কানের পোষাক ।। Earmuffs


আমেরিকার ফার্মিংটনের কাছে ওয়েস্টার্ন মেইন বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে চেস্টার গ্রিনউড বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। এই ভদ্রলোকের কানে একটা সমস্যা ছিলো। ঠাণ্ডার মধ্যে গেলেই তার কান জমে যেত। আমাদের সবারই তা হয় কিন্তু গ্রিনউডের পরিমানটা ছিলো অনেক বেশি। মোটামুটি ঠাণ্ডাতেই তার কান ফ্রস্টবাইটের কাছাকাছি পৌঁছে যেতো। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় দেহের অঙ্গপতঙ্গ জমে অসাড় হয়ে যাওয়াকে বলে ফ্রস্টবাইট। ফার্মিংটন হচ্ছে শীত প্রধান এলাকা, এখানে কানের এই সমস্যা থাকলে কি চলে? চলে না, তাই গ্রিনউড একটা বুদ্ধি বের করলেন, বুদ্ধির গল্পে পরে আসছি। আগে অন্য ঘটনা জেনে নেই।

১৮৭৩ সাল, গ্রিনউডের বয়স তখন পনেরো। পনেরতম জন্মদিনে গ্রিনউড একজোড়া আইস স্কেট উপহার পেলেন। বাড়ির সামনে বিরাট মাঠে বরফ জমে আছে। আর হাতে আইস স্কেট, তাহলে কি চুপচাপ বসে থাকা যায়? দৌড়ে গ্রিনউড বেরুলেন স্কেটিং করতে। বেরুবার সময় মা বললেন, “সাবধানে থাকিস, তোর যে তুলোর কান, একটুতেই খসে পড়বে।”

কে শোনে কার কথা! গ্রিনউড স্কেটিং করতে বেরিয়ে গেলেন। আধ ঘন্টা পরই দু'হাতে কান চেপে ধরে ফিরলেন বাড়িতে। কানে তীব্র ব্যাথা, এই ব্যাথা নিয়ে কি স্কেটিং করা যায়? উলের টুপি পরলেই ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু গ্রিনউডের তাতেও সমস্যা, উলে তার এলার্জি। কান মুখ সব উলের টুপি পরলেই চুলকানো শুরু করে।

কানের সমস্যা সমাধান না করলে তো পুরো শীতটাই মাটি। বরফে স্কেটিং করা যাবে না, বরফের গোল্লা বানিয়ে বন্ধুদের সাথে ছোঁড়াছুড়ি করা যাবে না। একটা বুদ্ধি বের করলেন গ্রিনউড। গ্রিনউডদের সাথে তার দাদীমা থাকতেন। বৃদ্ধা মহিলার নিজের একটা কাপড় সেলাইয়ের মেশিন ছিলো। তিনি সেলাইয়ে ছিলেন ওস্তাদ কারিগর। গ্রিনউড একটা তার এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে নিলেন। দু’প্রান্তে তার পেঁচিয়ে গোল করলেন। তারপর তিনি দাদীকে বললেন, দুই গোল জায়গায় ফ্লানেল আর ফার দিয়ে সেলাই করে দিতে। দাদীমাও নাতির কথা মতো সেলাই করে দিলেন।

জিনিসটাতে কাজ হলো, গ্রিনউড দেখলেন, বাহ! কানে তো আর কোন ঝামেলাই হচ্ছে না।

এই জিনিস গ্রিনউড প্রথম যখন পড়ে বেরুলেন, তখন বাকীরা হাসহাসি শুরু করলো। “হা হা হা গ্রিনউড, কানেরও শার্ট বানিয়েছো? নাকেরটা লাগবে না? নাকেরটাও বানাও। তোমাকে মানাবে, ভায়া।” গ্রিনউডের তো কানে পোষাক তাই তাদের কথাবার্তা তার কানে তেমন লাগলো না। এক সময় দেখা গেল, এই হাসাহাসি করা লোকেরাই একটা কানের পোষাকের জন্য গ্রিনউডকে ধরাধরি করছে।

গ্রিনউড দেখলেন এই তো সুযোগ। পরবর্তী বছর তিনেক ধরে তিনি তার পোষাকটির একটু উন্নতি ঘটালেন। তারের বদলে চ্যাপ্টা, পাতলা স্টিলের পাত বসালেন। যে অংশটা কান ঢেকে রাখে সে অংশে নিজের মতো অংশ জুড়ে দিলেন। যাতে জিনিসটা ঠিক মতো কানে বসে থাকে। এরপর গ্রিনউড জিনিসটাকে যাতে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থাও করলেন। যখন প্রয়োজন নেই তখন তো জিনিসটা কোথাও রাখতে হবে। সব সময়ই কানে পরে থাকাটা কেমন যেন দেখায় না? তাই ভাঁজ করার ব্যবস্থা।

১৮৭৭ সালের ১৩ মার্চ আমেরিকার পেটেন্ট অফিসে গ্রীনউড তার আবিস্কারের পেটেন্ট করান। সেখানে তিনি তার উদ্ভাবনের নাম দেন, "গ্রিনউড চ্যাম্পিয়ন ইয়ার প্রোটেক্টর"। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র আঠারো বছর।

১৮৮৩ সালে চেস্টার গ্রিনউড এগারোজন কর্মীসহ একটি কারখানা গড়ে তোলেন। কারখানা গড়েন তার বাড়ির পাশেই, সেই ফার্মিংটনে। তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক সাংবাদিক লিখেছিলেন, “আমি ভেবেছিলাম গ্রিনউড বোধ হয় মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ কিন্তু দেখলাম গ্রিনউড একেবারেই তরুণ। এই তরুণের যন্ত্রগত দক্ষতা অসাধারণ। শুধু যন্ত্র চালানো নয়, যন্ত্র উদ্ভাবনেও তার দক্ষতা সমান। আর তার যে কারখানাটি আছে, তা আমার দেখা সবচে চমকপ্রদ কারখানা।


১৮৮৩ সালে গ্রিনউডের কারখানায় তৈরি হলো পঞ্চাশ হাজার জোড়া ইয়ার প্রোটেক্টর। এ সময় ব্যবহার করা হতো কালো ভেলভেট আর নীল উল। ১৮৮৪ সালে এক সাংবাদিক আবারও গ্রিনউডকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার ভবিষ্যত লক্ষ্য কী?” জবাবে গ্রিনউড বললেন, “সামনের বছর এক লাখ জোড়া ইয়ার প্রোটেক্টর বানানো। আর কিছু নয়।”

ঘটনা তাই হলো, গ্রিনউড তার ফ্যাক্টরির আকার বাড়ালেন, ফার্র্মিংটন শহরের বাইরে গড়ে তুললেন বিশাল কারখানা। ১৯৩৭ সালে গ্রিনউড মৃত্যুবরণ করেন। ততদিনে তার ফ্যাক্টরি প্রতি বছর চার লাখ জোড়া ইয়ার প্রোটেক্টর বানানো শুরু করে দিয়েছে।

গ্রিনউডের কারখানায় একটা চমৎকার বিষয় ছিলো। তিনি কারখানার সব কাজে যন্ত্র নির্ভর হননি। যারা তার দাদীর মত হাতে সেলাই করতে পারেন তাদের তিনি সেলাই করার কাজ দিতেন। তাছাড়া মহিলারা একাজ করতো যার যার বাড়িতে, কারখানায় গিয়ে তাদের কাজ করতে হতো না। বাড়িতে থাকার কারণে তাদের ঘরের কাজে যেমন কোন অসুবিধা হয়নি, তেমনি বাড়তি উপার্জনও হয়েছে।

১৯৭৭ সালে, গ্রিনউডের পোটেন্ট লাভের ঠিক একশো বছর পর। ফার্মিংটনের অধিবাসীদের মনে হলো গ্রিনউড যে চমৎকার উদ্ভাবন করেছেন, তা লোকজনকে ঠিকঠাক মতো জানাতে হবে। নয়তো ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন গ্রিনউড।

মেইন রাজ্য সরকারের সাথে তারা কথা বলে শীতের শুরুর দিন, মানে ডিসেম্বরের ২১ তারিখ, চেস্টার গ্রিনউড দিবস ঘোষণা করেন। ইতিহাসে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নেন চেস্টার গ্রিনউড।

লেখকঃ মানিক চন্দ্র দাস।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info