আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক বহুমুখী এক প্রতিভাবান। তিনি যেমন কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন হাজার হাজার গান, উপন্যাস, তিনটি গল্পের বই, তিনটি নাটক, আরো কত্তো কিছু। শুধু তাই নয়, তিনি কিন্তু চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। কী অবাক করা বিষয়, তিনি এতো এতো লিখেছেন, তাও মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে, তার মধ্যে তিনি আবার চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন! এখন তিনি কোন কোন ছবিতে কাজ করেছিলেন, কি কাজ বা করেছিলেন, তা কী জানেন? চলেন তাহলে, আজকে আমরা চলচ্চিত্র জগতে নজরুলের পদচারণার সব খবরাখবর নিয়ে আসি।
ত্রিশের দশকের শুরু। কবি হিসেবে খ্যাতির চূড়োয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এরইমধ্যে তিনি রূপালি জগতে প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথম চলচ্চিত্রের রূপালি জগতে কাজ করেন সম্ভবত ১৯৩১ সালে। ভাবছেন, কাজ করেছেন তো কাজ করেছেন, সেখানে আবার সম্ভবত কেনো? আসলে, ওই ছবিটি সম্পর্কে যে নিশ্চিত প্রমাণসহ তেমন কিছু জানাই যায়নি। তবে এটুকু জানা যায়, তিনি সেই বছরে ‘ধূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নিজেই পরিচালনা করেন। শুধু পরিচালনা নয়, তিনি নাকি সেই ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন, ‘বিষ্ণু’ চরিত্রে।
এরপর আবার তিনি চলচ্চিত্রে কাজ করেন ‘ধ্রুব’ তে। সত্যেন্দ্রনাথ দে পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালে। ছবিটিতে গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক সবই ছিলেন তিনি নিজেই। শুধু তাই নয়, ছবিটিতে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। তাও আবার একেবারে প্রযোজকের অনুরোধে! ‘নারদ’ এর ভূমিকায়। কিন্তু মজা কি জানেন? অভিনয় করতে গিয়ে দেখা গেলো, নজরুল ক্যামেরার সামনে যাকে বলে পুরোই আনাড়ি। প্রথম দিন তো তিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে এমনই অস্বস্তি বোধ করলেন, পরিচালককে ডেকে বলেন, ভাই আমি গান লিখি, গান গাই, ক্যামেরার সামনে অভিনয় টভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। আপনারা বরং অন্য কাউকে দেখুন! পরে অবশ্য পরিচালক তাকে দিয়ে ঠিকই অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন। অভিনেতাকে দিয়ে অভিনয় না করাতে পারলে আর কিসের পরিচালক হলেন তিনি?
এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অবশ্য নজরুলের একটা খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো। ছবিটিতে তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন নিতাই ঘটক। চুক্তি অনুযায়ী নজরুলের পাওয়ার কথা ছিলো ৫০০ টাকা, আর নিতাই ঘটকের ৫০ টাকা। কিন্তু কিসের চুক্তি, কিসের কী! তারা পুরো টাকা পেলেনই না। আর তাই ওই প্রযোজক যখন আবার তার আরেকটি ছবি ‘মা’র সঙ্গীত পরিচালনার জন্য বললেন, নজরুল সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, না ভাই, তোমার কাজে আমি নাই।
এরপরের বছরেই মুক্তি পায় ‘পাতালপুরী’। ছবিটি পরিচালনা করেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কবি ছবিটির সঙ্গীত রচনা ও পরিচালনা করেন। আর তার সহকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। আর তার দুই বছর পর মুক্তি পায় ‘গ্রহের ফের’। কবি ছবিটিতে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। আর এই ছবিটির সংলাপ কে লিখেছিলেন জানেন? প্রেমেন্দ্র মিত্র। কি চিনতে পারছেন না? আরে, আপনাদের প্রিয় ঘনাদা’র স্রষ্টা!
এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অবশ্য নজরুলের একটা খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো। ছবিটিতে তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন নিতাই ঘটক। চুক্তি অনুযায়ী নজরুলের পাওয়ার কথা ছিলো ৫০০ টাকা, আর নিতাই ঘটকের ৫০ টাকা। কিন্তু কিসের চুক্তি, কিসের কী! তারা পুরো টাকা পেলেনই না। আর তাই ওই প্রযোজক যখন আবার তার আরেকটি ছবি ‘মা’র সঙ্গীত পরিচালনার জন্য বললেন, নজরুল সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, না ভাই, তোমার কাজে আমি নাই।
এরপরের বছরেই মুক্তি পায় ‘পাতালপুরী’। ছবিটি পরিচালনা করেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কবি ছবিটির সঙ্গীত রচনা ও পরিচালনা করেন। আর তার সহকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। আর তার দুই বছর পর মুক্তি পায় ‘গ্রহের ফের’। কবি ছবিটিতে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। আর এই ছবিটির সংলাপ কে লিখেছিলেন জানেন? প্রেমেন্দ্র মিত্র। কি চিনতে পারছেন না? আরে, আপনাদের প্রিয় ঘনাদা’র স্রষ্টা!
১৯৩৮ সালেই মুক্তি পায় দু’টি ছবি, যে দু’টি ছবিরই সংগীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল। তার একটার কাহিনীকার, গীতিকার ও সুরকার তো ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একবার ভাবেন, একটা ছবি, যার কাহিনী ও গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর সেই গানগুলোর দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম! ছবিটার নাম ‘গোরা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উপন্যাস আছে, ‘গোরা’, সেই উপন্যাস থেকেই ছবিটা বানানো হয়েছিলো। ছবিটি পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। এই ছবিটার কাজ যখন শেষ, ট্রেড শো, মানে ওই একরকম ট্রায়াল শো, সেই শো শেষে বিশ্বভারতীর বোর্ড মহা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দিলো। ওদের দাবি, নজরুলের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের গানগুলোর সুর নাকি ঠিকঠাক মতো হয় নি। আর যায় কোথায়, নজরুল সঙ্গে সঙ্গে ছবিটির একটি ফিল্ম, প্রোজেকশন মেশিন আর প্রযোজক মানু গাঙ্গুলিকে নিয়ে সটান চলে গেলেন শান্তিনিকেতন। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখিয়ে বললেন, গানগুলো চলবে তো? আর দেখেশুনে রবীন্দ্রনাথও অনুমতি দিয়ে দিলেন। না দিয়ে কিছু করার আছে? আসলে তাঁদের দু’জনের মধ্যে এমন একটা স্নেহের সম্পর্ক ছিলো; রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে স্নেহ করতেন ঠিক ছোট ভাইয়ের মতো, আর নজরুলও রবীন্দ্রনাথকে বড়ো ভাইয়ের মতোই সম্মান করতেন। আর তাই নজরুল একটা আবদার করবেন, আর রবীন্দ্রনাথ তা রাখবেন না, তাই কি হয়!
ঐ বছরে তাঁর আরেকটা ছবি ছিলো ‘বিদ্যাপতি’। আর এই ছবিতে তিনি শুধু সংগীত পরিচালকই ছিলেন না, ছিলেন কাহিনীকার ও গীতিকারও। সংগীত পরিচালক ও গীতিকারের পার্থক্য বুঝেছেন তো? গীতিকার গানের কথা লেখেন, সুরকার তাতে সুর দেন, আর সংগীত পরিচালক আর সব ঠিকঠাক করেন; কে গান গাইবে, কিভাবে গাইবে, কোন স্কেলে গাইবে, তার সঙ্গে গিটার, তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশি, ড্রামস, বেহালা, কী কী অনুষঙ্গ বাজানো হবে, কোনটা কিভাবে কোথায় বাজানো হবে, এই সব আরকি। ও এই ছবিটার আরো একটা ঘটনা আছে। পরে কিন্তু এই ছবিটার একটা হিন্দি রূপান্তরও করা হয়েছিলো! মানে কলকাতার ছবি রিমেক করা হয়েছিলো বলিউডে।
তার পরের ছবি বের হয় ঠিক এর পরের বছরেই, ১৯৩৯ সালে। ‘সাপুড়ে’ ছবির কাহিনীকার ও গীতিকার ছিলেন তিনি। সঙ্গে অবশ্য আরো একজন গীতিকার ছিলেন, অজয় ভট্টাচার্য। এই ছবিতে কিন্তু একটা মজার কাজ করা হয়েছিলো। ছবিটির একটি কাহিনীসংক্ষেপ লিখেছিলেন নজরুল নিজেই। আর সেটি যাকে বলে একেবারে ছাপিয়ে সিনেমা হলে বিক্রি করা হয়েছিলো! আর এই ছবিটিও কিন্তু হিন্দিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো।
১৯৪১ সালে মুক্তি পায় ‘নন্দিনী’। ছবিটির জন্য কবি একটি গান লিখে তাতে সুরও দিয়ে দেন। পরের বছর মুক্তি পায় ‘চৌরঙ্গী’। এটিরও গীতিকার ও সংগীত-পরিচালক ছিলেন কবি নজরুল। এই ছবিটিও হিন্দিতে করা হয়। আর সেটিরও আবহ সংগীত ও টাইটেল মিউজিক করে দেন নজরুল নিজেই। সঙ্গে অবশ্য হনুমান পণ্ডিত শর্মাও কাজ করেছিলেন। আর ওই হিন্দি চলচ্চিত্রেরও অন্যতম গীতিকার ছিলেন তিনি।
এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি ‘শহর থেকে দূরে’, ‘দিকশূল’ ছবিগুলোতে কাজ করেন। ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিটিতে তিনি গীতিকার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও ‘দিলরুবা’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিগুলোর সঙ্গেও নাকি যুক্ত ছিলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি।
এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি ‘শহর থেকে দূরে’, ‘দিকশূল’ ছবিগুলোতে কাজ করেন। ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিটিতে তিনি গীতিকার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও ‘দিলরুবা’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিগুলোর সঙ্গেও নাকি যুক্ত ছিলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি।
সাহিত্য জগতে যেমন কবি নজরুল ঝর্ণার মতো লিখে গেছেন একের পর এক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, তেমনি চলচ্চিত্রের রূপালি জগতে এসেও তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন নিরলস। একটার পর একটা ছবিতে সংগীত পরিচালনা করছিলেন, ছবির কাহিনী রচনা করে দিচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে তো সেজেগুজে অভিনয়ও করছিলেন। কিন্তু ঐ যে, তার নামই ছিলো দুখু মিয়া, দুর্ভাগ্য কখনোই তার পিছু ছাড়েনি, ১৯৪৩ সালেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন তিনি। থেমে যায় তার কলম, থেমে যায় তার গানের গলা। সাহিত্য জগতের মতো রূপালি জগতেও থেমে যায় তাঁর পদচারণা।
লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন