'সিডর' এর আদ্য প্রান্ত ।। All About 'SIDR'


নানা রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে হ্যারিকেন মারাত্মক এক ঘূর্ণিঝড়। এর আছে ধ্বংস করার ভয়াবহ ক্ষমতা। প্রশ্ন হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় হয় কী করে? বিষয়টা বুঝতে পারা খুবই সহজ। খালি একটু মন দিয়ে শোন। সমুদ্রের পানি ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশী উষ্ণ হয়ে গেলেই ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে। এই উষ্ণতা থেকেই জন্ম নেয় বাষ্প ও স্যাঁতস্যাতে বাতাস। সেটাই রূপ নেয় ভয়ঙ্কর কালো মেঘে। দুই দিক থেকে আসা নিচের এই বাতাস এক হয়ে গরম পানির উপরের বাতাসকে ঠেলে দেয় আরও উপরের দিকে। তখন তাদের জায়গা করে দিতেই, অর্থাৎ এদের ধাক্কায় উপরের বাতাস ধেয়ে যায় উল্টো দুই দিকে। উপরের দিকে উঠতে থাকা ভেজা বাতাস এরই মাঝে তৈরি করতে থাকে ঝোড়ো মেঘ। আর এই ঘটনার আশেপাশে বয়ে চলে যে হাল্কা বাতাস, সেও বাইরে থেকে ধীরে ধীরে এই ঘনঘটার ভেতর ঢুকতে শুরু করে, এতে ঝড়ের ঘুর্ণি আরও বড় হতে থাকে। বাতাসের গতি যখন প্রতি ঘন্টায় ৭৪ মাইলের বেশি হয়ে যায়, তখনই তাকে হ্যারিকেন বলা হয়। গতি যখন এর চেয়ে কম থাকে কিন্তু প্রতি ঘন্টায় ৩৯ মাইলের বেশি থাকে তখন সেটা শুধুই মৌসুমী ঝড়।

২০০৭ সালের উত্তর ভারতীয় সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড় মৌসুমে নাম দেয়া হয়েছে এমন ঝড়গুলোর ভেতর সিডর (SIDR) চতুর্থ আর সব মিলিয়ে ষষ্ঠতম ঘুর্নিঝড়। সিডর শব্দটি এসেছে ‘সিদর’ থেকে। এটি শ্রীলংকার একটি শব্দ অর্থাৎ সিংহলী শব্দ। প্রতিটি ঝড়ের সময় নির্ধারিত আটটি দেশের ভেতর একেকবার একেকটি দেশকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ধেয়ে আসা ঝড়ের নাম দিতে। এবারে নাম দিয়েছে শ্রীলংকা আর সিংহলী ভাষায় সিদর অর্থ ‘ছিদ্র’। এছাড়াও জুজুবা গাছকেও আরবিতে ‘সিডর’ নামে ডাকা হয়। শুধু তাই না, আরব দেশের অনেক লোককেই তাদের নামের শেষে ‘সিডর’ উপাধি ব্যবহার করতে দেখা যায়।


আগে থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল যে প্রতি ঘন্টায় ঝড়টির কেন্দ্রে সর্ব্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে যাওয়া এই সিডরের ঘুর্ণি সমুদ্রের পানিকে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দশ-বারো ফুট উঁচু দিয়ে নিয়ে যাবে। কাজেই বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু তীরবর্তী জায়গা ভেসে যাবে উপচে পড়া পানির বন্যায়। গত ৯ নভেম্বর দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় তৈরি হওয়া বিশৃংখল আবহাওয়া ধীরে ধীরে আরও ভয়াবহ চেহারা নিয়ে সরে যায় উত্তর-পশ্চিমে। ১২ তারিখে সেটাই সৃষ্টি করে সিডর ঘূর্ণিঝড়। আর ১৫ নভেম্বরে এসে ভয়ঙ্কর সিডর আঘাত হানে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলের জেলাগুলোতে। এমন দুরন্ত গতির কারণেই আটলান্টিকে অবস্থিত আমেরিকার আবহাওয়া অফিস সিডরকে ক্যাটাগরি চার এর আওতায় ফেলেছে। ভয়াবহতা নির্নয় করে সাধারণত মোট পাঁচটা ক্যাটাগরিতে ফেলা হয় ঝড়কে। ক্যাটাগরি চার ঝড়গুলোর বাতাসের বেগ থাকে ঘন্টায় ২১০ থেকে ২৪৯ কিলোমিটার।

ঝড়ের ক্যাটাগরি ভাগ করার সবচেয়ে জনপ্রিয় নিয়মের নাম হচ্ছে ১৯৬৯ সালে আবিষকৃত ‘সাফির-সিম্পসন হ্যারিকেন স্কেল’। এই নিয়মে বাতাসের গতিবেগ হিসাবে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত মোট পাঁচটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয় ঝড়গুলোকেঃ
  • ক্যাটাগরি একঃ প্রতি ঘন্টায় ১১৯ থেকে ১৫৩ কিলোমিটার।
  • ক্যাটাগরি দুইঃ প্রতি ঘন্টায় ১৫৪ থেকে ১৭৭ কিলোমিটার।
  • ক্যাটাগরি তিনঃ প্রতি ঘন্টায় ১৭৮ থেকে ২১০ কিলোমিট।
  • ক্যাটাগরি চারঃ প্রতি ঘন্টায় ২১১ থেকে ২৫০ কিলোমিটার।
  • ক্যাটাগরি পাঁচঃ প্রতি ঘন্টায় ২৫০ কিলোমিটার বা তার থেকে বেশি।
গড়ে এক মিনিট ধরে ধেয়ে চলা এবং সমতল থেকে প্রায় ৩৩ ফুট ওপর দিয়ে যাওয়া ঝড়ো বাতাসের গতি অবশ্য নটিক্যাল মাইল হিসেবেও মাপা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় কোথায় হয়েছিল জানেন? আমাদের বাংলাদেশের ভোলায়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরে আঘাত হানা এই ঝড়ে আমরা হারিয়েছিলাম প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হাজার প্রাণ। এখনও অনেক আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে এই ভয়ংকর ঝড়ের কথা, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দি গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’।


বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সাইক্লোনের তালিকায় প্রথম দশটির ভেতর পাঁচটিতেই আছে আমাদের বাংলাদেশের নাম। সেই দশটি হচ্ছেঃ

০১) গ্রেট ভোলা সাইক্লোন, বাংলাদেশ (১৯৭০, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৫০ হাজার)
০২) হুগলি রিভার সাইক্লোন, ভারত (১৭৩৭, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫০ হাজার)
০৩) হাইফং টাইফুন, ভিয়েতনাম (১৮৮১, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর, মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ)
০৪) বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, বাংলাদেশ (১৫৮৪, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ)
০৫) গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, বাংলাদেশ (১৮৭৬, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ)
০৬) বাংলাদেশ (১৮৯৭, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৫ হাজার)
০৭) সুপার টাইফুন নিনা, চীন (১৯৭৫, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৭১ হাজার)
০৮) সাইক্লোন জিরো-টু-বি, বাংলাদেশ (১৯৯১, বঙ্গোপসাগর, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৪০ হাজার)
০৯) গ্রেট বম্বে সাইক্লোন, ভারত (১৮৮২, আরব সাগর, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ)
১০) হাকাতা বে টাইফুন, জাপান (১২৮১, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর, মৃতের সংখ্যা ৬৫ হাজার)

এখন ঝড়ের গতিবিধি মাপা ও লক্ষ্য করা হয় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, অবশ্য আগে পুরোপুরি নির্ভর করা হতো আবহাওয়া বেলুন ও অন্যান্য যন্ত্রের উপর। ফলে বর্তমানের মত তখন এত নিখুঁতভাবে সব জানা যেত না আর প্রাণহানিও হতো অনেক বেশি।

লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

  1. লেখাটি সত্যিই অসাধারণ হয়েছে, জানার জন্য অনেক তথ্যই এখানে আছে। আমার মনে হয় সবার জন্যই এ লেখাটি উপকারে আসবে। আমি নিজেও অনেক তথ্য জানতাম না। যেমন, ১৯৭০ সালেও অনেক বড় ঝড় হয়েছিলো, তা ঠিক কত তারিখে, তা জানতামনা, এরকম অনেক তথ্যা এ লেখাটিতে আছে। খুব ভালো লেগেছে আমার।

    উত্তরমুছুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info