আমাজনের গোলাপি ডলফিন

যারা যারা "স্বদেশী ডলফিন আর তিমিদের রাজ্যে" লেখাটি পড়ে ফেলেছেন, তারা তো খুব ভালো করেই জেনে গেছেন, আমাদের দেশের একটা ডলফিনের নাম হলো, গোলাপি ডলফিন। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন? আমাদের দেশের চেয়েও বেশি বিখ্যাত আমাজনের গোলাপি ডলফিন। হ্যাঁ, লাতিন আমেরিকার সেই বিখ্যাত নদী আমাজনের কথাই বলছি, যাকে ঘিরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন আর রহস্যময় বনভূমি আমাজন; সেই আমাজন নদীতেই থাকে আমাদের গোলাপি ডলফিনগুলোর জ্ঞাতি ভাইয়েরা। আমাদের গোলাপি ডলফিনদের কথা তো শোনা শেষ, এবার চলেন আমাদের দেশ থেকে বহুদূরে বাস করে যে গোলাপি ডলফিনগুলো, তাদের গল্পই শুনে আসি।


আচ্ছা, ওদেরকে বারবার গোলাপি ডলফিন বলছি, ওদের কিন্তু আরো অনেক নাম আছে। এই যেমন ধরেন, পেরুতে ওদেরকে বলে, "বুফো কলোরাডো"। আবার ব্রাজিলে বলে, "বোতোস"। ওদের এমনি মজার মজার আরো অনেক নাম আছে, "বোতো কর দে রোসা", "বোউতো", "নে, তনিনা"। কী মজার না নামগুলো!

গোলাপি ডলফিনরা কিন্তু মিঠা পানির ডলফিন। মানে ওরা শুধু নদী আর খালেই থাকে। ওরা কখনোই সাগরে যায় না। আর আজকে আমরা যাদের গল্প শুনছি, ওরা শুধু আমাজন নদীতেই থাকে। তাই ওদের আরেকটা নামই হলো আমাজন নদীর ডলফিন। ওদের সারাটা জীবন আমাজন নদীতেই কেটে যায়। আমাদের অনেকেরই জীবন যেমন শুধু বাংলাদেশেই কেটে যায়, তেমনি আরকি।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info


এই গোলাপি ডলফিনরা কিন্তু আবার দেখতে ধূসর ডলফিনের মতোই। অবশ্য গায়ে গতরে ওদের চেয়েও বড়ো। আপনি যদি আকৃতির ব্যাপারটা ঠিকমতো না জানেন, তবে আপনি ওদেরকে গুলিয়েই ফেলতে পারেন। তবে পার্থক্য করার কিন্তু একটা উপায় ঠিকই আছে। সব ডলফিনের যেখানে পিঠে থাকে পাখনা, ওদের সেখানে থাকে একটা কুঁজ! মানে পিঠে পাখনার কাজ করে একটা মাংসপিণ্ড। আর ওদের লেজটাও একটু বড় হয়।

আবার গোলাপি ডলফিন কিন্তু এমন একটা কাজ পারে, যা অন্য কোন ডলফিনই পারে না। ওরা ওদের ঘাড় ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁকাতে পারে। মানে প্রায় উল্টোদিকেই ঘুরাতে পারে। ওদের কেমন মজা একবার চিন্তা করে দেখো! শরীর না ঘুরিয়ে কেবল ঘাড় ঘুরিয়েই ওদের পেছনে কি হচ্ছে দেখতে পারে। ওদের এই ক্ষমতা কিন্তু শিকার করার সময় বেশ কাজে লাগে। আমাজন নদীর নিচের নানা গাছপালার ভেতরে ঘাড় বাঁকিয়ে টাকিয়ে ঢুকে পড়ে। আর তারপর ওদের লম্বা লম্বা নাক দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে সবাইকে বের করে এনে গপাৎ গপাৎ করে খেয়ে নেয়।

খাওয়ার প্রসঙ্গ যখন আসলোই, তখন বলেই দেই ওরা কি কি খায়। আমাদের গোলাপি ডলফিনের সঙ্গে অবশ্য ওদের এখানে পুরোই মিল। ওরাও ছোট ছোট মাছ, ক্যাটফিশ, কাঁকড়া, ছোট ছোট কচ্ছপ, পিরানহা মাছ, এগুলো খায়।


আগেই বলেছি ওদের আকৃতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মিঠা পানির ডলফিনদের মধ্যে ওদের আকৃতিই সবচেয়ে বড়ো। ওরা লম্বায় একেক জন ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়। আর ওজন হয় একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতোই। ওদের ওজন গড়ে ২০০ পাউন্ড, মানে প্রায় ৮০ কেজির মতো। তবে জন্মের পর মিষ্টি বাচ্চা ডলফিনের ওজন কতো হয় জানেন? মাত্র ১ কেজি! আর লম্বায় থাকে মাত্র ৩০ ইঞ্চি!

ডলফিনরা কিন্তু ডিম দেয় না, মনে আছে তো? আমাদের মতোই ওরাও মায়ের পেটে কিছুদিন থাকে, তারপর আমাদের মতোই মায়ের পেট থেকে আস্ত বেরিয়ে আসে। গোলাপি ডলফিনরা মায়ের পেটে প্রায় আমাদের মতোই সময় কাটায়, ৯ থেকে ১২ মাস। আর তারপর বেরিয়ে এলে প্রথম প্রথম কিছুদিন বাবা মার সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়। তারপর বড়ো হলে আলাদা হয়ে যায়। সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিলে ডলফিনরা বাচ্চা দেয়। সে সময় আমাজনে আবার থাকে বন্যার মৌসুম। তাহলে দেখা যাচ্ছে বন্যা জিনিসটা এই ‘বোতোস’দের খুব প্রিয়!


আমাজনের এই গোলাপি ডলফিনদেরকে কিন্তু খুব পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশ্বাস না হলে ওখানকার মানুষদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেই দেখেন না! ওরা কখনো গোলাপি ডলফিনদের মারে না। কারণ, ওরা ওখানকার মানুষদের কাছে খুবই পবিত্র। এমনকি বলা হয়, কেউ যদি ওদের চোখে চোখ রেখে তাকায়, তাহলে তাকে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে। তাই ওরা কেউ ভুলেও কখনো কোনো গোলাপি ডলফিনের চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না। শুধু তাই নয়, ওদের মতে, বোতোস’রা হলো আমাজানের সব মানাতিদের অভিভাবক। ভাবছেন, এই মানাতিরা আবার কারা? মানাতিরা হলো আমাজনেরই আরেক ধরনের ডলফিন। আর তাই আপনি যদি কোনো মানাতি ধরতে চান, আগে আপনাকে এই গোলাপি ডলফিনদের সঙ্গে সন্ধি করতে হবে। নয়তো আপনার কপালে কোনো মানাতিই জুটবে না, জুটবে কেবল লবডঙ্কা।


এরা কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান ডলফিনও বটে। ওদের শরীরের আকৃতি আর মস্তিস্কের আকৃতি তুলনা করলে দেখা যাবে, ওদের মস্তিষ্কের আকৃতি খুব একটা কমও না। তবে ওরা বেশি বিখ্যাত ওদের আগ্রহের জন্য। ওরা মানুষের সঙ্গে খেলতে যে কী পরিমাণ আগ্রহী! সুযোগ পেলে একবার ওদের সঙ্গে খেলে দেখবেন, তবেই বুঝবেন। আর বেশ মিশুকও বটে। খুব সহজেই ওরা মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করে দেয়। ডলফিন বলে কথা! ওরা মানুষকে কতোটা পছন্দ করে জানো? আমাজন নদীতে যে নৌকা চালানো হয়, তাকে বলে ক্যানু। কিন্তু আমাজন নদী যে খরস্রোতা, মানে যে পরিমাণ স্রোত; এ কারণে ওখানে প্রায়ই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। আর এরকম অনেক গল্প প্রচলিত আছে, যে আমাজনের বিশাল বুকে কয়েকজন মাঝিসমেত ডুবে গেছে কোনো ক্যানু। আর তখন সেই খবর পেলো আমাজানের বিখ্যাত গোলাপি ডলফিনরা। আর সাঁতরে এসে ডুবে যেতে থাকা মানুষগুলোকে সাঁতরে সাঁতরে ঠেলে ঠুলে পাড়ে তুলে দিয়ে চলে গেলো।


এরকম ভালো যে প্রাণীটা, তাদেরকে বাঁচানো কি আমাদের উচিত না? অবশ্যই উচিত। কিন্তু আমরা মানুষরা যে কী পচা, আমরা শুধু আমাদেরটাই চিন্তা করি। আমাদের জন্য যতো দরকার বন কেটে ফেলি, নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর স্রোত বন্ধ করে দেই। তাতে যে আমাদের আশেপাশের প্রাণীদের কতো অসুবিধা হয়, সেটা একদমই খেয়াল করি না। শুধু তাই নয়, গোলাপি ডলফিনদের মৃত্যুর আরেকটা কারণ হলো কারেন্ট জাল। এই জালে একসঙ্গে কতো মাছ যে ধরা পড়ে, এই জালে ধরা পড়ে প্রতি বছর যে কতো গোলাপি ডলফিন মারা যায়। আর তাই ২০ বছর আগেও যে গোলাপি ডলফিন বিপন্ন ডলফিনের কাতারে এক রকম ছিলোই না বলা যায়, সেই আমাজনের গোলাপি বোতোস’ই এখন সবচেয়ে বেশি বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন। সে সব অঞ্চলের যে সব দুষ্টু ব্যবসায়ীর জন্য ওরা দিন দিন কমে যাচ্ছে, তাদের কিন্তু খুব শাস্তি হওয়া উচিত। আর যারা না জেনে এই সব কাজ করে যাচ্ছে, তাদেরকে এখনই এসব জানানো উচিত। নয়তো মানুষের এমন বড়ো একটা বন্ধু যদি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেটা কি ভালো হবে, বলেন?


আমাদের দেশের ডলফিনের জ্ঞাতি ভাই আমাজানের গোলাপি ডলফিনের গল্প তো খুব শুনলেন, এবার বলেন তো, কোন ডলফিনগুলো বেশি সুন্দর আর মজার, আমাদের দেশের গোলাপি ডলফিন, না আমাজনের গোলাপি ডলফিন? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আমাদের দেশের গোলাপি ডলফিনগুলোই বেশি সুন্দর। আমাদের দেশের চেয়ে বাইরের দেশের কোন জিনিসটাই বা বেশি সুন্দর লাগে বলেন? এতো সুন্দর দেশে যা থাকে, তাই তো সুন্দর লাগে!

লেখকঃ নাবীল।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

  1. ভাবতেছি GF কে গোলাপ ফুল না দিয়ে একটা গোলাপি ডলফিন গিফট করব... সারা দিন ঐটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে আর আমারে কম জ্বালাবে... :p

    উত্তরমুছুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।