বার্লিন দেয়ালের ।। Berlin Wall

১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট। এদিন হঠাৎই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো জার্মানীর শহর- বার্লিনের অধিবাসীদের উপরে। বিষয়টা কী? পূর্ব জার্মানী আর পশ্চিম জার্মানীর মাঝে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দুই জার্মানীকে আলাদা করে ফেলা হবে। ভাবছেন, এতে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে কেন? আরে, এভাবে বার্লিন শহরের ওপরে প্রাচীর তৈরি করে দুই জার্মানীকে আলাদা করে ফেলা হবে, একথা বার্লিনবাসী ঘূণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। এই প্রাচীরের কারণেই যে বহু পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল পরস্পর থেকে। পশ্চিম বার্লিন পরিণত হয়েছিল পূর্ব জার্মানীর একটি ছিটমহলে। চিন্তা করে দেখেন, আপনার আত্মীয়-স্বজন কিংবা যে বন্ধুর সঙ্গে আগের দিন বিকেলবেলা দেখা করলে, পরদিন থেকে তাকে যদি আর দেখতে না পান শুধুমাত্র একটা দেয়ালের কারণে, কেমন লাগবে আপনার? পশ্চিম আর পূর্ব বার্লিনবাসীদেরও মনের অবস্থা হয়েছিল তেমনই। অবশ্য ২৮ বছর পর ১৯৮৯ সালে এই প্রাচীর ভেঙেও ফেলতে হয়েছিলো। দুই বার্লিনকেও এক করে ফেলা হয় তখন। আজ চলেন এই বার্লিন প্রাচীরের কিছু কথা শুনে আসি।


বার্লিন ওয়ালঃ
১২ আগস্ট, ১৯৬১। পূর্ব জার্মান নেতৃবৃন্দ ডলসি উদ্যানে (উস্খষষহংবব) আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনার বিষয়বস্তু, পরদিন থেকেই প্রাচীর নির্মাণ করা শুরু হবে। যেই কথা সেই কাজ। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির মাঝে প্রকৃত সীমারেখা ও কাঁটাতারের বেড়া; দেয়াল, মাইনক্ষেত্র এবং অন্যান্য স্থাপনা দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট, রবিবার প্রথম প্রহরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ প্রাচীরের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল জানেন? মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব জার্মানি থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোতে বাধা প্রদান, পাশাপাশি আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের দাবি অনুযায়ী এ প্রাচীরের মাধ্যমে পূর্ব জার্মানি এবং ওয়ারশ ব্লক ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে পশ্চিমা গুপ্তচরদের (বিশেষ করে মার্কিন গুপ্তচর) অনুপ্রবেশ রোধ করা হয়। পশ্চিম বার্লিনের চারপাশে ১৫৬ কিমি দীর্ঘ এ দেয়ালের ৪৩ কিমি সরাসরি দু'অংশকে পৃথক করে ফেলে। প্রাচীরের নির্মাণের কাজের সময় কেউ কেউ পশ্চিমাংশে চলে যেতে পারে; এই আশংকায় পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনী দেয়ালের সামনে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। পশ্চিম বার্লিনের কোনো অংশ যেন পূর্বাংশের মধ্যে চলে না আসে, সেজন্য পূর্ব বার্লিনের খানিকটা ভেতরেই এই প্রাচীর তৈরি করা হয়।


দেয়ালের মাপজোকঃ
১৫৬ কিমি প্রাচীরটি গড়ে তোলা হয় পূর্ব জার্মানীর ১০০ গজ ভেতরে। এই ১০০ গজের মধ্যে থাকা বাড়িঘর এবং স্থাপনা ধ্বংস করে একটি ‘নোম্যান্সল্যান্ড’ তৈরি করা হয়। এখানকার অধিবাসীদের সরিয়ে নেওয়া হয় অন্য জায়গাতে। ১০০ গজের এই নিরপেক্ষ এলাকাটি পরিচিত ছিলো ‘মৃত্যু ফাঁদ’ হিসেবে। পায়ের চিহ্ন সহজে চিহ্নিত করার জন্য এ অংশটি নুড়ি এবং বালু দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়। স্থাপন করা হয় স্বয়ংক্রিয় ফাঁদ, যেগুলো কারও পায়ের স্পর্শে সচল হয়ে উঠবে। স্পষ্ট দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকায় প্রহরীদের গুলি চালানোর জন্যও সুবিধাজনক এলাকা হিসেবে এ অংশটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার, চিন্তা করে দেখেন একবার!


এখন নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, এভাবে দেয়াল তুলে পূর্ব জার্মানী কি তাহলে নিজেদেরকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেললো না? হুমম্... সেটা ঠিকই ধরেছেন। আর এজন্যই পূর্ব এবং পশ্চিম বার্লিনের মাঝে যাতায়াতের জন্য আটটি আনুষ্ঠানিক পথ অবশ্য রাখা হয়। পশ্চিম বার্লিনবাসী, পশ্চিম জার্মান নাগরিক , পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিক , অন্যান্য দেশের নাগরিক, অনুমতিপ্রাপ্ত পূর্ব বার্লিনবাসীরা এ পথগুলো ব্যবহার করতেন। পশ্চিম বার্লিন এবং একে ঘিরে থাকা পূর্ব জার্মানির অন্য অংশগুলোর মাঝেও কয়েকটি যাতায়াতের পথ ছিল । পশ্চিম বার্লিনবাসীরা পূর্ব জার্মানি , পশ্চিম জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ যেমন ডেনমার্ক , চেকোস্লাভাকিয়াতে এখন যার নাম চেক রিপাবলিক, সেখানে যাওয়ার জন্য এবং পূর্ব জার্মানদের পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশের জন্য এগুলো ব্যবহৃত হতো।


সীমানা পেরিয়েঃ
তারপরও কিন্তু মানুষ বিভিন্ন সময়ে পূর্ব জার্মানী থেকে পশ্চিম জার্মানীতে পালিয়ে আসতো। প্রথম কে পালিয়েছিলো জানো? ১৫ আগস্ট ১৯৬১ প্রাচীর নির্মাণে তদারকিতে নিয়োজিত কনার্ড শুম্যান নামে পূর্ব জার্মানীর এক প্রহরী কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে লাফিয়ে পশ্চিম বার্লিনে চলে আসেন। পরবর্তীতে মাটির নিচে টানেল খুঁড়ে, ঝোড়ো বাতাসের সাহায্য নিয়ে লাফিয়ে পড়ে, তার বেয়ে, বেলুনে চেপে, স্পোর্টসকার চালিয়ে চেকপোস্টের দরজা ভেঙ্গে প্রাচীর অতিক্রমের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা এড়াতে চেকপোস্টে ধাতব বার স্থাপন করা হয়, যাতে মোটরগাড়ি এতে বাধা পায়। কিন্তু এরপরও চেষ্টা থেমে থাকেনি। ৪ জন আরোহী বিশেষভাবে তৈরি স্পোর্টসকার চালিয়ে বারের নিচ দিয়ে প্রাচীরের দরজা ভেঙ্গে পশ্চিম পাশে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিলো।


প্রাচীর অতিক্রমের চেষ্টায় গুলিতে আহত হয়ে কেউ দুই বার্লিনের মাঝে নিরপেক্ষ অংশে পড়ে থাকলেও পশ্চিম জার্মানদের পক্ষে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। নিরপেক্ষ অংশের সঙ্গে পশ্চিম বার্লিনের কেবল কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও নিরপেক্ষ অংশটি পূর্ব জার্মানিরই অংশ ছিল। ফলে উদ্ধার প্রচেষ্টা চললে পূর্ব জার্মান সীমানা প্রহরীদের কাছ থেকে গুলিবর্ষণের আশংকা থাকতো। এরকম ঘটনাগুলোর প্রথমটি ঘটে ১৯৬২ সালের ১৭ আগস্ট। পিটার ফ্লেচার নামে ১৮ বছরের এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় পশ্চিমাংশে পড়ে থাকেন। পশ্চিমা মিডিয়ার সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই রক্তক্ষরণের কারণে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সর্বশেষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। প্রাচীর অতিক্রমের ঘটনায় ঠিক কতোজন মারা গেছেন, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।


চেকপয়েন্ট চার্লি আর মানুষের মৃত্যুঃ
চেকপয়েন্ট চার্লি মিউজিয়ামের ডিরেক্টর আলেকজান্ড্রা হিলডেব্রান্ড (Alexandra Hildebrandt) এর মতে মৃতের সংখ্যা ২০০। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কনটেম্পরারি হিস্টরিকাল রিসার্চ এর মতে মৃতের সংখ্যা ১৩৩। পূর্ব জার্মান কর্তৃপক্ষ প্রাচীর অতিক্রমের চেষ্টাকারী যে কাউকে দেখামাত্র গুলি করার জন্য সীমান্ত প্রহরীদের নির্দেশ দিয়েছিলো, এমনকি নারী আর শিশুদের ক্ষেত্রেও এই আদেশ ছিলো সমান কার্যকর।


এভাবে চলতে চলতে ২৮ বছর কেটে গেল। পূর্ব জার্মানীর মানুষেরা এরই মধ্যে অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো এই প্রাচীরের কারণে। ২৩ আগস্ট, ১৯৮৯ হাঙ্গেরি সরকার অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্তে কড়াকড়ি প্রত্যাহার করে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ১৩ হাজার পূর্ব জার্মান পর্যটক পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার জন্য হাঙ্গেরি হয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে। এদিকে অক্টোবর মাসে পূর্ব জার্মানিতে শুরু বিক্ষোভ। ১৮ অক্টোবর দীর্ঘদিন পূর্ব জার্মানি শাসনকারী এরিক হোনেকার পদত্যাগ করেন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এগোন ক্রেনজ। সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হওয়া বিক্ষোভের প্রথমদিকে স্লোগান ছিলো- আমরা বাইরে (পশ্চিম জার্মানি) যেতে চাই (Wir wollen raus!)| । এটির বদলে নতুন স্লোগান শুরু হয়- ‘আমরা এখানেই থাকবো’ (Wir bleiben hier), , যেটি জার্মান ঐক্যের পক্ষে আন্দোলনের ইংগিত দেয়। নভেম্বরের ৪ তারিখ পূর্ব বার্লিনের আলেকজান্দারপ্লাত্জ এ (Alexanderplatz) ১০ লাখ বিক্ষোভকারী সমবেত হয়।


অবশেষে মানুষের জয়ঃ
ক্রেনজ সরকারের সহনশীল নীতি এবং কমিউনিস্ট চেকোস্লাভ সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব জার্মান শরনার্থীরা চেকোস্লাভাকিয়া হয়ে পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পায়। ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপ ঠেকাতে ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ ক্রেনজের নেতৃত্বে পার্টি পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানীর মধ্যে সীমান্ত চৌকি দিয়ে সরাসরি শরণার্থীদের যাবার অনুমতি প্রদান করা হবে। পূর্ব জার্মান সীমান্ত রক্ষীদেরকে সিদ্ধান্তটি জানানোর জন্য ১ দিন সময় নিয়ে ১০ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্ব জার্মান প্রচারমন্ত্রী গুন্টার সাবোয়স্কিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ৯ নভেম্বরের পূর্বে সাবোয়স্কি ছুটিতে থাকায় এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি জানতেন না। একই দিনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আগমুহূর্তে তাকে ঘোষণাপত্রটি ধরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কবে থেকে এটি কার্যকর করা হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণাটি দেওয়ার পর এটি কবে কার্যকর হবে এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান যতদূর জানি, এই মুহুর্ত থেকেই কার্যকর হবে।


ব্যাস, আর যায় কোথায়। দুই জার্মানীর মানুষ যেন এই ঘোষণারই অপেক্ষায় ছিল। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার পূর্ব বার্লিনবাসী প্রাচীরের কাছে সমবেত হয়ে পশ্চিম বার্লিনে যেতে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। এ অবস্থায় গণদাবির মুখে সীমান্তরক্ষীরা দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। অপর পাশে হাজার হাজার পশ্চিম বার্লিনবাসী উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের স্বাগত জানায়। এভাবেই ৯ নভেম্বর , ১৯৮৯ অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রাচীরের পতন হয়। পূর্ব জার্মান সরকার ঘোষণা করে প্রাচীরে আরও নতুন দশটি চলাচলের পথ খুলে দেয়া হবে । ১৯৯০ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত পুরনো বার্লিনের এসব পথ খুলে দেয়া হতে থাকে। সে বছর ২৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় দুই বার্লিনের মধ্যে ভিসামুক্ত চলাচল। ভেঙ্গে ফেলা হয় বার্লিন প্রাচীর। আবার এক হয়ে যায় দুই জার্মানী।

লেখকঃ তাহসান আহমেদ।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info