স্বদেশী ডলফিন আর তিমিদের রাজ্যে

যদিও ডলফিনদের দেখলে মাছ বলেই মনে হয়, তারপরও ওরা কিন্তু মোটেও মাছ নয়। ওরা মাছদের মতো পানিতে সাঁতার কাটে বটে, কিন্তু মাছদের মতো ডিম পাড়ে না। পানির মধ্যে যতোগুলো প্রাণী আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণীও কিন্তু এই ডলফিনই। মানে পানিতে মাছ বাদে আর যারা যারা থাকে, তাদের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। অনেক সুন্দর সুন্দর ডলফিন কিন্তু বাস করে আমাদের দেশের নদী আর সাগরে। আমাদের দেশে তো নদীর অভাব নেই, আবার দক্ষিণেই রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সুন্দরবনের আশেপাশের নদীগুলো আর সমুদ্রেও এদের অবাধ বিচরণ। শুধু কি ডলফিনই রয়েছে আমাদের নদী সমুদ্রে! আরো আছে তিমি মাছ। কি বিশ্বাস হচ্ছে না! সত্যিই কিন্তু আমাদের সাগরেও অনেক তিমি রয়েছে। অবাক হচ্ছেন! ঠিক আছে তিমির কথাও বলবো তার আগে খানিক ডলফিনের কথা বলি।

নৌকা বা ট্রলারে করে যাবার সময় হঠাৎ করেই আপনার চোখে পরে যেতে পারে ডলফিনের লাফ দেবার সুন্দর দৃশ্য। এমনকি আপনার নৌকার পাশেই সাঁতার কেটে কেটে হয়ে যেতে পারে আপনার যাত্রাসঙ্গীও। হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে ভুস করে ডুব দিয়ে হয়তো একেবারেই নিখোঁজ হয়ে যাবে। মনে হবে যেন লুকোচুরি খেলছে আপনার সঙ্গে। আপনি যদি এগুলোকে না চিনে নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করেন এদের সম্পর্কে; তারা বলবে, ‘এগুলো তো শুশুক’।

আমাদের দেশের নদীতে এমনি অনেক শুশুকের বাস। এই শুশুকও কিন্তু আদতে ডলফিনই। আমাদের দেশে সাধারণত ছয় ধরনের ডলফিন দেখা যায়। তারমধ্যে শুশুকের নামতো আপনারা শুনলেনই। আরো আছে ইরাবতি ডলফিন, গোলাপী ডলফিন, স্পিনার ডলফিন, স্পটেড ডলফিন আর বটলনোজ ডলফিন।


শুশুকঃ
এই ডলফিনগুলো বাস করে নদীতে। এদের ঠোঁটগুলো বেশ লম্বা। এই ঠোঁটের সামনের দিকে থাকে একসারি দাঁত। পিঠে থাকে ছোট ডানা। আর দুই পাশের বড়ো বড়ো পাখনার কারণে শুশুককে দেখতে একটু অদ্ভুতই লাগে। গায়ের রং হয় কালচে বাদামি অথবা মেটে। এরা মূলত আমাদের বড়ো বড়ো নদীগুলোতেই বাস করে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর সব জায়গাতেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা কিন্তু চোখে দেখতে পায় না। এরা জন্মান্ধ। মানে, জন্ম থেকেই অন্ধ। তাহলে এরা চলাফেরা করে কিভাবে? এরা শব্দ শুনে শুনেই চলাফেরা করতে পারে। আর চোখে দেখে না বলে এরা প্রায়ই জেলেদের জালে আটকা পড়ে যায়। প্রায়ই দেখা যায়, এরা কাত হয়ে সাঁতার কাটছে। বড় পাখনার সাহায্যে এরা নদীর তলদেশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পথ চিনে নেয়। এরা কিন্তু আবার একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তবে অনেক সময় নদীর বাঁকে ও মোহনায় ছোট ছোট দলেও দেখা যায়। ওরা কি খায়? মাছ, কাঁকড়া এইসব। পানিতে সাঁতার কাটতে গেলে মানুষের যেমন শ্বাস নেবার জন্য বাতাসের দরকার হয় তেমনি ওদেরও বাতাস লাগে। ওরা আবার পানিতে শ্বাস নিতে পারে না। আর এ কারণেই ওদেরকে পানির ভেতর থেকে খানিক পরপরই ভোঁস করে উপরে উঠে এসে নাক ভাসাতে হয় বা লাফিয়ে উঠতে হয়।


ইরাবতীঃ
সুন্দরবনের ছোটো ছোটো খালসহ বঙ্গোপসাগর মোহনার যতো নদী, আর কর্ণফুলী, মেঘনা, ফেনী, বলেশ্বর নদীতে এই সুন্দর ডলফিনগুলোকে দেখা যায়। এরা দেখতে অনেকটা শুশুকের মতোই। তবে গায়ের রং হয় বেশ গাঢ়। এদের আবার ঠোঁট নেই, মাথাও বেশ ভোঁতা। দুই পাশের পাখা শক্তিশালী, পিঠের পাখাটি ছোট আর তিনকোণা। এরা বেশ শান্ত। শুশুকের মতো অতো লাফালাফিও করে না, ধীরেসুস্থে ভেসে আবার টুপ করে ডুবে যায়। শুশুকের পাশাপাশিই শিকার ধরে, এক দলে দু-তিনটির বেশি থাকে না। নদীসহ যেসব উপকুলীয় জলাশয়ের নদী থেকে মিঠা পানি আসে, সেসব স্থানে ইরাবতী ডলফিনদের দেখা যায়। সুন্দরবনের জলপথে এরা শুশুকের সঙ্গে মিলেমিশেই থাকে।


গোলাপি ডলফিন বা ফিনলেস পরপয়েসঃ
গোলাপি এই ডলফিনগুলো ইরাবতী ডলফিনের মতোই। এদেরকে সুন্দরবনের নদীগুলোতে দেখা যায়। সুন্দরবনের বড়ো বড়ো নদীগুলোর খাঁড়ির জল শুকনো মৌসুমে কিছুটা পরিস্কার হয়ে এলে গোলাপি ডলফিনরা সাগর থেকে খাঁড়ি গুলোতে ঢুকে পড়ে। এরা আকারে শুশুকের চেয়ে বেশ বড়োসড়ো। বড়োদের গায়ের রং সুন্দর গোলাপি হলেও বাচ্চাদের রং কালচে। এরা আবার খুব চালাক চতুর হয়। চার-পাঁচটি মিলে দল গঠন করে ঘোরাফেরা করে। মাছ খেতে বেশি ভালবাসে। তবে বেশি খিদে পেলে কাঁকড়া, স্কুইডও এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। এদের পিঠের পাখনা বেশ বড়। খুব লাজুক হয় বলে সহজে এরা কারো সামনেও আসে না। মাঝে মাঝে অনেক দূরে হুস করে ভেসে ওঠে আবার ভুস করেই তলিয়ে যায়।


বটল নোজ ডলফিনঃ
নাম শুনেই তো বুঝতে পারছো এই ডলফিনগুলো দেখতে কেমন হয়। নাক দেখতে বোতলের মতো বলে এদের নামই হলো বটলনোজ ডলফিন। এরা আকারে অন্য অনেক ডলফিনের চেয়েই বড়ো। বোতলের মতো নাক আর বড় বড় চোখ এদের, পিঠের পাখনাও বেশ বড় আর গায়ের রং হালকা বাদামী হয়। তবে বোতলমুখোর পেটের নিচের দিকটা হলদেটে। এরা কিন্তু খুবই আমুদে। সারাদিন হৈ হুল্লোড় করে বেড়ায়। একসঙ্গে ৩০-৪০ টি ডলফিন মিলে লাফ-ঝাঁপ দিয়ে পানিতে একেবারে দাপিয়ে বেড়ায়। আনন্দে লাফালাফি করে, শুন্যে ডিগবাজি খায় আর মাছের ঝাঁকে আক্রমণ করে। সারা বছরই যেন ওদের নববর্ষ লেগেই আছে!


স্পিনার ডলফিনঃ
এই ডলফিনগুলোও বেশ মজার। ওরা সুন্দর করে ঘুরতে পারে। মানে বাতাসে লাফিয়ে উঠে শুন্যে পাক খেতে খেতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনে হয় যেন সার্কাস দেখাচ্ছে। এই জন্য বিভিন্ন অ্যাকুরিয়ামে এই ডলফিনগুলোকেই বেশি দেখা যায়। এরা বাস করে সমুদ্রে। সমুদ্রে জেলেদের মাছ ধরার নৌকার পাশে এরা কয়েকজন একসঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটে আর একটু পরপর শুন্যে উঠে পাক খায়। মানুষরা আবার এর একটা গালভরা নামও দিয়েছে, ‘বো রাইডিং’।


স্পটেড ডলফিনঃ
আমাদের দেশের সমুদ্রে আরেক ধরনের ডলফিন দেখা যায়, এদের নাম স্পটেড ডলফিন। এদের শরীরে অনেক ফুটকি থাকে তো, তাই এরকম নাম দেয়া হয়েছে। এদের ঠোঁট আবার অনেক লম্বা হয়। পিঠে পাখনা থাকে। সেই পাখনার তলার দিকটা আবার ছড়ানো, আর পিঠের দিকটা সুঁচালো। এরাও দলেবলে শিকার করে। লম্বায় এরা আড়াই মিটার পর্যন্ত হয়। এদের প্রিয় খাবার কি জানেন? টুনা মাছ।


তিমিঃ
ডলফিনও কিন্তু একধরনের তিমিই। তবে, নীল তিমির মতো আমাদেরও নিজস্ব তিমি রয়েছে। আমাদের নিজস্ব জাতের তিমি হলো, "ব্রিডিস হোয়েল"। এদের দেহের উপরের অংশের রং বাদামি নয়তো সাদাটে, আর নাকের ছিদ্র দুটি। ভাবছেন, নাকের ছিদ্র তো দু’টিই হবে, এটা আবার বলার কি হলো? আসলে তিমিদের নাকের ছিদ্র কিন্তু সাধারণত একটাই থাকে! তবে আমাদের ব্রিডিস হোয়েলের আছে দু’টি। এই ছিদ্র দিয়ে এরা ভেসে ওঠার পর ঝরনার মতো জল ছড়ায়। ২০-২৫ মিনিট পর পর ওরা ভেসে ওঠে। আমাদের সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীর মোহনার ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ থেকে শুরু হয়েছে সাগরখাদ ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’। মাটির বুকে যেরকম অনেক বড়ো বড়ো গর্ত থাকে, তেমনি সাগরের নিচেও বিশাল বিশাল গর্ত থাকে। এসব বিশাল বিশাল গর্তগুলোকে বলা হয় সাগরখাদ। এগুলোকে ইংরেজিতে বলে ‘সাবমেরিন হোল’ বা সাবমেরিন ক্যানিয়ন। এই সাগরখাদটা শ্রীলঙ্কার উপক‚ল পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব জায়গায় আবার পলিও জমতে পারে না। এই অঞ্চলে প্রচুর প্লাঙ্কটন, জেলিফিশ, ছোট চিংড়ি জাতীয় প্রাণী, স্কুইড আর ক্যাটল ফিশ বাস করে। আর এদের খেতেই এই এলাকায় জড়ো হয় যতো রাজ্যের ডলফিন আর তিমি। এখানেই বাস করে আমাদের ব্রিডিস হোয়েল।

তবে আমাদের সাগরে আরো অনেক তিমিও দেখা যায়। এদের বেশিরভাগ অনেক দূর দূর থেকে আমাদের দেশের সাগরে বেড়াতে আসে। আর আমাদের দেশটা যতো সুন্দর, আসার পর কি আর যেতে ইচ্ছে করে! তাই অনেকে এখানে থেকেও যায়। কিন্তু তারা তো অতিথি তিমি। তাদেরকে কি আর আমাদের তিমি এখনই বলাটা ঠিক হবে? তারচেয়ে গবেষকরা এ নিয়ে আরো গবেষণা করুক, তারপর না হয় আমরা বলবো ওরাও আমাদের তিমি।

দেখলেন তো, আমাদের দেশেও কতো বিচিত্র আর মজার মজার সব ডলফিন আর তিমি থাকে। ওরাও কিন্তু আমাদের দেশেরই অংশ। ওরা যাতে ভালো ভাবে থাকতে পারে, সেটাও কিন্তু আমাদেরকে দেখতে হবে। আমাদের সমুদ্রের আশেপাশের নদীগুলোতে যদি নোনা পানি বেশি ঢুকতে থাকে, তাহলে কিন্তু মিঠা পানির ডলফিনদের খুবই সমস্যা হবে। আবার সাগরের আশেপাশে আমরা যতো বেশি কল-কারখানা বসাবো, ততো বেশি সমস্যা হবে আমাদের নোনা পানির ডলফিন আর তিমিদের। সুতরাং, এসব ব্যাপারে কিন্তু আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে।

লেখকঃ মিন্টু হোসেন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info