কিভাবে ম্যামথ ক্লোন করবেন


মাত্র সাড়ে চার হাজার বছর আগেও ম্যামথ পৃথিবীতে বসবাস করতো। ইউরোপ থেকে আফ্রিকা হয়ে এশিয়া, এমনকি মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এদের চারণভূমি। ঠিক কি কারণে এদের বিলুপ্তি হয়েছে সেটা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। কিন্তু এই রাজসিক জীবটি আবার পৃথিবীতে ফিরে এলে দারুন হতো! আর সেই লক্ষেই পৃথিবীর নানা কোণার বেশকিছু বিজ্ঞানী চেষ্টা করছেন ক্লোন করে ম্যামথকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info

এই পর্বে চলুন দেখি একটা ম্যামথ আপনি কিভাবে ক্লোন করতে পারবেন। বেশি কিছু লাগবেনা না, ম্যামথের ডিএনএ, একটা মা হাতি এবং একটা ক্লোনিং এর জন্য গবেষণাগার। ব্যস। কয়েকদিন পরই দেখবেন ছোট ছোট ম্যামথ আপনার উঠোনে খেলাধুলা করছে! হাসি ব্যাপারটা কি এতই সহজ?! মোটেই না। বিজ্ঞানীদের ঘাম ছুটে যায় শুধু এধরনের ক্লোনিং এর একটা একটা ধাপ পার হতে। এখানে কয়েকটা উপায় উল্লেখ করছি। মোটামুটি সবধরনের বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনতে এই ক্লোনিংয়ের উপায়গুলি প্রযোজ্য।

ছবিঃ ম্যামথ এবং এশিয়ান হাতি
ক্লোনিং: 
এখানে ম্যামথকে ক্লোন করা হচ্ছে একটি হাতিকে হোস্ট হিসেবে চিন্তা করে। মূলত দুইটা পন্থায় ভাগ করা যায়। প্রথমটা হল যদি আমাদের কাছে ম্যামথের কোন অক্ষত কোষ থাকে তবে তা থেকে ডিএনএ নিয়ে, আর দ্বিতীয়ত সিনথেটিক ডিএনএ বা ইঞ্জিনিয়ারিং করা ডিএনএ দিয়ে। ছবিগুলির ধাপগুলি অনুসরণ করুন।

প্রথম উপায়ঃ ম্যামথের স্পার্ম থেকে থেকে ক্লোনিং,
১) ম্যামথের একটি জীবিত স্পার্ম লাগবে।
২) স্পার্মটিকে হাতির ডিম্বকোষ আলাদা করে তার সঙ্গে নিষিক্ত হতে দিতে হবে।
৩) তারপর নিষিক্ত ডিম্বক হাতির গর্ভে স্থাপন করতে হবে।
৪) যে শিশুটি হবে সেটা হবে হাতি-ম্যামথের হাইব্রিড, কারন উভয়ের কোষেরই ডিএনএ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে।
৫) তারপর হাইব্রিডটিকে মা হিসেবে ব্যবহার করে ম্যামথের স্পার্ম দিয়ে পুনরায় ক্লোন করলে একটু শুদ্ভ ম্যামথ শিশু তৈরি হবে।

ছবিঃ প্রথম উপায়
দ্বিতীয় উপায়ঃ এবার দেখবো হিমায়িত কোষ থেকে ক্লোনিং এর উপায়,
১) কোনো হিমায়িত ম্যামথ কোষ থেকে নিউক্লিয়াস পৃথক করতে হবে (নিউক্লিয়াসের ভেতরে ক্রোমোজমে সাজানো থাকে ডিএনএ)।
২) কোনো একটি হাতির ডিম্বাণু থেকে নিউক্লিয়াস সরিয়ে তা ম্যামথ নিউক্লিয়াস দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাহলে যে ডিম্বাণুটা তৈরি হবে সেটা বিভাজিত হয়ে একটা শিশু ম্যামথের রূপ নিতে পারবে।
৩) এবারে কোষটিকে রাসায়নিকভাবে অথবা বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপিত করতে হবে যেন কোষ বিভাজণ শুরু হয়।
৪) ডিম্বাণুটি নিয়ে একটা হাতির জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে, এই হাতিই হবে নতুন ম্যামথের মা।
৫) যদি সফল গর্ভধারন সম্ভব হয় হাতিটি একটি ম্যামথ শিশুর জন্ম দেবে।

ছবিঃ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উপায়
তৃতীয় উপায়ঃ এবার দেখি সিকোয়েন্স করা ম্যামথ জেনোম থেকে কিভাবে ক্লোন করা যায়,
১) প্রথমে ম্যামথের জিনেটিক কোড সিকোয়েন্স করা হয় এবং এরপর নিচের যেকোনো একটি উপায় অবলম্বন করা হয়। 

উপায় কঃ 
২ক ) জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাবহার করে ম্যামথের লম্বা ডিএনএ সূত্র তৈরী করতে হবে। মানে পুরো ডিএনএ কে কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে হবে।
৩ক ) ডিএনএ সূত্রকে একটি ক্রোমোজম হিসাবে সাজাতে হবে। এক কথায় বলে দিলাম, কিন্তু এই কাজ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। বর্তমান টেকনোলজিতে প্রায় অসম্ভব।
৪ক) প্রাপ্ত ম্যামথ ক্রোমোসোম একটি কৃত্রিম নিউক্লিয়ার পর্দা দ্বারা বেষ্টিত করা হয়। এই জিনিসও খুবই জটিল জিনিস।

পরের ধাপটা হল হিমায়িত কোষ থেকে ক্লোনিং এর, অর্থাৎ দ্বিতীয় উপায়ের ২ নং উপায় থেকে অনুসরণ করা।

উপায় খঃ 
২খ ) হাতির জেনোম সিকোয়েন্স প্রায় ৪০০০,০০০ টি জায়গায় ম্যামথের চেয়ে ভিন্ন (হাতি এবং ম্যামথের সিকোয়েন্সের ৯৪ শতাংশে মিল আছে)। এই পদ্ধতিতে হাতির জেনোমের জায়গা গুলিকে পরিবর্তন করে ম্যামথের মত বিন্যাসে নিয়ে আসা যেতে পারে। কিন্তু এটা কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে চিন্তা করছি!

আবার হাতির এপিজিনেটিক চিহ্নগুলি পুরোপুরি ম্যামথের মত না হওয়ারই কথা। কোষে ডিএনএ শুধু বিন্যাসই সবকিছু নয়। ক্রোমোজমের মধ্যে এমন কিছু চিহ্ন আছে যে গুলি কোন জিন কখন প্রকাশিত হবে বা বন্ধ হবে বা কি মাত্রায় প্রকাশিত হবে সেগুলি নির্ধারন করে। এগুলিকে এপিজিনেটিক চিহ্ন বলে। তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে ফেইল করার সম্ভাবনাই বেশি।

৩খ) হাতির চামড়ার কোষকে ভ্রূণীয় স্টেম কোষে রূপান্তরিত করার জন্য রিপ্রোগ্রাম করা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এমন করা গেছে সম্প্রতি!
৪খ) এরপর হাতির পরিবর্তিত এবং সংশোধিত জিন এই ভ্রূণ কোষের মধ্যে স্থাপন করতে হবে।

পরের ধাপটা হল হিমায়িত কোষ থেকে ক্লোনিং এর, অর্থাৎ দ্বিতীয় উপায়ের ৩ নং উপায় থেকে অনুসরণ করা।

ঝামেলা সমূহঃ কি, বিরাটা ঝামেলার ব্যাপার মনে হচ্ছে? ঝামেলা তো বটেই। ঝামেলা সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করি। যেমন, প্রথম এবং দ্বিতীয় উপায় অনুসরণ করতে আপনার লাগবে একটি ম্যামথের জীবিত স্পার্ম বা এমন কোষ যার নিউক্লিয়াসে ক্রোমজমগুলি মোটামুটি অক্ষত আছে। এই জিনিসটা পাওয়া খুবই কষ্টকর। শুধুমাত্র পার্মাফ্রষ্ট এলাকায় (বহুবছর যেখানে হিমাংকের নিচে তাপমাত্রা থাকে) কোন ম্যামথ ফসিল সংরক্ষিত থাকলে সেখান থেকে পাওয়া সম্ভব। ম্যামথেরা ৫ মিলিয়ন বছর আগে থেকে ৪.৫০০ বছর পর্যন্ত বসবাস করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে। কিন্তু সর্বশেষ প্রাণীটিরও দেহাবশেষ থেকে অক্ষত ডিএনএ পাওয়া দুষ্কর। কারণ ডিএনএ খুব সহজেই ভেঙে যায়। সম্প্রতি একটা দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, কিছু বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে এই ফসিলের জীবিত রক্তের কোষ আছে। কিন্তু সেটা সত্যি হবার সম্ভাবনা কতটুকু এবং হলেও কিকি ধরনের সমস্যা হতে পারে সেটা নিয়ে পরের পর্বে লিখব।

তারপর লাগবে একটা এমন হাতি যেটার সঙ্গে ম্যমাথের কোষের বেশ ভাল মিল আছে। সবচেয়ে ভাল হত যদি একটি ম্যামথ মা বেঁচে থাকতেন। এখন যেটা হবে সেটা হল, যদি আমরা ম্যামথ শিশু ফিরিয়ে আনতে করতে পারি তারপরও শিশুটি পুরোপুরি ম্যামথ হবেনা। বরং একটা হাতি ম্যামথ হাইব্রিড হবে। কারণ আমরা হাতির কোষকে হোস্ট হিসেবে ব্যাবহার করছি। আবার, হাতির থেকে ডিম্বকোষ নিয়ে এরকম পরীক্ষা করে করে চেষ্টা করতে প্রায় ১০০০ টি ডিম্বকোষ লাগতে পারে। এতগুলি জোগাড় করাটা বেশ কষ্টসাধ্য হবে।

তৃতীয় উপায়ে আসি, ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও, জটিল বহুকোষী এবং বহু ক্রোমোজমসহ জীবের সিনথেটিক ডিএনএ তৈরি করতে পারা এখন অসম্ভব। তারপর আবার রয়েছে এই ডিএনএকে ক্রোমোজমে সাজানো, তার মধ্যে এপিজিনেটিক চিহ্ন সঠিক ভাবে বসানো ইত্যাদি। এটা এতই জটিল যে কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। উপায় ২খ তে বলছি ৪০,০০০০ স্থানে বিভিন্নরকম মিউটেশান এর কথা! কে করবে এত ম্যামথ আকারের কাজ? আবার কোষকে রিপ্রোগ্রাম করা? বাব্বাহ।

সেজন্য প্রথম এবং দ্বিতীয় উপায়দুইটিই সবচেয়ে সহজ উপায় বলে ধরে নেয়া যায়। আর এত বাঁধা এবং সম্ভাব্য অসফলতার কারণ সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা পিছপা হননি। রাশিয়া, জাপান, কোরিয়া বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ম্যামথ ক্লোনিং এর গবেষণাগার খুলে বসে আছেন। নিত্য চেষ্টা করছেন অগ্রগতির। আশা করি একদিন তারা সফল হবেন।

লেখকঃ সজীব ওসমান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।