গ্রিম ভাইদের সেই বইটি ।। The Book Of Grim Brothers


১৮১২ সালের ২০ ডিসেম্বর। জার্মানিতে প্রকাশিত হল একটি বই। নাম, Die Kinder und Hausmärchen, নামটা ইংরেজিতে এরকম চিলড্রেন’স অ্যান্ড হাউজহোল্ড টেইলস। হ্যাঁ, সেটা ছিল একটা রূপকথার বই। আর তাতে ছিল জার্মানি আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা মোট ৮৬টি রূপকথা।

খটমটে নাম শুনে বুঝি বইটাকে আর চিনতেই পারছেন না। গল্পগুলোকে চিনতে পারবেন, দেখেন তো চিনতে পারো কিনা? Aschenputtel, Der Froschkönig, Hänsel und Gretel, Rumpelstilzchen, Schneewittchen। কি? তাও চিনতে পারছেন না? আচ্ছা, খটমটে জার্মান নাম বাদ দিয়ে, গল্পগুলোর বাংলা নাম বলছি, এবার দেখেন তো, সিন্ডারেলা, ব্যাং রাজকুমার, হ্যানসেল অ্যান্ড গ্রেটেল, রাপুনজেল, স্নো হোয়াইট, চিনেছেন তো?

hybridknowledge.info hybridknowledge.info

বইটার গল্প না হয় জানা গেল, কিন্তু এতো কষ্ট করে রূপকথার গল্পগুলো সংগ্রহ করলো কারা? কারা আবার, বিখ্যাত গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়, ইয়াকোব গ্রিম আর ভিলহেম গ্রিম। এই দুই ভাই ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী। তারা পড়াশুনা করেছিলেন জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তারা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জার্মান ইতিহাসবিদ ফ্রিডরিশ ফন স্যাভিনি’কে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো অনেক শিক্ষকই থাকেন। আলাদা করে তার নামই কেন বললাম? তিনিই যে দুই ভাইকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।


এখন, রূপকথার গল্প শুনতে তো ভীষণ মজা। রূপকথার গল্পের আরেকটা বিশেষ গুরুত্বও আছে। অনেক মানুষ রূপকথার গল্পে তাদের নিজেদের জীবনের অনেক কথাই, নিজেদের অজান্তেই ঢুকিয়ে দিত। গল্পগুলোর বর্ণনা থেকে আপনি যেমন তাদের জীবনের নানাকিছু জানতে পারবেন, তেমনি তাদের আশা আকাক্ষার কথাও জানতে পারবেন। তারা কী কী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতো, কীভাবে উৎসব করতো, এগুলো গল্পগুলোতে থেকেই যেতো। এখন শুধু এটুকু জেনে রাখেন, রূপকথা থেকে প্রাচীন কালের ইতিহাসের অনেক কিছুই জানা যায়। আবার, প্রত্যেকটা জাতির রূপকথার গল্পগুলো যেমন সেই জাতির নিজস্বতার প্রতীক, তেমনি নিজস্ব ঐতিহ্যও বহন করে। তাই, প্রত্যেকটা জাতির জন্যই তাদের রূপকথার গল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লোকছড়া বইগুলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় যখন তাদের দেশের, মানে জার্মানির রূপকথার গল্পগুলো সংগ্রহ করছেন, তখন এই কথাগুলো মানুষ মাত্র বুঝতে শুরু করেছে। আর এ বিষয়ে পড়াশুনা তো ওভাবে শুরুই হয়নি। পুরোনো দিনের শিল্প সাহিত্য, মানে গল্প, ছড়া, নাচ, গান, ছবি, ধাঁধা এসব নিয়ে যে বিষয়ে পড়াশুনা করা হয়, সেটাকে বলা হয় "ফোকলোর"। এই ফোকলোরের অনেক কিছুই ঠিক করে দিয়ে গেছেন এই দুই ভাই। এমনকি, কীভাবে রূপকথার গল্প সংগ্রহ করতে হয়, তারও অনেক কিছুই তারা ঠিক করে দিয়ে গেছেন।


এতো কথা কেন বললাম? গ্রিম ভাইদের এই কাজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। তাদের জন্য এই কাজটা কতোটা কঠিন ছিল, তা বোঝানোর জন্য। আর গ্রিম ভাইরা যে শুধু ফোকলোর বিষয় নিয়েই কাজ করেছেন তাই না, তারা ফিলোলোজি আর জার্মান স্টাডি বিষয় দুটিকেও প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। ভাবছেন, জার্মান স্টাডি তো বুঝলাম, কিন্তু ফিলোলোজিটা আবার কী? ওই যে, রূপকথার একটা বৈশিষ্ট্য বললাম না, সেখানে মনের অজান্তেই মানুষ নিজেদের জীবনের অনেক কিছু ঢুকিয়ে দিত। সাহিত্যের এসব বিষয় নিয়েই কাজ কারবার হয় ফিলোলোজিতে।

অনেক গল্প হল, এবার গ্রিম ভাইদের সেই বিখ্যাত বইটির গল্পে আসা যাক। দুই বছর পরে, ১৮১৪ সালে বের হল বইটির দ্বিতীয় খণ্ড, এটাতে ছিল আরো ৭০টি গল্প। এরপর দুই খণ্ড একসঙ্গে প্রকাশিত হল বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮১৯ সালে। ১৮২২ সালে প্রকাশিত হল বইটির তৃতীয় খণ্ড, সব মিলিয়ে মোট গল্পের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭০টি। এরপর ৩৭ সালে তৃতীয় সংস্করণ, ৪০ এ চতুর্থ, ৪৩ এ পঞ্চম, ৫০ এ ষষ্ঠ আর ৫৭ তে সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হল। প্রতিটি সংস্করণেই কিছু গল্প যোগ হল। অনেক গল্প আবার বাদও পড়ে গেল। সব মিলিয়ে, সপ্তম সংস্করণে গিয়ে মোট গল্পের সংখ্যা দাঁড়াল ২১১টি।


১৮২৫ সালে দুই ভাই মিলে বের করল বইটির একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ, বিশেষ করে ছোটদের জন্য বাছাই করা ৫০টা গল্প নিয়ে। বইটির ছোটদের সংস্করণটি একদম হটকেকের মতো বিক্রি হল, ১৮২৫ থেকে ৫৮ সালের মধ্যেই ১০টি সংস্করণ প্রকাশ করতে হল।

বইগুলো কিন্তু মোটেও সাদামাটা ছিল না। প্রত্যেকটাতেই ছিল চমৎকার সব ছবি আর কার্টুন, যাকে বলে ইলাস্ট্রেশন। ইলাস্ট্রেশনগুলো করতেন ফিলিপ গ্রট ইয়োহান। পরে অবশ্য ১৮৯২ সালে তিনি মারা যান। এরপরে প্রকাশিত বইগুলোর জন্য আঁকাআঁকির কাজটি করতেন রোবার্ট লেইনওয়েবার।


গ্রিম ভাইদের বিখ্যাত এই বইটা কতোগুলো ভাষায় অনূদিত হয়েছে বলতে পারেন? ১০০টিরও বেশি ভাষায়। আর ডিজনি তো গ্রিম ভাইদের অনেকগুলো গল্প নিয়েই সিনেমা বানিয়েছে। কেন, স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্যা সেভেন ডোয়ার্ফ, স্লিপিং বিউটি, সিন্ডারেলা, দ্য ট্যাঙ্গেলড এই সিনেমাগুলো দেখেননি? এই সিনেমাগুলোর কাহিনী তো এই বইটির রূপকথা থেকেই নেয়া!

এ বছর বইটি প্রকাশের দুইশ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। আপনারা তো বইটির প্রায় সব গল্পই পড়ে ফেলেছেন। আর যেগুলো পড়েননি, সেগুলো ইন্টারনেটে খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেলতে পারেন। আর বইটির বাংলা অনুবাদও কিন্তু আছে। সেটা জোগাড় করেও পড়ে ফেলতে পারেন। তাহলে আর কী, যেগুলো বাকি আছে, সেগুলো পড়ে ফেলেন। আমিও গল্পগুলো আরেকবার পড়ে নেই।

লেখকঃ নাবীল আল জাহান।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।