আচ্ছা বর্তমান সভ্যতা কি আপনা আপনি এসেছে? না মোটেও আপনা আপনি আসে নাই। এই বর্তমান উন্নত যুগ এসেছে শত শত বছর ধরে অনেক মানুষের অনেক আবিস্কারের হাত ধরে। যে আবিস্কার গুলি প্রতি নিয়ত আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে। এই আবিস্কারের জন্যই আমরা আজ এতটা উন্নত হয়েছি। কিন্তু আবিস্কার গুলি কারা করেছে আর কে কোন জিনিষ আবিস্কার করেছে তা আমরা অনেকেই জানি না। যারা জানি না বা জানতে আগ্রহী এই লেখা তাদের জন্য। আজ আমরা জেনে নিব কিছু ব্যাক্তির কথা যারা তাদের মেধা, শ্রম এমনকি জীবন দিয়েও যারা পৃথিবীকে করেছেন আলোকিত। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
স্যার আইজ্যাক নিউটনের একটা কথা দিয়েই শুরু করি, "পৃথিবীর মানুষ আমাকে কি ভাবে জানিনা কিন্তু নিজের সম্মন্ধে আমি মনে করি আমি একটা ছোট ছেলের মত সাগরের তীরে খেলা করছি আর খুঁজে ফিরেছি সাধারণের চেয়ে সামান্য আলাদা পাথরের নুড়ি বা ঝিনুকের খোলা।সামনে আমার পড়ে রয়েছে অনাবিষ্কৃত বিশাল জ্ঞানের সাগর।"
৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বে থ্রেসের স্তাজেইরা শহরে(গ্রিক উপনিবেশ) অ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ছিলেন বিজ্ঞানী, কবি, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং একজন সার্থক শিক্ষক। তিনিই প্রথম প্রাণী ও উদ্ভিদের মূল গঠনের কথা উল্লেখ করেন। প্রাণীদের সম্মন্ধে তিনি "Historia animalium" নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আধুনিককালে যাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞান বলা হয় তা একসময় ছিল প্রাকৃতিক দর্শন। প্রাকৃতিক দর্শনকে বলা যায় আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্বসূরী। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে শুরু করে অনেক বড় সকল বস্তুর গঠন এবং কার্যকারিতা নিয়ে জ্ঞানের এই শাখায় আলোচনা করা হতো। মার্টিন হাইডেগার লক্ষ্য করেছিলেন যে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল প্রকৃতি নামক ধারণাটির জনক এবং এই ধারণাটিই মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগের পত্তনের পূর্ব পর্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। তিনি বলেন, "এরিস্টটলের ফুজিকোস আক্রোয়াসেওস (ইংরেজিতে যে বইটি Physics নামে পরিচিত, আক্ষরিক অনুবাদ "প্রকৃতি বিষয়ক বক্তৃতামালা") গ্রন্থটি মূলত একটি বক্তৃতা যাতে তিনি এমন সব বস্তু নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন যারা নিজে থেকেই উদ্ভূত হয়। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝাই তার সাথে এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যার অনেক পার্থক্য। এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা প্রাচীনকালের বিষয় আর আধুনিক ভৌত বিজ্ঞানসমূহ আধুনিক যুগের বিষয়। এই পার্থক্যের চেয়েও বড় পার্থক্য হচ্ছে এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা ছিল দর্শন, যেখানে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান একটি ইতিবাচক বিজ্ঞান যা একটি দর্শনকে প্রথমেই সত্য বলে ধরে নেয়। এরিস্টটলের পদার্থবিদ্যা না থাকলে গালিলেওর জন্ম হতো না।" ৩২২খ্রিস্টপূর্বে এই মহান বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।
আর্কিমিডিসঃ
খ্রিস্টপূর্ব ২৮৭ সালে সিসিলি দ্বীপপুন্জের অন্তর্গত সাইরাকিউস দ্বীপে (গ্রীস) আর্কিমিডিস জন্মগ্রহন করেন। তিনি বলবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান রাখেন। তরলে ভাসমান বস্তুর তত্ত্ব আবিস্কারের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। সূত্রঃ "কোন বস্তুকে তরল পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করলে বস্তুটি কিছু ওজন হারায়। বস্তুর এই আপাত হারানো ওজন বস্তুটি দ্বারা অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান।" এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর্কিমিডিসের সূত্র নামে পরিচিত। আর্কিমিডিসের আরেকটি আবিষ্কার পুল ও লিভার। এই আবিষ্কারের ফলে বড় বড় পাথর, ভারী জিনিস, কুয়া থেকে জল তোলার কাজ সহজ হল। একবার আর্কিমিডিস গর্ব করে বলে ছিলেন, "আমি যদি পৃথিবীর বাইরে দাঁড়াবার একটু জায়গা পেতাম, তবে আমি আমার এই লিভার পুলির সাহায্যে পৃথিবীটাকেই নাড়িয়ে দিতাম।" আর্কিমিডিস ২১২খ্রস্টপূর্বে মৃত্যবরণ করেন।
|
জাবির ইবনে হাইয়ান |
এই মহান মুসলিম বিজ্ঞানী ৭২২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি বস্তুজগৎকে মূলত তিনভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু আর তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ রাখেন। তার এই আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বস্তজগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। যথা বাষ্পীয়, পদার্থ এবং পদার্থ বহির্ভূত। তিনি প্রথম উদ্বায়ী পদার্থসমূহের ধারণা দেন। জাবির ইবনে হাইয়ানই সর্বপ্রথম নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম যে 'একোয়া রেজিয়া' এটিও তার প্রদত্ত। তিনি ৮০৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
|
আল বাত্তানী |
৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বাত্তান নামক স্থানে আল বাত্তানী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ এবং একজন জ্যোতির্বিদ। তিনিই সর্বপ্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়েছিলেন যে এক সৌর বছরে ৩৬৫দিন ৫ঘন্টা ৪৬মিনিট ২৪সেকেন্ড হয়। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে সূর্যের আপাত ব্যাসার্ধ বাড়ে ও কমে। সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ সম্মন্ধেও তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। আল বাত্তানী তার নিজস্ব উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে সূর্য তার নিজস্ব কক্ষপথে গতিশীল। এই মহান মনীষী ৯২৯খ্রিস্টাব্দে ৭২বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
|
আল ফারাবী |
আল ফারাবী ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিস্তানের অন্তর্গত ফারাব নামক শহরের নিকটবর্তী আল ওয়াসিজ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম 'শূন্যতা' এর অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। এই মনীষী ৯৫৬খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
|
আল বেরুনী |
আল বেরুনী ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর খাওয়ারিজমের শহরতলীতে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, জীবতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, গণিত, ন্যায়শাস্ত্ত্র, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী। কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বেই আল বেরুনী বলেছেন, "বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘুরে।" তিনিই সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং আর্টেসীয় কূপ এর রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন। সূক্ষ্ণ ও শুদ্ধ গণনায় আল বেরুনী একটি বিস্ময়কর পন্হা আবিষ্কার করেন যার বর্তমান নাম The Formula Of Interpolation. স্যার আইজ্যাক নিউটনের জন্মের ৫৯২ বছর পূর্বেই আল বেরুনী এটি আবিষ্কার করেন এবং একে ব্যবহার করে বিশুদ্ধ সাইন তালিকা প্রস্তুত করেন। এরপর এ ফর্মূলা পূর্ণতা দান করে তিনি ট্যানজেন্ট তালিকা তৈরি করেন। তিনিই বিভিন্নপ্রকার ফুলের পাঁপড়ি সংখ্যা হয় ৩,৪,৫,৬ এবং ১৮ হবে, কিন্তু কখনো ৭ বা ৯ হবেনা; এ সত্য আবিষ্কার করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থ তিনি বহু রোগের ঔষধ তৈরির কলাকৌশল বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪ টি। ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর আল বেরুনী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
|
ইবনে সিনা |
৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তু্র্কিস্তানের বিখ্যাত শহর বুখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য,সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। একশ বছর বয়সে ''আল মোজমুয়া'' নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন যার মধ্যে গণিতশাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি ''আল কানুন'' নামে একটি কিতাব রচনা করেন যা তৎকালীন যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব এনে দিয়েছিল। কিতাবটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ, পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই হোলেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। তার রচিত ''আশ শেফা'' দর্শনশাস্ত্রের আরেকটি অমূল্য গ্রন্থ। এতে ইবনে সিনার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্বসহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে আজীবন পরিশ্রম করেছেন এবং ভ্রমণ করেছেন জ্ঞানের সন্ধানে। তিনিই সর্বপ্রথম ''মেনিনজাইটিস'' রোগটি শনাক্ত করেন। পানি ও ভূমির মাধ্যমে যেসকল রোগ ছড়ায় তা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। সময় ও গতির সাথে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। ১০৩৭খ্রিস্টাব্দে মহাজ্ঞানী বিশ্ববিখ্যাত এই বিজ্ঞানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
|
ইবনুন নাফীস |
১২০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান দামেস্ক মিশর না সিরিয়া তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সথিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালী, হৃদপিন্ড, শরীরে শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে অবহিত করেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান জগতে তিনি যে কারণে অবস্মরণীয় হয়ে আছেন তা হল মানবদেহে রক্ত চলাচল সম্পর্কে গ্যালেনের মতবাদের ধরিয়ে ছিলেন তিনি এবং এই সম্মন্ধে নিজের মতবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। ১২৮৮খ্রিস্টাব্দের ১৮ডিসেম্বর এই মহামনীষি মৃত্যুবরণ করেন।
|
জোহানস গুটেনবার্গ |
১৪০০ সালে জার্মানের এক ভদ্রপরিবারে তার জন্ম।তিনি ছিলেন একজন খুব ভালো শিল্পী। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারক হিসেবে তার নাম কে না জানে! গুটেনবার্গের কাঠের টাইপ আজো বিজ্ঞান জগতে এক শ্রেষ্ঠ অবদান। আজ পৃথিবীতে ছাপাখানার অনেক উন্নতি হয়েছে। ১৮৮৬সালে ওটসার মার্গেন থ্যাসার নামে এক আমেরিকান যন্ত্রবিদ লাইনোটাইপ নামে একটি টাইপযন্ত্র আবিষ্কার করেন। পরে অবশ্য মনোটাইপ অফসেট আবিষ্কার হয়ে মুদ্রণশিল্পের উন্নতি হয়েছে। তবে গুটেনবার্গ হচ্ছেন মুদ্রণশিল্পের প্রথম ও প্রধান জন্মদাতা। ১৪৬৮সালে এই বিজ্ঞানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
|
নিকোলাস কোপার্নিকাস |
১৮৭৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী পোল্যান্ডের থর্ন শহরে কোপার্নিকাসের জন্ম। তিনি ছিলেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। কোপার্নিকাস ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। তিনি সর্বপ্রথম সারাদেশে একিধরণের মুদ্রা চালু প্রথা করেন। তার একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল আধুনিক ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বছরের সঠিক কাল পরিমাপ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি টলেমীর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে গ্রহগুলি সূর্যের চারিদিকে পরিভ্রমণ করছে এই ব্যাখ্যা দিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে কোপার্নিকাস তার জীবনব্যাপী পর্যবেক্ষণ আর আবিষ্কারকে প্রকাশ করলেন তা যুগান্তকারী গ্রন্থে ''দি রিভেল্যুশনিবাস আররিথার কোয়েলেসটিয়াম (মহাজাগতিক বস্তুগুলির ঘূর্ণন)''।এই বইটির প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, পৃথিবী আপন অক্ষের চারদিকে আবর্তনশীল। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, সূর্যই কেন্দ্রে অবস্থান করছে। পৃথিবীসহ প্রত্যেকটি গ্রহ ব্যাসর্ধের নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আপন আপন বৃত্তপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধুমাত্র চাঁদই পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তপথে ঘুরছে। কোপার্নিকাস এই বইয়ের মধ্য দিয়ে যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করলেন তার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন,আইনষ্টাইন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করলেন। ১৫৪৩ সালের ২১ মে আধুনিক বিজ্ঞানের এই পথিকৃতের মৃত্যু হয়।
|
গ্যালিলিও গ্যালিলি |
গ্যালিলিওর জন্ম ইতালির পিসা শহরে ১৫৬৪ সালে। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা গণিতশাস্ত্রবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ। তাঁকে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ বলা হয়। গ্যালিলিও গ্যালিলিই সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে, পৃথিবীকে আপাতদৃষ্টিতে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র বলে মনে হলেও বস্তুত পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে সদা ঘূর্ণায়মান। ঝাড়লণ্ঠনের দোলন থেকে আবিষ্কার করলেন পেন্ডুলাম। গ্যালিলিওর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে পেন্ডুলামের নক্সা দেখে তৈরি করেছিলেন পেন্ডুলাম ঘড়ি। ১৬০৯ সালে আবিষ্কার করেন টেলিস্কোপ। বিরাট সেই টেলিস্কোপ দিয়ে গ্যালিলিও পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করলেন সমস্ত আকাশ। তিনি বললেন চাঁদ একটি উপগ্রহ। তার মধ্যে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড় আর গিরিখাদ। তিনি আবিষ্কার করলেন শনির বলয়। তাছাড়া তিনি পড়ন্ত বস্তুর সূত্রেরও উদ্ভাবক। এই মহান বিজ্ঞানী ১৬৪২ সালে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন।
|
জোহান কেপলার |
১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানির ওয়েল নামক একটি শহরে জোহান কেপলার জন্মগ্রহণ করেন। কেপলারের প্রিয় বিষয়গুলি ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা। কেপলারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুস্তকটির নাম ‘নিউ অ্যাসট্রোনমি’, যা প্রকাশের পর বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন, সূর্যের চারদিকে গ্রহরা একটি উপবৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করছে। তাই ওরা ঘুরতে ঘুরতে কখন সূর্যের সন্নিকটবর্তী হয় আবার কখন দূরে সরে যায়।কেপলারই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি গ্রহদের পরিভ্রমণ পথের অনেকটা সঠিক তথ্য প্রদান করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, কোন গ্রহের কক্ষপথ ঠিক বৃত্তাকার নয়। অনেকের মতে কেপলার একটি শক্তিশালী দূরবীনও তৈরি করেছিলেন এবং সেই দূরবীনের সাহায্যে তিনি গ্রহ,নক্ষত্র এবং চন্দ্রের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন।কিন্তু তাঁর দূরবীনটি কেমন ছিল আজ আর জানার কোন উপায় নেই। বহুপূর্বেই যন্ত্রটি হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
|
উইলিয়াম হার্ভে |
১৫৭৮ সালে ১লা এপ্রিল ফোকস্টনে উইলিয়াম হার্ভের জন্ম হয়। শরীরের রক্ত সন্চালন সম্পর্কে গুরুত্ত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে। হার্ভে দেখলেন রক্ত প্রবাহিত হয় হৃদপিন্ডের দিকে। তিনি পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন যে রক্ত মোটেই দুই রকমের নয়। একি রকমের রক্ত শিরা ও ধমনীতে প্রবাহিত হয়। রক্ত শুধু হৃদপিন্ডের ভেতরেই নয় শরীরের সব জায়গায় এবং সব সময়ে একি দিকে প্রবাহিত হয়। হৃদলিন্ড থেকে যে রক্ত পাম্পের মত প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে, বৃত্তাকারে তা শরীরে প্রবাহিত হয় এবং আবার তার সূত্রে ফিরে আসে। শোণিত সংবহন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যু হওয়া। হৃদপিন্ড এ কাজ করে রক্তবাহী নালীর সাহায্যে। ১৬৫৭সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
|
ব্লেইজ প্যাসকেল |
১৬২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুন ফ্রান্সের ক্লারমন্টে ব্লেইজ প্যাসকেল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রবিদ, পদার্থবিদ, ধর্মীয় দার্শনিক। প্যাসকেল ১৬ বছর বয়সে প্রজেক্টিভ জিওমেট্রির উপর তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। ২২বছর বয়সে প্রথম গণনাযন্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হন। তরল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি একটি যুগান্তকারী সূত্র উদঘাটন করেন যা ''প্যাসকেলের সূত্র'' নামে পরিচিত। প্যাসকেলের নাম অনুসারে চাপের এককের নাম ''প্যাসকেল'' রাখা হয়। বায়ুর চাপ মাপক যন্ত্র ও তাঁরই আবিষ্কার। ১৬৬২খ্রিস্টাব্দে ১৯শে আগস্ট ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।
|
এনথনি ফন লিউয়েনহুক |
১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে অক্টোবর হল্যান্ডের ডেল্ফট এ লিউয়েনহুক জন্মগ্রহণ করেন। ডাচ বিজ্ঞানী লিউয়েনহুক সর্বপ্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তবে তাঁর অণুবীক্ষণ যন্ত্র এখনকার মত এত উন্নত ছিলনা। নিজের তৈরী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে তিনি প্রোটোজোয়া, ব্যাকটেরিয়া, স্পারমাটোজোয়া, স্নায়ুকোষ, হাইড্রা, ভলভক্স ইত্যাদি জীবের যে বর্ণনা লিখে গেছেন তা অত্যন্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি বিস্তারিতভাবে লোহিত রক্তকণিকার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৬৭৪সালে তিনি লোহিত রক্তকণিকার আকৃতি ৮.৫ মাইক্রন (প্রকৃত ৭.৭মাইক্রন) পরিমাপ করেন যা প্রকৃত মাপের কাছাকাছি। ১৬৮২সালে তিনি মাছের লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। ১৬৮৩সালে তিনি ESR পরিমাপ করেন। ১৬২৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
|
স্যার আইজ্যাক নিউটন |
স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের লিঙ্কনশায়ারের উলথ্রক ম্যানরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাবিজ্ঞানী। পদার্থবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতিদর্শনসহ বহুমুখী বিষয়ে সুপন্ডিত। কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতেই তিনি অংকশাস্ত্রের কিছু জটিল তথ্য আবিষ্কার করেন, বাইনমিয়াল থিওরেম (Binomial theorem), ফ্লাক্সসন (Fluxions) যা বর্তমানে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস (Integral Calculus) নামে পরিচিত। এছাড়া কঠিন পদার্থের ঘনত্ব আবিষ্কার (The method for Calculating the area of curves or the volume of solids) করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার, মহাকর্ষ বল, আহ্নিক ও বার্ষিক গতির সপক্ষে গ্রহণীয় সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাদান করেন। ১৬৪৭সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ''Philosophia naturalis principia Mathemetica''এই গ্রন্থের প্রথম খন্ডে নিউটন গতিসূত্র সম্মন্ধে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় খন্ডে তিনি গ্যাস, ফ্লুইড বস্তুর গতির কথা আলোচনা করেছেন। তৃতীয় খন্ডে মাধ্যাকর্ষণ সম্মন্ধে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ এই মহাবিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।
|
গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট |
১৬৮৬ খ্রিসটাব্দের ২৪শে মে নেদারল্যান্ডের ড্যানজিগ শহরে জনমগরহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন জার্মান পদার্থবিদ ও প্রকৌশলী, পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিভূ। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি নেদারল্যান্ডে কাজ করেন। তিনি তাপমাত্রার একক ''ফারেনহাইট'' এর আবিষ্কারক। তার উদ্ভাবিত এ একক সেলসিয়াসের এককের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ১৭৩৬খ্রিস্টাব্দের ১৬সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডের দ্যা হেইগ শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখকঃ শিশিরের শব্দ।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন