- প্রতি বছর চেয়ার ভেঙ্গে পড়ে যেয়ে ২৫ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে সারা বিশ্বে।
- প্রতি বছর রুটি গরমের টোস্টার বিস্ফোরিত হয়ে ৩০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে সারা বিশ্বে।
- প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৩ -৫ জন মানুষের হাঙরের কারণে মারা যায়!
- আর প্রতি বছর মানুষের হাতে মৃত্যু ঘটে ১০০ মিলিয়ন হাঙরের!
এই কথা গুলো লেখা ছিল মহাসমুদ্রের তীরে গড়ে ওঠা দক্ষিণ গোলার্ধের বৃহত্তম শার্ক সেন্টার বা হাঙর প্রদর্শনী কেন্দ্র উসাকাতে, স্থান ডারবান, দক্ষিণ আফ্রিকা। সেদিন কাক ভোরে ডারবান মহানগরী পৌঁছেছি জীবনে প্রথম বারের মত। খেলা শুরু হবে বিকেলের শেষে, হাতে সময় থাকায় কয়েকটা জায়গা টোটো করা হল। বিশেষ করে প্রকৃতি জাদুঘরে বিলুপ্ত ডোডো পাখির স্টাফ করা দেহ দেখার
অভিজ্ঞতা আরেকবার মনে করিয়ে দিল মানুষের হৃদয়হীনতা এবং নির্বুদ্ধিতার
কথা।
সকালের লাজুক সূর্য তখন সাগরের বেলাভূমিতে আবির্ভূত হয়েছে স্বমহিমায় অগ্নিরথে, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন শীতকাল চললেও আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলে শীত খুব একটা সুবিধার করতে পারে না বোঝাই যাচ্ছে, সাগরের হাওয়ার পরশের যদিও ঘর্মাক্ত হবার হাত থেকে রেহাই দিল, কিন্তু ছায়াময় কোথাও বিশ্রাম নেবার কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল থেকে থেকে। দূর থেকে দেখা গেল উসাকা মেরিন ওয়ার্ল্ডের বিজ্ঞাপন। এটা বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম অ্যাকোয়ারিয়াম আর হাঙরের সংগ্রহশালা হিসেবে এই গোলার্ধের বৃহত্তম, সেই সাথে আছে সীলের নাচ, পেঙ্গুইনের হাটা, কুমির, সাপ, প্রবাল ইত্যাদি ইত্যাদি প্রাণীর দর্শন লাভের ১০০% সম্ভাবনা।
দেখলাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সীলের কসরত, পেঙ্গুইনের থপ থপ করে হেলেদুলে হাটা, বিশেষ অ্যাকুরিয়ামে রাখা সামুদ্রিক হিংস্র বাইন মাছ মোরে ইলের কদর্য খেমো (যার কথা প্রথম জেনেছিলাম তিন গোয়েন্দার বই পড়ে), কিন্তু মন পড়ে ছিল হাঙরের রাজ্যে। সে বিশাল এক জাহাজ! সত্যি সত্যি জাহাজ!
তাকেই ঘষামাজা করে নানা কায়দায় একগাদা অ্যাকোরিয়াম, খাঁচা, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সেট করা হয়েছে। এমন এক বিশাল নীল জলের জগতে জীবনে প্রথমবারের মত চাক্ষুষ করলাম হাতুড়ি মাথা হাঙর! অসম্ভব সুন্দর প্রাণীটি কী সাবলীল ভাবেই না পানি চিরে চলেছে, ইশ যদি আপন রাজ্য বুনো অবস্থায় তাকে দেখতে পেতাম!
হাঙর এক বিস্ময় মানুষের কাছে! প্রায় ৫০০ প্রজাতির হাঙর আজ পর্যন্ত আবিস্কার করেছে মানুষ সেগুলোর আকৃতি ৭ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৪০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত! ৪৫ কোটি বছর ধরে তাদের সদর্প জলকেলি চলতেই আছে, এমনকি ঘুমানোর সময়ও তারা সাঁতরাতে থাকে আর হাঙর নিয়ে মানুষের এত্ত গবেষণার মূল কারণ এই যে আমাদের জানা ছিল হাঙরের কোন অসুখ হয় না এমনকি ক্যান্সারও না ! কী এমন রহস্য আছে এই মাছের যাতে কোন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, কোষ স্ফীতি দাঁত বসাতে পারে না ! অবশ্য এখন জানা গেছে কোন কোন হাঙরের বিশেষ ধরনের অসুখ হয় বৈকি। আবার হাঙররাই বিশ্বের প্রথম প্রাণী যাদের দেহে শিশ্ন বা পেনিসের উদ্ভব ঘটে।
সবচেয়ে বড় হাঙর যে হোয়েল সার্ক বা তিমি হাঙর সেটি আবার খায় অতি ক্ষুদে জীব, মানুষের সাথে তার বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ভারত মহাসাগরের তীরের মোজাম্বিকে একশ ডলারের বিনিময়ে তাদের সাথে সাঁতরাবার নিমন্ত্রণও ছিল। এই বিশালদেহীর শরীরেও কিন্তু কোন হাড় নেই, আছে কার্টিলেজ!
জানা গেছে রক্তের গন্ধ শুকেই মানুষ শিকারের জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠে না হাঙর, রক্ত পিপাসু হয়ে মানুষ শিকারের জন্য ফন্দী করে না সে, বরং নিচ থেকে সাতাররত মানুষকে সীলের সাথে গুলিয়ে ফেলে তাড়া করে প্রায়ই, সেই সাথে আছে হাঙরের পাখনা দেখলেই মানুষের আতঙ্কিত হয়ে থই হারিয়ে প্রবল বেগে নড়াচড়া করা, ফলে সন্দেহপ্রবণ মাছটি আক্রমণ করেই বসে, আর এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী দুর্নামের ভাগীদার আফ্রিকার বৃহত্তম শিকারি প্রাণী গ্রেট হোয়াইট সার্ক। তার মূল কারন কী আদৌ তাদের মানুষ শিকার নাকি হলিউডের নানা গুলবাজ সিনেমা, বিশেষ করে স্টিভেন স্পিলবার্গের JAWS?
ঘুরে ঘুরে চার ধরনের হাঙর দেখলাম আমরা। কত কোটি বছর ধরে টিকে আছে এই অসাধারণ প্রাণীগুলো। সাগরের মৃত সমস্ত প্রাণী খেয়ে এমনিতেই তো তারা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে সাগরের নির্মলতা রক্ষা করতে, তার উপর অনেক হাঙরই তাদের ফুড চেইনের সবচেয়ে উপরের কাতারের সদস্য মানে কিনা সর্দার!
আর এই হাঙরকেই আমরা মেরে ফেলছি কাতারে কাতারে! বছরে ১০০ মিলিয়ন হাঙর মারা পরে মানুষের চাহিদার জোগান দিতে, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার হাঙরের পাখনার স্যূপ বানানোর কাঁচামাল জোগাড় দিতে, সেই সাথে পোলট্রি শিল্পের খাবার বানানোর জন্য বাংলাদেশে শিকার করা অধিকাংশ হাঙর চলে যায় অন্য দেশে মুরগীর খাবার হতে। এইভাবে সাগরের খাদ্যচক্রে ভারসাম্য নষ্ট করার ফল ইতিমধ্যেই হাতেনাতে পাওয়া শুরু হয়েছে ।
উসাকাতে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল অবশ্য হাঙরের সাথে সাঁতার কাটার, কিন্তু সে লোহার খাচার ভিতরে ঢুকে মানে যেমনটা খোলা সাগরেও ঘটে, কিন্তু রহস্য পত্রিকায় টিম ক্যাহিলের হাঙরের সাথে কিছুক্ষণ, আর বই হিসেবে ফ্রাঙ্ক পোলির নীল অন্ধকার পড়ে যে মুগ্ধতা জমেছে হাঙরের সাথে সাঁতার কাটার জন্য সেটাকে এই বদ্ধ পরিবেশে জলাঞ্জলি দিতে ইচ্ছে করল না।
হাঙর ছাড়াও যে সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী আছে তার মধ্য কয়েকটাকে স্পর্শ করার সুযোগ ছিল একাধিক অ্যাকোরিয়ামে। মহা উৎসাহে কিছু স্টারফিশসহ আরও বর্ণীল কিছু জলজকে ছুঁয়ে দিয়ে আসলাম!
আরও কিছুক্ষণ অসাধারণ প্রাণী গুলোকে দেখে চললাম মহাসমুদ্রে অবগাহন করতে, সেখানে আবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এলাকা আলাদা করা হয়েছে মানব সন্তানদের জন্য, বাকী অবারিত সমুদ্র সমুদ্রের আসল সন্তানদের জন্য, কিন্তু সেই গল্প আরেক দিন।
হাঙরেরা বেঁচে থাক, সমুদ্রটা জুড়ে থাক।
লেখকঃ তারেক অণু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন