নাগাসাকির বুকে ফ্যাটম্যান ।। Fatman On Nagasaki

৬ অগাস্ট আর ৯ অগাস্ট। সভ্যতার ইতিহাসে দুইটি কালো দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪৫ সালের এই দুইদিনে প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো। কোথায় করা হয়েছিলো জানেন? জাপানের দুইটি শহর, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। সেই গল্পের খানিকটা তো আপনাদের আগেই বলা হয়েছে। ‘হিরোশিমা কথা কয়’ নামের লেখাতে তো এর আগে হিরোশিমা শহরে সেই বোমা বিস্ফোরণের পুরো গল্পই বলা হয়েছিলো।


নাগাসাকি শহরটির জন্ম হয় ষোড়শ শতকের শেষদিকে। তার আগে যে এখানে কোনো মানুষ থাকতো না, তা অবশ্য নয়। আগে এখানে ছোট ছোট কিছু গ্রাম ছিলো, কিউশু প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। কেন নাগাসাকি শহরটির দরকার পড়লো? দাঁড়ান, বলছি।


পর্তুগালের সাথে ততোদিনে জাপানের ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। শুধু তাই না, পর্তুগিজরা চীন আর জাপানের মধ্যেও মালামাল কেনা বেচা করতো। ভাবছেন, চীন আর জাপান নিজেরা কেন ব্যবসা করতো না? উয়োকোদের নাম শুনেছেন? ওরা হলো জলদস্যু। প্রথমদিকে এই জলদস্যুরা ছিলো মূলত জাপানি। পরে অনেক চীনা জলদস্যুরও উদ্ভব হয়। এই জলদস্যুদের নিয়ে চীন আর জাপানের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যায়। পরে ওরা নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যই বন্ধ করে দেয়। তখন পর্তুগিজরা ওদের মধ্যে মালামাল আনা নেওয়া করতো। আর জাপানের সঙ্গে তো পর্তুগিজদের ব্যবসা শুরু হয়েই গেছে। এখন, ওই কিউশু প্রদেশ দিয়ে মালামাল কেনা-বেচা করলে পর্তুগিজদের বেশ সুবিধা হয়। কিন্তু ওখানে তো কোনো বন্দরই নেই। ওখানে একটা সমুদ্রবন্দর বানালে পর্তুগিজদের ভীষণ সুবিধে হয়। ওদিকে কিউশু প্রদেশের তখনকার জমিদার ওমুরা সুমিতাদা, তিনিও দেখলেন, পর্তুগিজদের বন্দর বানাতে দিলে তারও ভীষণ সুবিধে হয়। সেখানে বন্দর হলে তিনিও তো খাজনা আদায় করতে পারবেন। ১৫৬৯ সালে ওমুরা সুমিতাদা পর্তুগিজদের বন্দর বানানোর অনুমতি দিলেন। আর সে বন্দর বানানো শেষ হলো ১৫৭১ সালে। আর বন্দর যখন হয়ে গেল, জনবসতিও বাড়তে লাগলো দ্রুত। বন্দরকে ঘিরে যেমন অনেক মানুষের চাকরি হলো, অনেক মানুষ ব্যবসাও ফেঁদে বসলো। খুব দ্রুতই নাগাসাকি বেশ বড়ো সড়ো এক শহরে পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু অনেক পুরোনো শহর হওয়াতে নাগাসাকির একটা সমস্যাও ছিলো। শহরটি অনেক বেশি অগোছালো, অপরিকল্পিত। বাড়িগুলোও অনেক বেশি গা ঘেঁষাঘেষি করে বানানো। আগুন লাগলে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে পারে।


আর হিরোশিমা শহরের সঙ্গে নাগাসাকির আরেক জায়গায় পার্থক্য ছিলো। এটা তো জানেনই, জাপানিরা সাধারণত কাঠ দিয়ে বাড়ি বানায়। কেন? ওদের ওখানে আবার খুব ভূমিকম্প হয়। জাপানকে বলাই হয় ভূমিকম্পের দেশ। কাঠ দিয়ে বাড়ি বানালে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তা হলো, সেটা নড়বড় করে বটে, সহজে ভেঙে পড়ে না। আর ভেঙে পড়লেও আঘাতের পরিমাণটা কম হয়। ভেঙে যখন পড়বেই, কংক্রিটের ছাদ আপনার মাথায় ভেঙে পড়ার চেয়ে কাঠের ছাদ ভেঙে পড়াটা কম বিপদের না? এখন, হিরোশিমা শহরটিতে অনেক বেশি কলকারখানা ছিলো। আর জাপানি সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনাও ছিলো শহরটিতে। ওই শহরে তাই কংক্রিটের বাড়িঘর ছিলো অপেক্ষাকৃত বেশি। আর নাগাসাকিতে কাঠের বাড়িঘরই ছিলো বেশি।


তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগাসাকিতে যে কিছু ছিলো না, তাও না। জাপানের তখনকার সবচেয়ে বড়ো সমুদ্রবন্দরের একটি ছিলো নাগাসাকি। আর জাপানের যুদ্ধের অধিকাংশ সরঞ্জামও তৈরি হতো নাগাসাকিতেই। মিৎসুবিশির নাম শুনেছেন না? জাপানি এই কোম্পানিটি সে সময় জাপানের জন্য যুদ্ধবিমান আর যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে দিচ্ছিলো। জাহাজ ধ্বংস করার যে টর্পেডো, সেটাও তারা তৈরি করতো। এই মিৎসুবিশির কারখানাটিও ছিলো নাগাসাকিতে। বিশ্বযুদ্ধের কথা যখন চলেই আসলো, তখন মূল গল্পতে যাওয়া যাক, কি বলেন? ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মান নাৎসি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। আর এই আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পাশে, মানে এশিয়া আর আমেরিকায় তখনো যুদ্ধ চলছে, বিশেষ করে এশিয়ায়। যুদ্ধ চলছিলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, চীনের সঙ্গে জাপানের। ভাবছেন, বৃটেন তো ইউরোপের দেশ। তারা এখানে এসে যুদ্ধ করছে কেন? আরে, তখন তো এশিয়ার একটা বড়ো অংশই ছিলো বৃটেনের দখলে। জার্মানরা আত্মসমর্পণ করার খবর পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, চীনের যৌথবাহিনী জাপানকেও আত্মসমর্পণ করতে বলে। সঙ্গে এও বলে হুমকিও দিলো যে আত্মসমর্পণ না করলে জাপানে ভীষণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হবে। কিন্তু জাপানের সম্রাট হিরোহিতো সেই হুমকিকে থোড়াই কেয়ার করলেন। সাফ জানিয়ে দিলেন, জাপান পরাজয় স্বীকার করবে না। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটন প্রজেক্ট নামের এক প্রজেক্টে পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছিলো। তারা ঠিক করলো, জাপান যখন কথাই শুনছে না, ওদের ওপর পারমাণবিক হামলা করা হবে। এই হামলা করা দরকার ছিলো কিনা, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে, তবে কাজটা কিন্তু মোটেও ভালো হলো না। এতোবড়ো ধ্বংসযজ্ঞ মানুষের ইতিহাসে যে আগে পরে কখনোই হয়নি।


৬ অগাস্ট ১৯৪৫। জাপানের হিরোশিমা শহরে প্রথম পারমাণবিক হামলা চালানো হলো। সেই হামলার ভয়াবহতার কথা আপনারা পড়েছেন। আজকে বলবো তার তিনদিন পরের হামলার ঘটনাটা, নাগাসাকি শহরে হামলার কথা, ফ্যাটম্যান নামের পেট মোটা পারমাণবিক বোমাটির ভয়াবহতার কথা। প্রথম পারমাণবিক হামলার পরও অবশ্য জাপান পরাজয় স্বীকার করলো না। ওদিকে রাশিয়া এতোদিন শুধু জার্মানদের সঙ্গেই যুদ্ধ করছিলো। জার্মানদের পরাজয়েও যখন জাপান হার মানলো না, তখন তারা জাপানের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করলো।


দ্বিতীয় পারমাণবিক হামলাটা অবশ্য তিনদিন পরে নয়, পাঁচদিন পরে, মানে ১১ অগাস্ট হওয়ার কথা। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানা গেল, ১০ অগাস্ট থেকে টানা পাঁচদিন আবহাওয়া খারাপ থাকবে। আর খারাপ আবহাওয়ায় তো জায়গামতো বোমাই ফেলা যাবে না। সুতরাং, বোমা হামলাও এগিয়ে আনা হলো দুইদিন, ৯ অগাস্ট। তার আগের দিন, ৮ অগাস্ট, বোমা হামলার একটা মহড়াও দেয়া হলো। সেদিনের হামলার টার্গেট কিন্তু নাগাসাকি ছিলো না, কোকুরা নামের আরেক শহরে হামলা করার কথা ছিলো। মিশনের নাম ছিলো স্পেশাল মিশন সিক্সটিন। প্রথমে এনোলা গে আর ল্যাগিন ড্রাগন নামের দুটো বিমান পাঠানো হলো যথাক্রমে কোকুরা আর নাগাসাকিতে। তাদের পাঠানো রিপোর্ট দেখে জানা গেলো, কোকুরার আবহাওয়া খুব একটা ভালো না। সেখানে এতো বেশি মেঘ করেছে, হামলা চালানোই যাবে না। তুলনামূলকভাবে নাগাসাকিতে বোমা হামলা চালানোই ভালো। মিশনে আরো চারটি বিমান ছিলো। তারমধ্যে বক্সকার নামের বিমানটাই বহন করছিলো ফ্যাটম্যানকে। বাকি তিনটা বিমান হলো, দি গ্রেট আর্টিস্ট, বিগ স্টিংক আর ফুল হাউজ। গ্রেট আর্টিস্টে ছিলো বিস্ফোরণের ভয়াবহতা পরিমাপের যন্ত্রপাতি। বিগ স্টিংকের কাজ ছিলো হামলা পর্যবেক্ষণ করা আর ছবি তোলা। আর ফুল হাউজের দায়িত্ব ছিলো, লাগলে আরো আক্রমণ করা। বলাই বাহুল্য, ফুল হাউজকে তার কাজ করতেই হয়নি। সকাল ১১টা বাজার একটু আগে, গ্রেট আর্টিস্ট থেকে তিনটি প্যারাসুটে করে কিছু জিনিসপত্র ফেলা হলো, সেই সঙ্গে কিছু চিঠি। তাতে লেখা ছিলো, যে পারমাণবিক বোমাটি ফেলা হবে, সেটি কতো শক্তিশালী, আর এর বিস্ফোরণ কতো ভয়ংকর হবে। ১১টা ১মিনিটে মেঘ একটু কাটলে বক্সকার থেকে ফ্যাটম্যানকে নিচে ফেলা হলো। ঠিক ৪৩ সেকেন্ড পরে মাটি থেকে ৪৬৯ মিটার উপরে বিস্ফোরিত হয় ৬.৪ কেজি প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ বোমাটি।


মেঘের জন্য বোমাটি অবশ্য জায়গামতো ফেলা যায়নি। যে জায়গায় পড়ার কথা, পড়েছিলো তার ৩ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে। মিৎসুবিশির দুটো কারখানার মাঝখানে। বিস্ফোরণের শক্তি ছিলো প্রায় ২১ কিলোটন টিএনটির বিস্ফোরণের সমান। আর বিস্ফোরণের ফলে ওখানকার তাপমাত্রা হয়েছিলো ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষ। আর ৪৫ সালের শেষদিকে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ হাজারে। এরমধ্যে ২ হাজার কোরিয়ান শ্রমিকও ছিলো। ছিলো ৮ জন যুদ্ধবন্দীও। আহত হয় আরো প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। শুধু তাই না, বিস্ফোরণের ফলে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১ মাইল এলাকা জুড়ে। তেজস্ক্রিয়তা তো আর চট করে মিলিয়ে যায় না। এই তেজস্ক্রিয়তার কারণে আরো কতো যে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।


পরের দিন, ১০ অগাস্ট, জাপানি সরকার সুইজারল্যান্ডের সরকারের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে চিঠি পাঠায়, আর কোনো পারমাণবিক হামলা না চালানোর জন্য। আর ১২ অগাস্ট জাপানি সম্রাট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। ১৪ অগাস্ট সম্রাট হিরোহিতো আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অডিও বার্তায় আত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণাটি জাপানি জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়। তবে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে যে ঘোষণাটি তিনি দেন, সেটি প্রচারিত হয় ১৭ অগাস্ট। এরপরেও অবশ্য কিছু সৈন্য আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে অবশ্য তাদেরকেও নিরস্ত্র করা হয়।

এভাবেই ইতিহাসের বর্বরতম বোমা হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলো। তারপরও প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়, যুদ্ধ থামানোর কি আর কোনো উপায় ছিলো না? দুইটি পারমাণবিক বোমা হামলায় মারা গিয়েছিলো প্রায় ২ লাখ মানুষ। হামলার পরবর্তী তেজস্ক্রিয়তার কারণে অসুস্থতায় ভোগে আরো কতো মানুষ, তার কোনো লেখা জোখা নেই। যুদ্ধ চললেও কি এতো মানুষ মারা যেতো? এভাবে ধুলোয় মিশে যেতো কোন শহর? এসব প্রশ্ন করেও অবশ্য লাভ নেই, অতীতকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের কারো নেই। তবে, এই দুটি ঘটনা থেকে আমরা একটি শিক্ষা অবশ্যই নিতে পারি, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা চলবে না। পারমাণবিক শক্তিকে শুধু ভালো কাজেই ব্যবহার করতে হবে, ধ্বংসাত্মক কাজে নয়। আর এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য খোদ নাগাসাকিতেই স্থাপন করা হয়েছে নাগাসাকি পিস পার্ক। সেখানে দেয়া হচ্ছে একটিই বার্তা, "শান্তি চাই"।

লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদকঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info