রহস্যময় টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ

“সে দিন আমি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় উত্তরদিকে মুখ করে চেয়ারে বসেছিলাম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম উত্তরের আকাশ চিরে দুই ভাগ হয়ে গেল। সে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল আগুন। সারা উত্তর দিকের আকাশের পুরোটা জুড়ে আগুন আর আগুন। তা থেকে আসছিল প্রচন্ড তাপ। মনে হল আমার গায়ের শার্টে আগুন লেগে গেছে। খুলে ফেলতে চাইলাম শার্ট। এ সময় এল প্রচন্ড শব্দ। ছিটকে পড়লাম চেয়ার থেকে কয়েক মিটার দূরে। গরম বাতাসের হলকা ঘিরে ধরল এলাকাকে। কেপে উঠল মাটি। কিছুক্ষন জ্ঞানহীন পড়ে রইলাম মাটির উপরে, মনে হচ্ছিল ছিটকে আসা পাথরের চাই মুহুর্তে এসে পিষে দেবে আমাকে। কিছুক্ষন পর আবিস্কার করলাম বেঁচে আছি, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষেত খামারের ফসল, এলাকার অনেক বাড়ী ঘরদোরের চুর্নবিচুর্ন কাচের জানালা, ছাদ ইত্যাদি।”
“তখন আমি আর আমার ভাই চেকরান নদী তীরে আমাদের কুঁড়ে ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুজনেরই একি সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিল। বাহিরে তিক্ষ্ম শীষের মত শব্দ হচ্ছিল এবং প্রচণ্ড বাতাস সাথে পাখীদের চিৎকার ও উড়ে যাওয়ার শব্দ। আমরা কেউই ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ তীব্র তাপ অনুভব করি, মনে হচ্ছিল আগুনের মধ্যে পড়ে গেছি। বাহিরে গাছ উপড়ে পড়ার শব্দ হচ্ছিল। আমি আর চেকরান স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসলাম নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল, ভূমি কাঁপতে শুরু করলো। পাথরে পাথরে বাড়ি খাওয়ার শব্দ হচ্ছিল। প্রচণ্ড বাতাস আমাদের ঘর ফেলে দিল এবং আমরা বাঁশ এবং কাঠের মধ্যে আঁটকে গেলাম। দেখতে পেলাম গাছ গুলো উপড়ে পড়ছিল আর তাদের শাখা প্রশাখা আগুনে জ্বলছিল। তখনও আকাশ রৌদ্রজ্জ্বল এবং মেঘমুক্ত ছিল, সূর্যও দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে আরেকটি সূর্যের উদয় হল। তীব্র আলোর ঝলক দেখা গেল এবং এর সাথে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল। সাথে সাথে বাতাসের বেগ বৃদ্ধি পেল অনেক গুন। বাতাস আমাদের দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে ভূপাতিত গাছ গুলোর উপর আছড়ে ফেলল। গাছগুলোর শীর্ষভাগ কর্তিত অবস্থায় ছিল যেন কেউ কেটে ফেলেছে গাছ গুলোর মাথা। চেরকানের চিৎকার শুনে আমি ওর আঙুল দিয়ে নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে আরও একটি আলোর ঝলক। আবার প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত এবং বাতাস। তবে এটি পূর্বের চেয়ে কম শক্তির ছিল। আমি মনে করতে পারি জ্ঞান হারানোর পূর্বে আরেকটি বজ্রপাতের শব্দ শুনেছিলাম, তবে তা সাধারণ বজ্রপাতের মতোই ছিল।”
উপরের ঘটনার বর্ণনা পড়ে কি মনে হচ্ছে? কোন সাইন্স ফিকসান গল্প বা হলিউড এ তৈরি কোন সাইন্স ফিকসান মুভির প্লট? Deep Impact বা Armageddon মুভির মত কোন মুভির অংশ বিশেষের বর্ণনা? না, তা নয়। এটি পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া একটি বিস্ফোরণের। বিস্ফোরনস্থলের আশেপাশের এলাকার ২ জন অধিবাসীর বর্ণনা। প্রথমটি বিস্ফোরণ স্থলের ৪০ মাইল দক্ষিনে সেমেনভ (S. Semenov) নামক লোকের এবং ২য় টি Shanyagir উপজাতির চুচান এবং তার ভাই চেরকান এর চাক্ষুষ ঘটনার বর্ণনা। বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ১৯০৮ সালের ৩০ জুন সকাল ০৭:১৭ মিনিটে (গ্রিনিচ সময় ০:১৭) রাশিয়ার সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদের উত্তর পশ্চিমের দুর্গম পার্বত্য এলাকা টাঙ্গুস্কা নদীর কাছে। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার এ এলাকায় জনবসতি নেই বললেই চলে। ধারণা করা হয় যে ঐ স্থানের সমুদ্র সমতল থেকে ৫-১০ কিঃমিঃ উপরে বায়ুমণ্ডলে মহাশূন্য থেকে আগত কোন বৃহৎ উল্কা বা ধূমকেতুর সাথে বায়ুর সংঘর্ষের ফলেই এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি কারনে বা কিভাবে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও রহস্যে ঘেরা। এটি এখন পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের উপরস্থিত বায়ুমণ্ডলে ঘটা সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ। যদিও এই বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল বায়ুমণ্ডলে ছিল কিন্তু ভূপৃষ্ঠে এর প্রভাব কম ছিলনা। এই বিস্ফোরনের শক্তি ছিল হিরোশিমার পারমানবিক বোমার চেয়ে ১০০০ গুন বেশী শক্তিশালী। এ বিস্ফোরন ঐ স্থানের আশেপাশের ২১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আনুমানিক ৮ কোটি গাছকে মাটির সাথে শুইয়ে দিয়েছিল। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট শক ওয়েভের প্রভাবে রিখটার স্কেলে ৫.০ মাত্রার ভূকম্পন হয়েছিল যা একটি শহর ধবংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই ঘটনার পর অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষক এর কারন খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আর এই ঘটনাটি আজও এক রহস্যাবৃত ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে যার নাম দেয়া হয়েছে টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ বা Tunguska Event।


ঐ স্থানের আশেপাশের অধিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথমে তারা আকাশে একটি সূর্যের মত উজ্জ্বল নীলাভ আলোর রেখা ছুটে যেতে দেখে। এর ১০ মিনিট পর ঐ স্থানটিতে উজ্জ্বল আলোক শিখা দেখতে পায় এবং এর সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। শব্দের তীব্রতা (শক ওয়েভ) এতই ছিল যে তা ঐ স্থান থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরের মানুষকেও শক ওয়েভের ধাক্কায় ফেলে দিয়েছিল। বাড়ি ঘরের সব জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছিল। প্রচন্ড শব্দে চিরতরে শ্রবন শক্তি হারিয়েছিল পশু চারনকারীরা। ঘটনাস্থল থেকে ৪০০ মাইল দূরে কানস্ক (Kansk) শহরে চলন্ত ট্রেন কেপে উঠে থেমে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল গোটা ট্রেনটাই ছিটকে পড়বে রেললাইন থেকে। সীট থেকে আছড়ে পড়েছিল যাত্রীরা। বিস্ফোরনে পুড়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে ঐ স্থানে কালো ছাইয়ের বৃস্টি হয়েছিল। ১০,০০০ কিলোমিটার দূরে লন্ডনে বায়ুমন্ডলের চাপের তারতম্য ধরা পড়েছিল । ঐ ঘটনার পরের কয়েকদিন এশিয়া এবং ইউরোপের রাতের আকাশ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ছিল।


পৃথিবীর ইতিহাসের এত বড় একটি ঘটনা অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল এতদিন। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদির ভিড়ে টাঙ্গুস্কা ঘটনাটি চাপা পড়েছিল। ১৯২১ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ মিউজিয়ামের উল্কা সংগ্রহের প্রধান কিউরেটর ভ্লাদিমির কুলিকের নেতৃত্বে প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযান হল টাঙ্গুস্কায়। সাইবেরিয়ার চরম বৈরী আবহাওয়ায় তার দল সেবার ঘটনাস্থল কেন্দ্রে পৌছাতে পারে নাই। ১৯২৭ সালে দ্বিতীয়বার অভিযানে এলেন কুলিক। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে কুলিক দেখলেন মাইলের পর মাইল জুড়ে ধ্বংশযজ্ঞ। দৈত্যাকৃতি প্রজাপতির আকারের ৮০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ধ্বংশ প্রাপ্ত বনজঙ্গল। আশ্চর্যের বিষয় হল উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃস্ট কোন গর্ত খুজে পেলেন না কুলিক। কেন্দ্র স্থল থেকে উল্টো দিকে উপড়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া গাছপালা। কিন্তু কেন্দ্রে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে ডালপালাহীন বাকল ছিলে নেওয়া গাছগুলো। হিরোশিমার পারমানবিক বিস্ফোরনের পর একই ধরনের ডালপালা খসে পড়া, বাকল ছিলে যাওয়া লক্ষ করেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৩৮ সালে বিমান থেকে এ এলাকার জরীপ করা হয়। এরপর আরো তিনবার এ এলাকায় অভিযান চালান কুলিক। কিন্তু বিস্ফোরনের আঘাতের চিহ্ন স্বরুপ কোন গর্ত খুজে পাওয়া যায় নি। ১০ থেকে ৩০ মিটার মাপের বিভিন্ন আকৃতির গর্ত পান কুলিক কিন্তু সে গুলো আঘাতের ফলে সৃস্ট নয়।

সেদিন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল তা এখনও রহস্যে ঘেরা। বহুবার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়েও সেখানে কোন প্রশ্নাতীত প্রমাণ পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে ঘটনাটির সুনিশ্চিত ব্যাখ্যা দেয়া যায়। বিভিন্ন গবেষক এবং বিজ্ঞানী স্থানটি পরিদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের মত প্রদান করেন ঘটনাটির কারন হিসেবে যার বেশির ভাগই অনুমান নির্ভর। কিছু কিছু ধারণা বা মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত শোনাই।

গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী বিস্ফোরণ ঘটার কারন হিসেবে যেসব তত্ত্ব পাওয়া যায় তা নিম্নরূপঃ
  • একটি ক্ষুদ্র গ্রহাণু বা উল্কা কণা যা বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়েছিল।
  • অতিক্ষুদ্র একটি ধুমকেতুর বিস্ফোরণ।
  • একটি ব্যাতিক্রম ধর্মী ভূতাত্ত্বিক ঘটনা।
  • মিথেন গ্যাস বিস্ফোরণ।
  • একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল যা মহাশূন্য থেকে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল।
  • এক টুকরো প্রতিবস্তু বা অ্যান্টিমেটার যা আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করেছিল।
  • একটি দুর্ঘটনায় পতিত ভিনগ্রহ বাসীর যান (!!!) যা বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়েছিল।
  • ভিনগ্রহ বাসীর আক্রমন (!!!)।
  • নিকোল টেসলার ডেথ রে এর একটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ।

যদিও এসব তত্ত্বের কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি তবুও চলুন একটি একটি করে এসব ধারণার বিশ্বাস যোগ্যতা কতটুকু তা আলোচনা করা যাকঃ

গ্রহাণু বা উল্কাঃ বিস্ফোরণটি ঘটার কারন হিসেবে এই ধারনাটি এবং ধূমকেতুর ধারনাটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কারন এটা ছাড়া বর্তমান বিজ্ঞান সমর্থিত অন্য কোন ব্যাখ্যা তারা দিতে পারছিলেননা। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরও সে স্থানটিতে এমন কোন গ্রহাণু বা উল্কার ধ্বংসাশেষ পাওয়া যায়নি যা এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে। তাই এই তত্ত্বটি অনুমান নির্ভর তত্ত্বই থেকে যায়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এমন কোন ধারণা বা তত্ত্ব চালু ছিলনা যে কোন গ্রহাণু বা উল্কা ভূপৃষ্ঠে আঘাত করার পূর্বেই বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেন এমন একটি বিস্ফোরণ ঘটার জন্য উল্কাটির ওজন হতে হবে প্রায় ১০০০০০০ টন। যেহেতু কোন ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি তাহলে এত বিশাল ভরের বস্তুটি গেল কোথায়? এর কোন ধ্বংস অবশেষ পাওয়া যাবেনা তা অবিশ্বাস্য। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে উদ্ভূত তাপে তা বাষ্পীভূত হয়ে গেছে এবং জ্বলন্ত ধূলিকণার আকারে গাছের উপর পড়ে দাবানলের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এটিও উল্কা বা গ্রহাণুর ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ধুমকেতুঃ ধূমকেতুর ধারনাটিও উল্কা বা গ্রহাণুর মত বিজ্ঞানীদের কাছে অধিক পছন্দনীয় ছিল। কিন্তু ধূমকেতুর গঠন পাথর এবং বরফের মিশ্রণে তৈরি। তাই বিস্ফোরণের ফলে এর কোন খণ্ডিত অংশ পাওয়া যাবেনা বা বাষ্পীভূত হয়ে যাবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে হতে পারে ধূমকেতুটি বালিকনার মিশ্রণে তৈরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোন ধূমকেতু পাওয়া যায়নি যার দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।


অস্বাভাবিক ভূতাত্ত্বিক ঘটনাঃ রাশিয়ান বিজ্ঞানী Andreiyu Ol’khovatov ধারণা অনুযায়ী এটি খুবই বিরল এবং ব্যাখ্যাতিত ভূতাত্ত্বিক ঘটনা যেমন একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প যা বায়ুমণ্ডলে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ঐ এলাকায় ভূমিকম্প হওয়ার কোন লক্ষন বা ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট কোন গাঠনিক পরিবর্তন দেখা যায়নি।

মিথেন গ্যাস বিস্ফোরণঃ জার্মানির বন ইউনিভারসিটির প্রফেসর Wolfgang Kundt বলেন, “পৃথিবীর অভ্যন্তর হতে ১০ মিলিয়ন টন মিথেন গ্যাস বের হয়ে বায়ুমণ্ডলে এমন বিস্ফোরণের সৃষ্টি করতে পারে।” কিন্তু এত বিশাল পরিমাণ মিথেন গ্যাসের বিস্ফোরণের ফলে ঐ এলাকার ভূপৃষ্ঠ হতে বায়ুমণ্ডলের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বিস্ফোরণ হওয়ার কথা এবং তাতে গাছগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গাছগুলোর মাথা থেকে অগ্নিকান্ড ঘটেছিল এবং বিস্ফোরণের পরও বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলে ভূপৃষ্ঠে গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া বিস্ফোরণ ঘটেছিল ভূপৃষ্ঠ হতে ১০ কিঃমিঃ উপরে, ভূপৃষ্ঠ হতে নয়।

কৃষ্ণগহ্বরঃ এই তত্ত্বটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে এতটা গুরুত্ব পায়নি কারন এত ছোট ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব আছে বলে জানা যায়নি। আর তা যদি থেকেও থাকে তা আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে কি ঘটবে বা তার প্রভাব কেমন হবে তা অজানা।

অ্যান্টিমেটার বা প্রতিবস্তুঃ এই ধারনাটিও বিজ্ঞানীরা বাতিল করে দেন কারন একটি অ্যান্টিমেটার মহাশূন্যের অন্য কোন বস্তুর সাথে ক্রিয়া না করে মহাশূন্য অতিক্রম করে আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ভূপৃষ্ঠের ৫-১০ কিঃমিঃ উপরে বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হবে তা অবিশ্বাস্য এবং এককথায় অসম্ভব।


দুর্ঘটনা কবলিত ভিনগ্রহ যানঃ যদিও ব্যাপারটা কল্পিত, হাস্যকর এবং অপ্রমাণিত বিষয় তবুও তেমনটা যদি ঘটত তবে যানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেত।

ভিনগ্রহ বাসীর আক্রমনঃ আরেকটি কল্প কাহিনী তত্ত্ব। যদি তেমনটা হয়ও কেন তারা এমন একটি স্থানে আক্রমণ চালাবে যেখানে জনমানব নেই বললেই চলে? যদিনা তারা মাতাল বা পাগল হয়।

টেসলা পরীক্ষাঃ গ্রহাণু, উল্কা এবং ধূমকেতু তত্ত্বের চেয়ে এই তত্ত্বটি ব্যাতিক্রম ধর্মী এবং আগ্রহ সৃষ্টিকারী। এই পরীক্ষা বা তত্ত্বটি টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণের মতোই রহস্যাবৃত। টেসলা পরীক্ষা বা Tesla’s Experiment নিয়ে অনেক মত, তথ্য, কথা বা ধারণা শোনা যায় কিন্তু এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানী নিকোল টেসলার তত্ত্ব অনুযায়ী পরিচালিত পরীক্ষাটি রহস্যাবৃত। নিকোল টেসলা কে বলা হয় পরিবর্তিত বিদ্যুৎপ্রবাহ বা Alternative Current এর ধর্মের বা নীতির আবিস্কারক। কিন্তু তাঁর গবেষণায় প্রাপ্ত কিছু ব্যাপার ছিল আরও বিস্তৃত আরও ভয়ানক। ধারণা করা হয় তিনি তাঁর গবেষণায় প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং বিধ্বংসী রশ্মির আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা টেসলার ডেথ রে (Tesla’s Death Ray) নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় এই রশ্মি নিয়ে গবেষণা করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র বা Super Weapon নির্মাণের উদ্দেশ্যে আমেরিকা এবং তার বন্ধু রাষ্ট্র গুলো মিলে আলাস্কায় একটি অতি গোপন গবেষণাগার স্থাপন করেছে যা HAARP (High frequency Active Auroral Research Programme) এর ছদ্মাবরনে কাজ করছে। অনেকে মত দেন যে, টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণের ঘটনাটি সেই ধরনের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফল যা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি বা যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছিল। HAARP কে নিখুত সুরক্ষিত রাখা, টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণটিকে চাপা দেয়ার চেষ্টা এবং বিস্ফোরণ স্থল পরিদর্শনের উদ্যেগ এ নানান বাধা কালক্ষেপণ ইত্যাদি তাদের ধারনাকে আরও বিশ্বাস যোগ্য করে তলে। কিন্তু যত যাই বলা হোক না কেন টেসলার ডেথ রে এখনো রহস্যাবৃত এবং অপ্রমাণিত বিষয়। অলিভার নিকলসন এর একটি ওয়েব সাইট আছে যা টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ এবং এর সাথে টেসলার পরীক্ষার যোগসূত্রের বিষয় নিয়ে তৈরি। সেখানে দেওয়া তথ্যগুলো আগ্রহ সৃষ্টিকারী। ওয়েব সাইটি “Tesla's Wireless Power Transmitter and the Tunguska Explosion of 1908" শিরোনামে তৈরি করা হয়েছে। আশা করি ব্যাপারটা তখন অনেক পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এখানে ১৯১৫ সালে একটি সেমিনারে টেসলার উক্তি তুলে ধরছি,
“It is perfectly practical to transmit electrical energy without wires and produce destructive effects at a distance. I have already constructed a wireless transmitter which makes this possible. But when unavoidable [it] may be used to destroy property and life. The art is already so far developed that the great destructive effects can be produced at any point on the globe, defined beforehand with great accuracy.”
কি হয়েছিল সেদিন, কিসের প্রভাবে এমন ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। আজও গবেষণা চলছে। ২০০৮ সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। তারা আশা প্রকাশ করেন যে, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা ঘটনাটির বাস্তব চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। কিন্তু, কেন এই বিস্ফোরণ নিয়ে এতো চিন্তা ভাবনা, এত গবেষণা? কারন, এটি হতে পারে পৃথিবী পৃষ্ঠে ধূমকেতু, উল্কার আঘাতের সবচেয়ে নিকটতম ঘটনা। যদি এটি ঐ জায়গাটিতে না হয়ে কোন ঘনবসতি পূর্ণ শহরে ঘটত তবে তা কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারন হতো। যদি বিস্ফোরণটি ৪ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট পর ঘটত তাহলে পৃথিবীর নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের কারনে বিস্ফোরণ স্থল ঐ জনমানবহীন জায়গাটি না হয়ে হতো সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর যা সেই সময়ে রাশিয়ার রাজধানী ছিল এবং মাত্র কয়েক মিনিটে শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতো। তাই টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ আমাদের একথা স্মরন করিয়ে দেয় যে আমরা নিরাপদ নই, মহাশূন্য যে কোন সময়ই আমাদের জীবনের জন্য হুমকির কারন হতে পারে।

এবার চলুন দেখে নেই এই রহস্যময় টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ নিয়ে বানানো একটি ভিডিও প্রতিবেদন,

লেখকঃ মেহেদী আনোয়ার।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info