যখন সফল একটি মিশন শেষ হয় ট্র্যাজেডিতে ।। When A Successful Mission Ends In Tragedy

সভ্যতার অগ্রগতি একদিনে সাধিত হয়নি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তিল তিল করে অনেক আদম সন্তানের ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠে এই সভ্যতা। আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছি যে চাইলেই আমরা এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞানের বেদিমূলে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তারা মানবজ জাতির উন্নতি আর অগ্রগতির কথা চিন্তা করেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। তারা মানবজাতির নায়ক। আজ এমনই তিন মহানায়কের কথা বলব যারা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

 সয়ুজ ১১ এর তিনজন নভোচারী।
১৯৭১ সালের ৩০ জুন। কাজাখস্থানে গ্রাউন্ড ক্রুরা অপেক্ষা করছিলেন তিনজন কসমোনাটকে পৃথিবীতে স্বাগত জানানোর জন্য। তারা ছিলেন সয়ুজ ১১ মহাকাশযানের তিন নভোচারী জিওর্জি দব্রভলস্কি, ভিক্টর পাতসায়েভ এবং ভ্লাদিস্লাভ ভলকভ। এই তিন কসমোনাট ছিলেন বিশ্বের প্রথম স্পেস স্টেশন স্যালুত ১ এরও প্রথম ক্রু । তারা তিন সপ্তাহ সেখানে ছিলেন এবং এরপর ফিরে আসবেন। কিন্তু গ্রাউন্ড ক্রুরা জানতেন না তারা কি দেখবেন। এই তিনজন কসমোনাট আর পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় ফিরে আস্তে পারেননি। এটি ছিল মহাকাশে এই পর্যন্ত একমাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা। একটি নির্ভুল মিশনের সমাপ্তি ঘটল ট্র্যাজেডিতে।

সয়ুজ সিরিজ ছিল সোভিয়েতদের মহাকাশযান। এখনও সয়ুজ সিরিজের মহাকাশযানগুলো রাশিয়ানরা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে নভোচারীদের যাতায়াতে। প্রকৃতপক্ষে এটি নকশা করা হয়েছিল চন্দ্রযাত্রার জন্য। ১৯৬৯ এর জুলাই মাসে আমেরিকানরা চাঁদে পা রাখে। এই যাত্রায় সোভিয়েতরা আমেরিকানদের কাছে হেরে যায়। তখন তারা স্পেস স্টেশন গড়ার কাজে মন দেয়। এবং তারা সফলতা লাভ করে এই বিষয়ে।

বিশ্বের প্রথম স্পেস স্টেশন স্যালুত ১
সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম স্পেস স্টেশন স্যালুত ১ উৎক্ষেপণ করে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল। সয়ুজ ১০ স্যালুত ১ এ অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর প্ল্যান করা হয় সয়ুজ ১১ উৎক্ষেপণের। ১৯৭১ সালের ৭ জুন সয়ুজ ১১ উৎক্ষেপণ করা হয়। ঐ একই দিনে সয়ুজ ১১ সফলভাবে স্যালুত ১ এ অবতরণ করে।

সয়ুজ ১১ এর ক্রুরা এই ব্যাচ ব্যবহার করেন।
এক্স মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে এই প্রথম কোন মহাকাশযান কোন স্পেস স্টেশনে অবতরণ করে। তিনজন কসমোনাট সেখানে ২২ দিন অবস্থান করেন। তারা মহাকাশে অবস্থানের একটি নতুন রেকর্ড গড়েন ১৯৬৫ সালে আমেরিকার জেমিনি ৭ এর ১৩ দিন আর ১৯৭৯ সালে সয়ুজ ৯ এর ১৮ দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে মার্কিন স্কাইল্যাব মিশনে সয়ুজ ১১ র রেকর্ড ভেঙ্গে যায়।

সয়ুজ ১১ এর কসমোনাটরা আরও কিছু ইতিহাস গড়েন। প্রথম মিশন কন্তসাথে লাইভ টেলিভিশন যোগাযোগ, পাতসায়েভের ৩৮ তম জন্মদিন উৎযাপন, এমনকি ভোট দেওয়া। তারা সেখান থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তারা প্রথম স্পেস স্টেশনে একটি ট্রেড মিল ব্যবহার করে ব্যায়াম করেন।

১৯৭১ সালের ৩০ জুন কমান্ডার দব্রভলস্কি জানান তারা সফলভাবে স্যালুত ১ ত্যাগ করেছেন। যেটা ছিল একটি রুটিন মিশন তা ব্যর্থ হয় নির্মমভাবে। ক্রুরা যখন পৃথিবীতে অবতরণের পর সয়ুজ ১১ এর ক্যাপসুল খুলেন তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন যা দেখার জন্য তাই দেখলেন। এমনকি মিশন কন্ট্রোল কিছু বলবে পারে নাই ভিতরে কি ঘটছে। তারা দেখলেন তিন কসমোনাটের প্রাণহীন দেহ সিটবেল্ট দিয়ে বাঁধা। তারা শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন।

রেসকিউ টিম কসমোনাটদের কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন দিচ্ছে।
গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। নিহতদের বীরের মর্যাদা দিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় ক্রেমলিন দেয়ালের কাছে যেখানে রয়েছে ইউরি গ্যাগারিনের সমাধি।

এরপর সয়ুজ মহাকাশযানগুলোকে নতুনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে মহাকাশচারীরা যানের ভিতর স্পেস স্যুট পড়ে থাকতে পারেন যেটা সয়ুজ ১১ তে তারা পারেন নাই জায়গার অভাবে।

রাশিয়ানরা তাদের লৌহ কঠিন আইনের কারণে তদন্তের কথা বাইরে তেমন ফাঁস করে নাই। কিন্তু আমেরিকানরা ধারণা করে সোভিয়েতরা ক্রুটি ঠিকই বের করে এবং তারা এটাও বের করে ঠিক কোন সময়ে নভোচারীরা মারা যান।

অনেকে বলে দীর্ঘদিন ওজনশূন্যতা আর অভিকর্ষহীনতায় থাকার ফলে তারা পৃথিবীর অভিকর্ষে ফিরে আসার পর আর সহ্য করতে পারেন নাই। কিন্তু তা যদি হয় তিনজনেরই হৃদস্পন্দন ঠিক একই সময়ে কেন থেমে গেল? তাছাড়া তারা তো স্পেস স্টেশনে সুস্থই ছিলেন। ওজনশূন্যতা আর অভিকর্ষহীনতার কোন অভিযোগও তারা করেন নাই।

সত্যতা জানা যায় ১৯৭৫ সালে অ্যাপোলো সয়ুজ টেস্ট প্রজেক্টে আমেরিকানরা যখন সোভিয়েতদের সাথে কাজ করছিল। জানা যায় ক্যাপসুলের ভিতর বায়ুচাপ কমে যাওয়াতেই কসমোনাটরা মারা গিয়েছিলেন। পতনের সময় সয়ুজ ১১ যখন তার রেটরো রকেট ফায়ার করে তার ৭২৩ সেকেন্ডের ভিতর। ১২ টি রকেট একসাথে প্রজ্বলিত হয়। কথা ছিল একটির পর একটি প্রজ্বলিত হবে। এই প্রচণ্ড চাপের ফলে ক্যাপসুলের ভিতরে যে চাপ নিয়ন্ত্রণের ভাল্ভ আছে তা খুলে যায় ভূমি থেকে ১৬৮ কিমি উপরে এবং ধীরে ধীরে ক্যাপসুল চাপশূন্য হয়ে যায়।

কসমোনাটরা হয়ত চাপ হারানোর হিস হিস শব্দটি শুনতে পেরেছিলেন। হয়ত তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সময় ছিল খুবই কমে এবং ভাল্ভটি ছিল তাদের সিটের নিচে। কসমোনাটদের বায়োমেডিক্যাল সেন্সর থেকে জানা যায় ৪০ সেকেন্ডের ভিতর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।

পরে ফুটেজ থেকে দেখা যায় রেসকিউ টিম তাদের কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন দিচ্ছে। কিন্তু তো কসমোনাটরা আগেই মারা গিয়েছেন।

সোভিয়েতদের এই মিশন অনেক সাফল্যলাভ করে। এটা থেকে বোঝা যায় স্পেস স্টেশনে মহাকাশযান অবতরণ করতে পারে আবার তা ত্যাগও করতে পারে। কিন্তু শেষটা ছিল এক ট্র্যাজেডি। এর চারবছর আগে ১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি অ্যাপোলো ১ পরীক্ষামূলক লঞ্চ করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যায় এবং তিন নভোচারী ভিরগ্রিল গাস গ্রিসম, এডওয়ার্ড হোয়াইট এবং রজার বি চাফফি নিহত হন।

এই মানুষগুলো তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের চিরচেনা জগতের পরিধি প্রসারিত করতে। এরাই মানবজাতির প্রকৃত বীর। তারা তারার দেশে চলে গেছেন কিন্তু মহাকাশবিজ্ঞানকে নিয়ে গিয়েছেন অনেক দূরে। তাদের এই আত্মত্যাগের ফলেই আমরা আরও গভীরে আরও অজানার পথে পাড়ি জমাতে পারি। কে জানে হয়ত আমরা একদিন আন্তনাক্ষত্রিক সভ্যতাতে উপনীত হব। সেদিনও আমরা এই কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো যারা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তারার পানে ছুটে যাওয়ার।

লেখকঃ নিঃসঙ্গ গ্রহচারী।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info