ক্যানিবালিজমের ইতিহাস ।। Hostory Of Cannibalism

রাস্তার পাশের একটা মাঝারি আকারের রেস্তোরা। অফিস পাড়ার কাছাকাছি হওয়ার কারণে সকাল সকাল অনেক মানুষ এখানে আসে নাশতা করতে। আর দশটা দিনের মতো সকালবেলা প্রচণ্ড ভিড় হয়েছে সেখানে। প্রতিটি টেবিল ভর্তি কাস্টমারে ভর্তি, প্যাসেজ দিয়ে বয়রা অর্ডার নিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। আজকের মাংস রান্না নাকি সেখানে অসাধারণ হয়েছে, সবাই গোগ্রাসে গিলছে। বলতে না বলতেই মাংস ভরা ডেকচি খালি হয়ে গেলো, ম্যানেজারের মুখে একান ওকান হাসি। হঠাৎ বিকট চিৎকার করে এক লোক টেবিল ছেড়ে উঠে আসলো, সবাই অবাক হয়ে তার কাছে ছুটে গেলো, কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই সে কাঁপা কাঁপা হাতে দেখিয়ে দিলো নিজের প্লেটটা, সবাই গিয়ে দেখে মাংসের ভেতর মানুষের একটা ছোট্ট কড়ে আঙ্গুল।

এই গল্পটা ছোটবেলায় কার কাছে শুনেছিলাম ঠিক মনে নেই তবে শোনার পর থেকেই মাথায় ভেতর একটা প্রশ্ন জেগেছিলো, মানুষের মাংস কি খাওয়া যায়? কেউ কি কখনো খেয়ে দেখেছে কেমন লাগে? পরক্ষনেই ব্যাপারটার বীভৎসতা চিন্তা করে আর বেশি দূর আগাইনি। আর একটা গল্পে পড়েছিলাম, মানুষের মাংস নাকি আর সব মাংসের চেয়ে মিষ্টি আর সুস্বাদু। বলাই বাহুল্য, এর সবই আন্দাজি কথাবার্তা। এখন আপনাদেরকে বলবো সত্যি সত্যি নরমাংস ভোজন বা ক্যানিবালিজমের ইতিহাস।


মানুষের স্বজাতি ভক্ষণের ইতিহাস কিন্তু বেশ লম্বা। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভ্যতায় এই প্রবণতার চিহ্ন দেখা গেছে। সেই প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ যারা পশুর চর্বি দিয়ে রঙ বানিয়ে গুহার দেয়ালে অপূর্ব সব ছবি আঁকতো, তাদের থেকে শুরু করে আমাজানের প্রত্যন্ত উপজাতি গুলো, কখনো গোষ্ঠিগত অথবা হয়তো একাকী তবে ক্যানিবালরা ছিলো প্রত্যেক যুগেই!

সত্যিকারের মানুষখেকো যারাঃ
মোটা দাগে ক্যানিবালিজমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, তার মধ্যে একটা হলো, যখন কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কাজটা করে। উদ্দেশ্য হতে পারে ধর্মীয় আচার পালন, অথবা জাতিগত প্রথা আর নাহলে স্রেফ মানুষের মাংস খাওয়া। ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক জাতির কথা আছে, যারা নিজেদের বাইরের কোনও মানুষকে পেলেই ধরে এনে আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলতো। বিখ্যাত সব অভিযাত্রী আর পরিব্রাজকদের ভ্রমণকাহিনীতে ফুটে উঠেছে এই সব হারিয়ে যাওয়া উপজাতিদের কথা। আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন যিনি, সেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস রেড ইন্ডিয়ানদের কিছু উপজাতিকে মানুষ খেকো আখ্যা দিয়েছিলেন, এছাড়া ইবনে বতুতা বিশ্বভ্রমনের জন্য যিনি সুপরিচিত, তিনিও একবার নাকি ভাগ্য গুণে ফিরে এসেছেন এদের হাত থেকে।


নিজের জাতির বাইরের মানুষ পেলে তাকে খেয়ে ফেলা, যাকে বলে এক্সোক্যানিবালিজম, সেটা করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অন্য জাতি গুলোকে ভয় দেখানো আর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা। এই যেমন পাপুয়া নিউগিনির মিয়ামিন উপজাতি এক্সোক্যানিবালিজমের জন্য সুপরিচিত ছিলো। এরা মাঝে মধ্যেই আশেপাশের গ্রাম গুলোতে হানা দিয়ে মানুষ ধরে নিয়ে যেতো, আর তারপর তাদের আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলতো। একটা পর্যায়ে সেই সব হতভাগা প্রতিবেশীরা একে একে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। একজন নৃতত্ববিদ এ ব্যাপারে মিয়ামিনদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন তারা এভাবে প্রতিবেশী জাতিদের খেয়ে ফেলে, তাদের নিরীহ জবাব ছিলো, “কারণ ওদের মাংস বেশ সুস্বাদু”।

(ভাগ্যিস ওদের সাদা চামড়ার মানুষে অরুচি ছিলো, নাহলে হয়তো সেই নৃতত্ববিদ প্রশ্ন করা তো দূরের কথা, কখনো ওদের সামনে পরারই সাহস করতেন না। আর প্রতিবেশীদের প্রতি তাদের এই অনুরাগের কারণটাও আমাদের আর জানা হতো না।)

পরাজিত যোদ্ধাদের ভক্ষণ করতো এজটেকরা
প্রাচীনকালে যুদ্ধের সময়ও প্রতিপক্ষের উপর প্রভাব ফেলার জন্য ক্যানিবালিজম চর্চা করা হতো। এজটেক নামক একটা উপজাতির বিশ্বাসই ছিলো এমন যে যুদ্ধ বন্দী যোদ্ধাদের মাংস ভক্ষণ দেবতার আশীর্বাদ লাভের একটা মোক্ষম উপায়। সপ্তম শতকে কোরাইশ আর মুসলমানদের যুদ্ধের ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় প্রাক ইসলামিক যুগের আরবেও ক্যানিবালিজম প্রচলিত ছিলো। তুমুল প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ সেই যুদ্ধের একটা পর্যায়ে মুসলিম বীর হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করলে তার দেহ থেকে কলিজা বের করে ভক্ষণ করেন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা।


তবে ক্যানিবাল উপজাতিরা যে শুধু বাইরের মানুষদের খেতো তা কিন্তু না বরং অনেক উপজাতি ছিলো যারা নিজেদের মানুষদের, এমনকি নিজের আত্মীয় স্বজনদেরকে খেয়ে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করতো না (এন্ডোক্যানিবালিজম)। অনেক ক্ষেত্রে এটা ছিলো ধর্মীয় আচারের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। আমাজনের ওয়ারি জাতি তাদের কোনও মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির শরীর কেটে কেটে তার নিকট আত্মীয়দের ভেতর ভাগ করে দিতো। প্রিয়জনের মগজ খেয়ে তার বুদ্ধিমত্তাকে, অথবা হৃৎপিণ্ড খেয়ে মনটাকে নিজের ভেতর ধারণ করার চিন্তা থেকেই হয়তো এরকম বীভৎস প্রথার উৎপত্তি হয়েছিলো, কে জানে! আবার কখনো কখনো প্রভাব বিস্তারের একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে এই প্রথাটা, জানি কথাটা অনেকের কাছে উদ্ভট ঠেকতে পারে, তবে এটা সত্য যে এখনো আফ্রিকার ক্যানিবাল গোত্রপতিরা হরহামেশাই অধীনস্থদের মধ্যে থেকে কোনও একজনকে খেয়ে গোত্রের ভেতর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। (ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যে, গোত্রের প্রধানকে খুশি রাখো, তাকে মান্য করে চলো, নাহলে যে কোনো দিন সে তোমাকে খেয়ে হজম করে ফেলবে।)

এসব গেলো বিভিন্ন উপজাতিদের নরমাংস ভোজন আর তাকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন মিথ আর আচার অনুষ্ঠানের কথা। এর বাইরেও কিন্তু হরহামেশাই ক্যানিবালিজমের চর্চা হয়, এমনকি মাঝে মাঝে হয় সভ্য দুনিয়াতেই! আর সেটা হয় এভাবে,

আন্দেস বিমান দুর্ঘটনা ১৯৭২
যখন সবকিছুর উপরে বেঁচে থাকার তাগিদঃ
১৯৭২ সালে একটি যাত্রীবাহী বিমান চিলির আন্দেস পর্বত এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। সামান্য কিছু যাত্রী বাদে বিমানের আর সবাই মৃত্যুবরণ করে। সাথে থাকা খাদ্য আর পানীয় ফুরিয়ে যাওয়ার পর, গহীন সেই জঙ্গলে বেঁচে থাকার তাগিদেই একটা পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাইরে থেকে কোনও সাহায্য না আসা পর্যন্ত মৃত বিমান যাত্রীদেরকে খেয়ে জীবন ধারণ করার। এভাবে দুর্ঘটনার সত্তর দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সাহায্য আসে, উদ্ধার কর্মীরা সেখান থেকে প্রায় ১৬ জন যাত্রীকে অক্ষত উদ্ধার করেছিলো, আর সাথে পাওয়া যায় তাদের কিছু সহযাত্রীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ।

বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এইসব মানুষদের মতো, যখন কোনও উপায়ন্তর না দেখে মানুষ নরমাংস ভক্ষণে বাধ্য হয় তখন সেটাকে বলা হয় সার্ভাইভাল ক্যানিবালিজম।

নৌপথে এই ঘটনা প্রায় ঘটে, দেখা গেলো জাহাজ এমন কোনও জায়গায় আটকা পড়েছে যেখানে আশেপাশে কোনো ভূমি নাই। সমস্ত রসদ ফুরিয়ে গেছে, এক সময় পানির সংকট দেখা দিলো, তখন আপনি কি করবেন? নিজে মৃত্যুবরণ করে অন্যদের খাবার হবেন? নাকি বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য কাউকে খেয়ে ফেলবেন? (প্রশ্নটা আমি পাঠকদের উদ্দেশ্যেও করলাম, আশা করি কমেন্টে উত্তরটা দিবেন?)

আমাদের কাছে উদ্ভট ঠেকতে পারে, কিন্তু দূর সাগরের নাবিকদের জন্য এরকম পরিস্থিতিতে পড়া মোটেই অস্বাভাবিক না। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে ডারউইনের নীতিটাকে মেনে চলা হয়, "যোগ্যতার নীতি", যারা শক্তসমর্থ আর যোগ্য একমাত্র তারাই টিকে থাকবে। মানে একটু ঘুরিয়ে বলি যদি, দুর্বলরা মৃত্যুবরণ করবে এবং সবলদের খাদ্যে পরিণত হবে।

জীবন ধারণের তাগিদে ইসলামে হারাম খাবার বর্জনের আদেশকেও শিথিল করা হয়েছে, বলা হয়েছে নেহাত জীবন সংশয় দেখা না দিলে হারাম খাবার স্পর্শ না করতে। তবে এই বিধান সার্ভাইভাল ক্যানিবালিজমকে সমর্থন দেয় কি না, সে ব্যাপারে আমার স্পষ্ট ধারণা নাই।

সবকিছু যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য তা নয়, দ্বিমত আছে গবেষকদের ভেতরেও। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ ক্যানিবালিজমকে প্রাচীন একটি প্রথা হিসেবে মেনে নিলেও দ্বিমত করছেন এমন গবেষকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কারণ এসব আচার প্রথা যে একটা সময়ে সত্যিই প্রচলিত ছিলো তা নিছক অনুমান করা হয়েছে, খুব শক্ত কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি কেউ (অবশ্য পারার কথাও না)। উইলিয়াম আরেন্স নামের এক প্রত্বতত্নবিদ প্রথম এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেন। তার যুক্তি ছিলো, এসব আচার যে প্রচলিত ছিলো, তা আমরা জানছি কিভাবে? আমাদের হাতে কি আসলেই কোনও প্রমাণ আছে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাই। কারণ এসবের বেশিরভাগ বর্ণনাই এসেছে অপর কোনও জাতি বা বহিরাগত পর্যটকের ভ্রমন কাহিনী থেকে। সেগুলোতে ভুল ও বিকৃত বর্ণনা থাকা খুবই স্বাভাবিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কথা, তার যে বর্ণনায় নর মাংসভোজী উপজাতিদের কথা যেমন আছে, ঠিক তাতেই আরেক জায়গায় এমন এক প্রজাতির মানুষের কথা বলা হয়েছে যাদের কোনও মাথা ছিলো না, বুকের উপর দুইটা চোখ ছিলো! তা দিয়ে তারা দেখতো!

বলাই বাহুল্য, এটা অতিরঞ্জিত বর্ণনা। তাহলে ঐ একই বর্ণনাকারীর ক্যানিবালিজমের গল্পকে কেন আমরা বিশ্বাস করছি? হতেও তো পারে এটাও অতিরঞ্জিত বর্ণনা! আপনার কাছে এসব যদি অতিরঞ্জিত মনে হয়, তাহলে বলবো আপনি একা নন, এর সত্যতার ব্যাপারে গবেষকদের ভেতর স্পষ্ট মতভেদ আছে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ক্যানিবালদের নরমাংস ভক্ষণের গা হিম করা যেসব কাহিনী আমরা শুনি, এখনকার সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান তাকে এক প্রকার মানসিক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিগত কয়েক দশকে অনেক বিখ্যাত ক্যানিবালকে ধরে চিকিৎসা এবং অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। মানুষ নিশ্চয়ই পশুপাখি না, যে একা পেলেই কেউ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলবে। তাই বাঁচার তাগিদে কখনো ক্যানিবাল হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার (সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না)। তবে ক্যানিবাল উপজাতির নরমাংস ভোজনের মুখরোচক গল্প আর তাকে ঘিরে নানা আচার অনুষ্ঠানের বর্ণনা আপাতত ইতিহাসের বই, রোমাঞ্চ উপন্যাস আর এই টাইপের আঁতেল ব্লগের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখাটাই মনে হয় যুক্তিসঙ্গত।

অতি উৎসাহী লেখকের ক্যানিবালিজম চর্চার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা (একটু বেশি বুঝলে যা হয় আরকি)
লেখকঃ উমর।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info