এক বীরকন্যার গল্প ।। Story Of A Hero

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা তো আপনারা জানেন। ১৯৭১ সালে অনেক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের স্বাধীনতার জন্য কিন্তু আরো অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেসব সংগ্রামের কথা কী আপনারা জানেন? ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা। সেই আমাদের পরাধীনতার শুরু। এরপর একটু একটু করে গোটা ভারতবর্ষই দখল করে নেয় ইংরেজরা। আর ইংরেজরা শুধু এদেশ দখল করেই বসে ছিলো না, এদেশের নিরীহ মানুষের উপর নানাভাবে অন্যায়, অত্যাচার আর শোষণ করতে শুরু করে দিলো। কিন্তু এদেশের মানুষ কি আর সেসব মুখ বুঁজে সহ্য করবে? তারা নানাভাবে প্রতিবাদ করতে লাগলো। দেশের তরুণ প্রজন্ম বৃটিশবিরোধী বিপ্লবে আর আন্দোলনে যাকে বলে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এই বৃটিশবিরোধী বিপ্লবেরই এক কিংবদন্তী যোদ্ধার নাম 'প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার'। নারী হয়েও যিনি সহিংস বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও দ্বিধা করেননি। শুধু বিপ্লবই করেননি, তিনি দেশের জন্য মৃত্যুকেও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আর দেখিয়ে গেছেন, মেয়েরাও দেশের জন্য কতো কিছু করতে পারে। সেই সাহসী বীরকন্যার জীবনের গল্পই আজ আপনাদের শোনাবো।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম ১৯১১ সালের ৫ই মে। আর ওনার জন্ম কিন্তু এই বাংলাদেশেই। চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে। আপনাদের যেমন আপনাদের মা আদর করে ডাকনামে ডাকে, তেমনি প্রীতিলতার মাও তাকে আদর করে ডাকতেন ‘রানী’ বলে। আর তার বিপ্লবী ছদ্মনাম ছিলো ‘ফুলতার’। নিশ্চয়ই ভাবছেন, ছদ্মনাম আবার কেন দেয়া হলো? আসলে বিপ্লবীদেরকে তো নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলতে হতো। নইলে ধরা পড়ে যাবে না! তাই তারা যখন কোন মিশন বা অপারেশনে যায় তখন নিজেদের ছদ্মনাম ব্যবহার করে, যাতে কেউ তাদের সত্যিকার পরিচয় জানতে না পারে। যাই হোক, প্রীতিলতার বাবার নাম ছিলো জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার আর মায়ের নাম ছিলো প্রতিভাদেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়।

নিশ্চয়ই ভাবছেন, ওনার নামটার প্রথম অংশটা কি সুন্দর, প্রীতিলতা। অথচ পদবীটা এতো খটমটে কেনো? ওর এই খটমটে পদবীর পেছনেও কিন্তু একটা গল্প আছে। আগে তাদের পরিবারের পদবী ছিল ‘দাশগুপ্ত’। এই পরিবারের কোনো একজন কোনো এক কালে নবাবী আমলে ‘ওয়াহেদেদার’ উপাধি পেয়েছিলেন। এই ওয়াহেদেদার থেকেই তাদের ‘ওয়াদ্দেদার’ বা ‘ওয়াদ্দার’ পদবীটা এসেছে। ছোটবেলায় প্রীতিলতা ছিলেন খুবই অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের। তার ছোটবেলার এরকম স্বভাব দেখে কেউ কিন্তু কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে তিনি বড় হয়ে এতো বড় একজন বিপ্লবী হবেন, দেশের জন্য দুঃসাহসিক সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আর দেখেন, সেই প্রীতিলতাই কি না দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিলেন!


১৯১৮ সালে প্রীতিলতা ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি দুর্দান্ত রেজাল্ট করেন। তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ভাবছেন, এ আর এমন কি রেজাল্ট? শুধু তো প্রথম বিভাগই পেয়েছে! কিন্তু তখনকার দিনে এই রেজাল্টই অনেক বড়ো ব্যাপার ছিলো। তখন তো আর টিচাররা এখনকার মতো এতো এতো নাম্বার দিতেন না। আর একটা মেয়ের জন্য তো এটা ছিলো আরও বেশি গৌরবের। কেননা তখন মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ছিলো খুবই কম। যাই হোক, এরপর প্রীতিলতা ভর্তি হলেন ঢাকার ইডেন কলেজে। I.A (H.S.C) পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেন।

ইডেন কলেজ থেকে পাশ করে প্রীতিলতা বেথুন কলেজে পড়াশুনা করতে শুরু করেন। এই সময়েই তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। তিনি যোগ দেন কিংবদন্তী বৃটিশ বিরোধী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের দলে। ক্রমেই তার মনে সরাসরি বিপ্লবে অংশগ্রহণের ইচ্ছা তীব্র হতে থাকে। আগে তো আর মেয়েদের সরাসরি কোনো আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হতো না। ওরা সবাই ছেলেদেরকে সাহায্য করার জন্য নানা কাজ করতো। কিন্তু প্রীতিলতার তো আর সেগুলোতে মন ভরে না। তিনি চান নিজে বিদ্রোহ করতে। অত্যাচারী বৃটিশদেরকে নিজ হাতে না মারলে যে তাঁর শান্তি হয় না! অবশেষে চট্টগ্রামের ইউরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণের দায়িত্ব পেলেন প্রীতিলতা। আর অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন আরেক কিংবদন্তী নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্ত।

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এই ইউরোপীয়ান ক্লাবটা আবার কি জিনিস? চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে ছিলো বৃটিশদের এই ক্লাব। এখানে বৃটিশরা একসাথে হয়ে নাচ-গান করতো! শ্বেতাঙ্গরা ছাড়া আর কেউ ওই ক্লাবের আশেপাশেই যেতে পারতো না। তবে ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান এরা সবাই বাঙালি ছিলো। ওরা অবশ্য যেতে পারতো। তারচেয়েও ভয়ানক কথা কি জানেন? ক্লাবের সামনে একটা সাইনবোর্ড ছিলো, আর তাতে লেখা ছিলো, ‘এখানে কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই রকম একটা ক্লাব কি সহ্য করা যায়! সুতরাং, এই ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

যেই কথা সেই কাজ। ১৯৩২ এর ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ঠিক করা হলো। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গেলো। কিন্তু তাদের কপাল ছিলো মন্দ। সেদিনের আক্রমণ ব্যর্থ হলো। তাই বলে কী আর আক্রমণ করা হবে না? অবশ্যই হবে। মাসখানেক পরেই আবারও পরিকল্পনা করা হলো ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের।

১৯৩২ এর ২৪ সেপ্টেম্বর ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন মাস্টারদা সূর্যসেন। তিনি ঠিক করলেন, এবার আক্রমণের দায়িত্ব কোন নারীর হাতে দেবেন। আর এ গুরুভার তিনি অর্পণ করলেন কল্পনা দত্তের উপর। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য দেখেন, অভিযানের সপ্তাখানেক আগে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলেন পুলিশের হাতে। এবার কি করা যায়? মাস্টারদা এবার অভিযানের দায়িত্ব তুলে দিলেন প্রীতিলতার কাঁধে।


কিন্তু কোন মেয়েকে তো আর সাধারণভাবে সহিংস হামলার অভিযানে পাঠানো যায় না। আর তখনকার দিনে ছেলেদের সাথে মেয়েদের ঘোরাঘুরিটাও ছিল বেমানান। এখনকার মতো তখন ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে ঘুরতে পারতো না। তাই ঠিক করা হলো প্রীতিলতাকে পাঠানো হবে ছেলেদের ছদ্মবেশে। হামলার দিন প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবীর সঙ্গে মালকোচা করে ধুতি পড়ানো হলো। চুল ঢাকার জন্য মাথায় বেঁধে দেয়া হলো সাদা পাগড়ি। আর পায়ে রবার সোলের জুতা। তখন আর প্রীতিলতাকে দেখে কারো বোঝারই উপায় নেই যে তিনি একজন মেয়ে। তাকে তখন দেখতে পুরো পাঞ্জাবী ছেলেদের মতোই লাগছিলো। আর এরকম পাঞ্জাবী ছেলের ছদ্মবেশ দেয়ারও কিন্তু একটা কারণ ছিল। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। আর এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। সুতরাং সন্দেহের আর কোন অবকাশই রইলো না। প্রীতিলতার সাথে আক্রমণে আরও অংশ নিয়েছিলেন কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী, মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে ও পান্না সেন।

তাদের দলে কিন্তু আরো একজন ছিলো। তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবে অংশ নেননি। কিন্তু তাকে ছাড়া তো এই আক্রমণ সম্ভবই হতো না। তার নাম যোগেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন ওই ইউরোপীয়ান ক্লাবের একজন বেয়ারা। তিনিই প্রীতিলতাদেরকে ক্লাবের যতো রাজ্যের তথ্য, সব দিয়েছিলেন। আর রাতে আক্রমণ শুরু করার সংকেতও তারই দেয়ার কথা।

সেদিন ছিল শনিবার। রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিট। প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিলো। প্রস্তুত পুরুষবেশী প্রীতিলতা ও তার দল। কেবল যোগেশ মজুমদারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষা। সময়মতো সেই সংকেতও চলে এলো। প্রীতিলতার দল তিন ভাগে ভাগ হয়ে ইউরোপীয়ান ক্লাবের তিন দিক দিয়ে এগিয়ে গেলো। পূর্বদিকের গেটে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। দক্ষিণের দরজায় ওয়েবলি রিভলবার হাতে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী। আর ৯ ঘরা পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন ও প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালায়। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দিলেন। মুহুর্তেই শুরু হলো গোলা-গুলি। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। নিভে গেলো বৃটিশদের প্রমোদ ক্লাবের সব বাতি। ভয়ে তারা ক্লাবের ভেতরে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করতে শুরু করে দিলো। ওদিকে আবার ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছেও রিভলবার ছিল। ওরাও পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করলো। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলি এসে লাগলো প্রীতিলতার শরীরে। তাতে কী? আরো কিছুক্ষণ চললো গোলাগুলি। সফল আক্রমণ শেষে প্রীতিলতার দল পিছু হটতে শুরু করলো। ভাবছেন, এতো কষ্ট করে আক্রমণ করে ক্লাব দখল না করেই ফিরে আসলো? আসলে ক্লাব দখল করাটা সে আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো না। বাঙালিদের অপমানের জবাব দেয়া আর বৃটিশদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়াই ছিলো সেই আক্রমণের উদ্দেশ্য। অনেকটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধাদের মতো আরকি।


নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, সেই আক্রমণে বৃটিশদের কি হলো? পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয়। আহত হয় আরো চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা। বুঝতেই পারছেন, আগের আক্রমণ ব্যর্থ হলেও এই আক্রমণটা মোটেও ব্যর্থ হয়নি। ইউরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণের ফলে বৃটিশরা সত্যি সত্যিই বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।

সফল আক্রমণ করলে কি হবে, প্রীতিলতার মনে কিন্তু আরো পরিকল্পনা ছিলো। এখনো তো মানুষ বলে, মেয়েরা ভীতু। আর ছেলেরা নাকি ভীষণ সাহসী। কিন্তু বীরকন্যা প্রীতিলতা কী আর তা মেনে নেবেন? মেয়েরা যে কতোটা সাহসী হতে পারে, দেশের জন্য তাদের প্রেম কতোটা গভীর হতে পারে, সবকিছু প্রমাণের দায়িত্বই যেনো তারই কাঁধে। আর তাই তিনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আক্রমণ শেষে তিনি মারা না গেলেও আত্মহত্যা করবেন। দেখিয়ে যাবেন, মেয়েরা কী করতে পারে। মেয়েরা মৃত্যুকেও ভয় করে না। মেয়েরাও ভীষণই সাহসী। তার এ সিদ্ধান্ত প্রথমে মাস্টারদা মেনে নেননি। কিন্তু প্রীতিলতার যুক্তির সামনে তিনিও হার মানলেন। আর তাই আক্রমণে আসার সময় অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে পকেটে করে পটাশিয়াম সায়ানাইডও এনেছিলেন প্রীতিলতা। এখন আক্রমণ শেষ। আক্রমণ সফল হয়েছে। দলের আর সবাইকে নিয়ে তিনি নিরাপদ দূরত্বেও চলে এসেছেন। এবার পালা মেয়েরা কতোটা সাহসী তা দেখানোর। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতল খুলে সবটুকু খেয়ে নিলেন। তবু যেনো তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। যদি তিনি মারা না যান? তখন তো সবাই বলবে, মেয়েদের আসলে মরার সাহসই নেই। এবার কালীকিংকর-দে’র পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতলটাও চেয়ে নিলেন। ধরা পড়ে গেলে বৃটিশরা অত্যাচার করে কোনো তথ্য বের করার আগেই আত্মহত্যা করার জন্য বিপ্লবীরা সবাই পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতল নিয়ে ঘুরতেন। কালীকিংকর-দে’ও তার বোতলের সায়ানাইড প্রীতিলতার মুখে ঢেলে দিলেন। দেশের স্বাধীনতা ও নারীর মর্যাদার মহান ব্রত কাঁধে নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। আর আর বিপ্লবী সঙ্গীরা তাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। পুলিশ যে যেকোনো সময় চলে আসতে পারে।


পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে প্রীতিলতার মৃতদেহ খুঁজে পায়। তাঁর পাঞ্জাবীর পকেটে বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, বিভলবারের গুলি, বৃটিশদের হাতে নিহত বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। পুলিশ তো প্রথমে ভেবে ছিলো বৃটিশদের গুলিতেই প্রীতিলতা মারা গেছেন। ওরা তো তখন খুবই খুশি। কিন্ত ময়নাতদন্তে করে তো ওরা একদম বোকা বনে গেলো! গুলিতে তো ওর তেমন কিছুই হয়নি, বরং পরে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েই আত্মহত্যা করেছেন প্রীতিলতা! এত্তো সাহস একজন মেয়ের হতে পারে!

আদরের মেয়ে প্রীতিলতার মৃত্যুতে তার বাবা প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন। শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বলে না, তারও তেমনই হয়েছিলো। এই ঘটনার পর থেকে তিনি খুব কম কথা বলতেন, সব সময় চুপচাপ থাকতেন। আর ওর মায়ের কি হতে পারে, একবার চিন্তা করে দেখেন। আপনার অনুমান পুরোপুরি ভুল। প্রীতিলতার মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটেছিলো একদমই উল্টো। মেয়ের জন্য যতই কষ্ট হোক, তিনি কখনোই তা প্রকাশ করতেন না। মানুষের কাছে উল্টো বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে’। এমনি সব মায়েদের বুক খালি করেই না স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। বৃটিশদের হাত থেকে, পাকিস্তানের হাত থেকে আমাদের স্বদেশ মুক্ত হতে গিয়ে এভাবে কতো মায়েরই না বুক খালি হয়েছে। আর তারা তাদের আদরের ‘রাণী’দের দেশের জন্য উৎসর্গ করে এমনিভাবেই বলেছেন দেশের কথা। এমনি ভালোবাসা আছে বলেই না আমরা দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পারি। ভাষার জন্য বিদ্রোহে আগুনের মতো জ্বলে উঠতে পারি।

শুনলেন তো, স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কীভাবে প্রীতিলতা তার প্রাণ উৎসর্গ করেছিলো। আর সেই সঙ্গে প্রমাণ করে গিয়েছিলো, মেয়েরাও কোনো অংশেই ছেলেদের চেয়ে কম নয়। মেয়েরাও সবই করতে পারে, ওদেরও খুব সাহস আছে, ভীষণই সাহস আছে। এরকম অসংখ্য প্রীতিলতার আত্মত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের এখন একটি নিজস্ব স্বাধীন দেশ আছে "বাংলাদেশ"। কিন্তু স্বাধীন হলেও আমাদের দেশ কিন্তু আজও অনেক গরীব, অনেক অনুন্নত। আর এই অনুন্নত দেশের উন্নতিও কিন্তু আমাদেরকেই করতে হবে। দেশের জন্য কাজ করতে হবে। ভয় পাবেন না, দেশের জন্য আপনাদেরকে যুদ্ধও করতে হবে না, জীবনও দিতে হবে না। ওই কাজ প্রীতিলতারাই করে গেছেন। আপনারা কেবল সবসময় নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠিক ভাবে পালন করবেন। দেশের জন্য ভালো হয়, এমন সব কাজ করবেন। সবাই যদি নিজেদের কাজটাই ঠিকঠাক ভাবে করেন, তাহলেই কিন্তু দেশের উন্নতি হয়। প্রীতিলতারা তো দেশের জন্য তাদের প্রাণই দিয়ে গেছেন, আপনারা কি এটুকুও করতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। আর সেদিনই আমাদের মিষ্টি দেশটা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে পরিণত হবে। আর তাই দেখে স্বর্গে বসে তৃপ্তির হাসি হাসবেন প্রীতিলতারা।

লেখকঃ মেহেদী বাবু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info