সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক


১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এদেশের গুটিকতক মানুষ ছাড়া প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, খবরা খবর এনে দিয়েছেন, খাবার খাইয়েছেন তারা সবাই আসলে মুক্তির যুদ্ধ করেছেন। দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ। নিজেদেরকে স্বাধীন করার যুদ্ধ। আমরা আজ স্বাধীন দেশে বাস করছি, তার পুরো কৃতিত্বই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন সামনা সামনি, তাদের মধ্যে থেকেই বীরত্বের বিবেচনায় ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীর উত্তম, ১৭৫ জন বীর বিক্রম আর ৪২৬ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়। আজ তোমাদের এই খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যিনি বয়সে সবচে ছোট ছিলেন, তার কথা জানাবো।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info


বীর প্রতীক খেতাব যারা পেয়েছেন, তাদের তালিকায় ৪২৫ নম্বর নামটি যার, তিনিই আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক। শহীদুল ইসলাম, ডাক নাম লালু। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিলো মাত্র ১২ বছর। লালুর মতোই এমন অসংখ্য কিশোরের পরিশ্রম, রক্ত আর ঘাম মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে। চিন্তা করে দেখেন, ১২ বছরের একজন কিশোরের কি কি চাওয়া থাকতে পারে? লেটেস্ট মডেলের একটা জ্যাকেট, প্যান্ট, জুতো, খেলনা, গল্পের বই, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, একটা মোবাইল ফোন কত কিছুই তো চাওয়া থাকে, তাইনা? আর সে সময় বীরপ্রতীক লালু চেয়েছিলেন স্বাধীনতা, একটা মানচিত্র, একটা পতাকা। কি অসাধারণ দেশপ্রেম, চোখে পানি চলে আসে এমন কথা ভাবলে। আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, কে তিনি? যুদ্ধের সময় কেমন বীরত্ব দেখিয়েছেন। তবে শোনেন,


লালু ছিলেন টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। যুদ্ধ করেছেন বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকীর অধীনে। একাত্তরে এই বাঘা সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর তান্ডবেই গোটা টাঙ্গাইল আর মধুপুর অঞ্চল জুড়ে তটস্থ থাকতো হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা যে টাঙ্গাইলের গোপালপুর থানা দখল করেছিলেন, বলতে গেলে সেই থানা দখলের কৃতিত্ব প্রায় পুরোটাই তার। তিনিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোলে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিল যার। বঙ্গবন্ধু কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেয়েছিলেন যাকে, সেই মানুষটিই হচ্ছেন লালু। হাতে গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রু সেনাদের ওপর।


একটু পেছন থেকেই তাহলে বলা যাক। যুদ্ধের সময় ভেঙ্গুল কেরমাজানি বাজারে লালুর চোখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ির দল। ‘আমারে আপনাগো লগে লন’ আব্দার জুড়ে দেন লালু। এতো ছোটো ছেলে যুদ্ধ করবে কি! লালুর তাতে কিছু যায় আসে না, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ফাইফরমাশ খাটা শুরু করে দেন, পরম যত্নে অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করেন। পাহাড়ি এরপর সদলবলে সীমান্ত পাড়ি দেন। মেঘালয়ের তুরাতে ট্রেনিং নেন। লালুও জুটে যান সঙ্গে। তার কাজ ছিলো ভোরে উঠে হুইসেল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্যারেডের জন্য ডাকা। এরপর জাতীয় পতাকা টাঙ্গানো আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। তার সঙ্গী ছিলো সমবয়সী আরেক কিশোর বুলু। দুজনকেই বিচ্ছু বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রেনাররা তাদের শেখান কিভাবে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়, অস্ত্র চালাতে হয়, গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, শত্রুর গতি বিধির খবর নিতে হয়। আসার পথেই মাইনকার চরে কাদের সিদ্দিকীকে প্রথম দেখেন লালু। ২৫ দিনের ট্রেনিং শেষ করে তার দলে ভিড়ে যান।


যুদ্ধের উত্তুঙ্গ দিনগুলোতে গ্রুপ কমান্ডার পাহাড়ি তাকে নির্দেশ দেন গোপালপুর থানার হালহকিকত জেনে আসতে, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে তা দখল করতে পারে। লালু গিয়ে সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের ভাই সিরাজের দেখা পান। সিরাজ পাকিস্তানী সেনাদের দালালী করে, সে লালুকেও একই কাজ করার প্রস্তাব দেয়। লালু কৌশলে নিজের পরিচয় গোপন করে রাজী হয়ে যান। পরের দফা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে থানায় হাজিরা দেন তিনি। অল্পবয়স বলে তাকে চেক করা হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের আগেই জানান দিয়ে রেখেছিলেন তার ইচ্ছার কথা। পুরো পুলিশ স্টেশন একবার চক্কর মেরে এসে, এক বাংকারে প্রথম গ্রেনেড ছুঁড়লেন লালু। ভীত ও হতভম্ব পাকিস্তানীরা আন্দাজে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে লক্ষহীন ভাবে। শুয়ে লালু দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছোঁড়েন, কিন্তু এটা ফাটে না। এখান থেকে আর বেরুনো হবে না এই ভয় পেয়ে বসে তাকে। তারপরও তৃতীয় গ্রেনেডটি সশব্দে ফাটে আরেকটি বাংকারে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও এগিয়ে এসেছেন। গোলাগুলির এই পর্যায়ে সিরাজ এসে লালুকে একটি অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, চালাতে পারে কিনা। লালু অস্ত্র হাতে নিয়ে সিরাজকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে (একদম সামনাসামনি) গুলি করেন। এই ঘটনায় কিছু পাকিস্তানী পালায়, কিছু ধরা পড়ে, মারা যায় অনেক। হতাহতের মধ্যে দিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন গোপালপুর থানা। বলতে গেলে শহীদুল ইসলাম লালুর প্রায় একক কৃতিত্বে।

যুদ্ধ শেষ হয় একসময়। দেশ মুক্ত হবার পর টাঙ্গাইলের বিন্দু বাসিনী স্কুলে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে লালুও অস্ত্র জমা দিতে গিয়ে নজরে পড়েন বঙ্গবন্ধুর, জাতির পিতা সেই বীরকে চিনতে ভুল করেননি, জড়িয়ে ধরে তুলে নিয়েছেন কোলে, চুমু খেয়েছেন গালে। কি অদ্ভুত শিহরণ জাগে মনে, অমন এক শিশুর বীরত্বগাথা পড়ে।

অমন অসামান্য এক বীর শেষ জীবনটা কিন্তু বড়ো দুঃখে কষ্টেই কাটিয়েছেন। সারাজীবনই কাটিয়েছেন চরম দরিদ্র অবস্থায়। জীবন চালানোর তাগিদে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়ের চাকরি নিয়েছিলেন যুদ্ধের পরপরই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কখনো রেলস্টেশনে কুলির কাজ করেছেন, হোটেলের বাসন মেজেছেন আবার কখনো হয়েছেন পাচক। শেষদিকে এসে ঠেলাগাড়িতে করে চা বিক্রি করেছেন। এবছর, ২০০৯ সালের ২৫ মে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যান তিনি। দুটো কিডনীই অকেজো হয়ে গিয়েছিলো তার। পানি এসে গিয়েছিলো শরীরে। বেঁচে থাকতে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি আমরা এই বীরকে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারেনি রাষ্ট্র। এ লজ্জা আমরা রাখি কোথায়? আমাদের এই অক্ষমতা কি ক্ষমা করবেন এই বীর?

লেখকঃ আশরাফুল ইসলাম সাগর।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।