে। এ জন্য আবেদনপত্র আহবান করা হল। চার শতাধিক আবেদনকারীর মধ্যে মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে মহাকাশ ভ্রমণকারী হিসেবে নির্বাচিত হলেন ভ্যালেন্তিনা। আর সুযোগ পেলেন প্রথম নারী এবং প্রথম বেসামরিক হিসেবে মহাশূন্য ভ্রমণের।


ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা। মানুষের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তার পুরো নাম ভ্যালেন্তিনা ভ্লাদিনিরোভনা তেরেস্কোভা। মহাকাশ অভিযানে প্রথম সফল নারী নভোচারী। মহাকাশ অভিযানের প্রথম যুগেই এই মহীয়সী নারী ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন রাশিয়ার মহাকাশযান ভোস্তক ৬ এ চড়ে পৃথিবীর প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশজয় করেন। ১৯৬৩ সালের ১৬ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত তিন দিনে তিনি প্রায় ৪৮ বার পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণ শেষে মাটিতে অবতরণ করেন। তেরেস্কোভা মোট ৭০ ঘণ্টা ৫০ মিনিট অর্থাৎ দুই দিন ২২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট মহাশূন্যে অবস্থান করেন। তার এই সাফল্য নারী জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। মাত্র ২৬ বছর বয়সে মহাকাশজয় করে সৃষ্টি করেন গৌরবময় এক ইতিহাস। কেবল পুরুষই নয়, ইচ্ছা, বুদ্ধি ও সাহস থাকলে নারীরাও জয় করতে পারে অসীম মহাকাশকে। আর এর মধ্যে দিয়ে মহাকাশজয়ে নারীদের অংশ গ্রহণ শুরু হয়। এরপর নারী মহাকাশচারীরা মহাকাশে গিয়েছেন এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।


তেরেস্কোভার বাবা ছিলেন কৃষক পরিবারের একজন ট্রাক্টর চালক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা নিহত হলে তার জীবনে নেমে আসে এক কঠিন সময়। কিন্তু তিনি এত প্রতিক‚লতা ও দুঃখ কষ্টের মধ্যেও কঠিন সাধনায় নিজেকে গড়ে তোলেন। একে একে স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অতঃপর মহাকাশ জয়ে মনোনিবেশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন দক্ষ প্যারাস্যুট জাম্পার হয়ে ওঠেন। তার এই প্রতিভার সুবাদেই দুঃসাহসী মহাকাশযাত্রায় নভোচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তেরেস্কোভা রাশিয়ান সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা লাভ করেন এবং নারী জাতির জন্য আজও প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন।

সম্প্রতি ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা ৭৭ বছরে পা রেখেছেন। কিন্তু এ বয়সেও তিনি মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। রহস্যময় মঙ্গল গ্রহটি তার প্রিয় গ্রহ। আর তিনি সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও কাজ করেছেন। খ্যাতিমান এই মহাকাশচারীর মতে, মানুষ মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অনেক। মঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছাটা পৃথিবীর প্রথম মহাকাশজয়ী নারীর এতই প্রবল যে তিনি বলেছেন, আমি একবার মঙ্গলে যেতে চাই। যদি ফেরার সুযোগ না থাকে, তবুও!

লেখকঃ শামস্ নূর।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info