১৯৭০, বিশ্বে তখন উত্তাল এক সময়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমিউনিস্টদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটছে। মধ্য প্রাচ্য অস্থির। বিটেলস ভেঙ্গে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ। তখন আরও একটি ঘটনা মানবজাতির কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেটা হচ্ছে চন্দ্র অভিযান। ১৯৬৯ এর জুলাইতে চাঁদে মানুষ পা দিয়েছে। অ্যাপোলো ১১ এর পর অ্যাপোলো ১২ ও চাঁদে অবতরণ করেছে। এরপর অ্যাপোলো ১৩ এর পালা। এর মিশন ছিল চাঁদ থেকে পাথর এবং মাটি সংগ্রহ করে আনা।
![]() |
অ্যাপোলো ১৩ এর তিন ক্রু। |
১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাপোলো ১৩ উৎক্ষেপিত হয়। এর কমান্ডার ছিলেন জেমস এ লভেল, কমান্ড মডিউল পাইলট ছিলেন জন এল সুইগারট এবং লুনার মডিউল পাইলট ছিলেন ফ্রেড ডব্লিউ হাইসে।


![]() |
অ্যাপোলো ১৩ উৎক্ষেপণ। |
এটি ছিল একটি চন্দ্র অভিযান কিন্তু এটা বাতিল করতে বাধ্য করা হয় উৎক্ষেপণের ৫৬ ঘণ্টা পর সার্ভিস মডিউলের ক্রমাগত ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন হারানোর ফলে, এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা হারানো, অক্সিজেন এবং জল সরবরাহের ব্যর্থতার ফলে।
![]() |
মিশন ইনসিগনিয়া। |
তবে ১৩ সংখ্যাতে আসলেই গণ্ডগোল আছে তা হয়ত প্রমান করতেই উড্ডয়নের কিছুক্ষণের ভিতর একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তবে এতে কোন অসুবিধা হয়নি। নভোচারীদের থেকে মিশন কন্ট্রোল ক্রুদের। সেখানে মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার এবং নভোচারীরা থাকেন। মহাকাশে কোন ঝামেলা হলে তা সমাধানের দায়িত্ব এদেরই। নিঃসঙ্গ মহাশূন্যে এরাই নভোচারীদের পাশে থাকবেন সর্বক্ষণ। এই মিশনে প্রধান মিশন কন্ট্রোলার ছিলেন জিন ক্রাঞ্জ। মিশন কন্ট্রোল রুমটা ছিল সিগারেটের ধোঁয়ায় আছন্ন। কফি আর সিগারেট এই দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের কাঁটিয়ে দিতে হত।
![]() |
মিশন কন্ট্রোল রুম। |
উড্ডয়নের ৫৫ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ১৮ সেকেন্ড পর্যন্ত ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন ট্যাংকের কাজ ঠিকভাবেই চলে। কিন্তু এরপর মিশন কন্ট্রোলের নির্দেশ অনুযায়ী জেমস এ লভেল ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন ট্যাংকের সুইচ অন করতেই শর্ট সার্কিট ঘটে। ফ্যানের ভিতর শর্ট সার্কিটের ফলে সেখানকার তারে আগুন লেগে যায়। এতে ট্যাংকের ভিতর তাপমাত্রা এবং চাপ বৃদ্ধি পায়। দুই নাম্বার ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন ট্যাংকের ভিতর চাপ হয় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১০০৮ পাউন্ড। এরপর ৯ সেকেন্ডের ভিতর চাপ কমতে থাকে। কিন্তু প্রেসার নিয়ন্ত্রণের ভালভের কোন একটি সমস্যার ফলে আবার চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সিকি সেকেন্ড পর একটি কম্পন পার্থক্য ধরা পরে কমান্ড মডিউলের এক্সেলোমিটারে। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভিতর এরপরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। একটি ট্যাংক লাইন ভ্যাকিউম জ্যাকেটের তাপের কারণে বিস্ফোরিত হয়। আর ভ্যাকিউম জ্যাকেটের প্লাগ ছিড়ে যায়। কমান্ড মডিউলের ভিতর চাপ বৃদ্ধি এর বোল্টগুলোকে দুর্বল করে দেইয় এবং কাছাকাছি থাকা একটি যোগাযোগ অ্যান্টেনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পৃথিবীর সাথে ১৮ সেকেন্ডের জন্য নভোচারীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর অ্যান্টেনার ব্যান্ড পরিবর্তন করে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
![]() |
অ্যাপোলো ১৩ এর বিধ্বস্ত সার্ভিস মডিউল। |
যান্ত্রিক শকের ফলে এক এবং তিন নম্বর ফুয়েল ব্যাটারি অক্সিজেন ভালভ ৩ মিনিটের ভিতর বন্ধ হয়ে যায়। এই ঝাঁকুনির ফলে এক নম্বর অক্সিজেন ট্যাংকের ভিতর সরবরাহ ব্যবস্থায় ফাটল ধরে এবং এর ভিতরের অক্সিজেন পরবর্তী ২ ঘণ্টার ভিতর মহাকাশে চলে যায়। যেহেতু ফুয়েল সেলগুলো হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন থেকে বিদ্যুৎ এবং জল উৎপাদন করে দুই নম্বর ফুয়েল ব্যাটারি বন্ধ হয়ে যায় । নভোচারীরা কমান্ড মডিউল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং লুনার মডিউলকে ‘লাইফ বোট’ হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হন। কমান্ড মডিউলটি আবার ব্যবহার করা হয় প্রবেশের সময়।
![]() |
লুনার মডিউল একুইরিয়াসঃফিজির আকাশে ধ্বংস হয় যায়। |
লুনার মডিউল না থাকলে ফলাফল হয়ত অন্যরকম হত। কার্বন ডাই অক্সাইড দূর করতে লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এতে কমান্ড মডিউল এবং লুনার মডিউলের কার্টিজ ব্যবহার করা হয়। কারণ লুনার মডিউলের পক্ষে একা এই কাজ করা সম্ভব হত না। এই সময়গুলোতে মিশন কন্ট্রোলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছোট লুনার মডিউলে দুইজন মানুষ আড়াই দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তিনজন মানুষ ৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে না। এই জন্য লুনার মডিউলের কর্মক্ষমতা কমিয়ে আনা হল সর্বনিম্ন পর্যায়ে। মিশন কন্ট্রোল থেকে পৃথিবীতে ফেরার দুটি সম্ভাব্য রাস্তা বের করা হল। একটি হল ইউটার্ন দিয়ে চাঁদের সামনে থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা। কিন্তু এই কাজ করতে হলে প্রধান ইঞ্জিনটি চালু করতে হবে। যেটি ক্ষতিগ্রস্থ ট্যাংকের পাশে। কিন্তু প্রধান ইঞ্জিনটি চালু না হলে নভোচারীরা সোজা চাঁদের বুকে আছড়ে পরবেন। অতএব বিকল্প রাস্তা বেঁছে নিলেন তারা। চাঁদকে অতিক্রম করে ঘুরে এসে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসা। এতে কয়েকদিন সময় লাগবে।
![]() |
পৃথিবীতে ফেরার দুটি সম্ভাব্য রাস্তা। |
লুনার মডিউল চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০ কিমি উপর হতে যাত্রা শুরু করার কথা। কিন্তু একে ব্যবহার করা হয় আড়াই লাখ মাইল অতিক্রম করতে। এটা জানা দরকার এখনকার আইফোন বা ব্ল্যাকবেরি ফোনে যে পরিমাণ সফটওয়ার ব্যবহার করা হয় ১৯৭০ এর স্পেসশিপ গুলোতে ব্যবহার করা সফটওয়ার সেই তুলনায় কিছুই না। তাই অতি হিসাব করেই তাদের নভোযানের গতিপথ পরিবর্তন করতে হয়। ১৯৭০ সালের ১৭ এপ্রিল। ৬ দিন পর ধরিত্রী মাতার সন্তানরা ঘরে ফিরে আসার পালা। পৃথিবীতে ফেরার সময় প্রথমে সার্ভিস মডিউলটি এরপর লুনার মডিউল একুইরিয়াস পরিত্যাগ করা হয়। এরপর কমান্ড মডিউল ওডিসিতে আবার প্রবেশ করেন নভোচারীরা। সারা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে থাকে কি ঘটছে জানতে। বিশেষ করে নভোচারীদের পরিবারের সদস্যরা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় কমান্ড মডিউলের চারপাশে বায়ু আয়নাইজেশন হয়ে ৪ মিনিটের জন্য মিশন কন্ট্রোলের সাথে নভোচারীদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একে ব্ল্যাক আউট বলে। কিন্তু মিশন কন্ট্রোলের ক্রুদের মাঝে একটা শঙ্কা কাজ করে। নভোযানের তাপ প্রতিরোধ শিল্ড কি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে? তাহলে তো আর কোন সম্ভাবনা নেই। সবাই মিশন কন্ট্রোলের ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে সময় গণনা করতে লাগলেন। ব্ল্যাক আউটের ৩৩ সেকেন্ড পর যখন লভেলের গলা শোনা গেল মিশন কন্ট্রোলের ক্রুরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই তখন কাঁদছেন। সাফল্যের কান্না।
![]() |
মিশন কন্ট্রোল রুমে আনন্দ। |
কমান্ড মডিউল ওডিসি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে আছড়ে পরে। তাঁদের উদ্ধার করে মার্কিন জাহাজ ইউএসএস আইও জিমা।
নভোচারীরা সবাই সুস্থ ছিলেন কেবল হাইসের ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন হয়েছিল কম জল পান করার কারণে। নভোচারীদের বলা হয়েছিল মূত্রত্যাগ করার পর সেই মূত্রভর্তি ব্যাগ মহাকাশে ফেলে না দিতে। এটা করতে গেলে তাদের যানের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। ঝামেলার জন্য নভোচারীরা অনেকক্ষণ ধরে মূত্রত্যাগও করেন নি।
পরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তিন নভোচারী এবং অ্যাপোলো ১৩ এর পরিচালনা টিমকে Presidential Medal of Freedom পদকে ভূষিত করেন। এদের ভিতর জন এল সুইগারট ১৯৮২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ক্যান্সারে মারা যান। অ্যাপোলো ১৩ এর ক্রুরা পৃথিবী থেকে সব থেকে দূরে যাত্রার রেকর্ড করেন। তারাই একমাত্র এত বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও ফিরে আসেন সুস্থ শরীরে।
এই অভিযানটিকে "সফল ব্যর্থতা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আসলে মানুষ যেসময় একে অন্যের জন্য যুদ্ধ করা বন্ধ করে দিবে সেই সময় মনুষ্যত্ব পরাজয় ঘটবে। অ্যাপোলো ১৩ অভিযান ছিল মনুষ্যত্ব বিজয়।
লেখকঃ নিঃসঙ্গ গ্রহচারী।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
এই অভিযানটিকে "সফল ব্যর্থতা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আসলে মানুষ যেসময় একে অন্যের জন্য যুদ্ধ করা বন্ধ করে দিবে সেই সময় মনুষ্যত্ব পরাজয় ঘটবে। অ্যাপোলো ১৩ অভিযান ছিল মনুষ্যত্ব বিজয়।
লেখকঃ নিঃসঙ্গ গ্রহচারী।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন