গুজবের ডালপালায় পশুপাখিরা ।। Myths About Animals

জীবজন্তুরা প্রায় সময়ই মজার মজার সব কান্ড করে। এই যেমন ধরেন জিরাফের কথা। জিরাফের গলা লম্বা সেটা তো জানেনই। কিন্তু ওদের জিহ্বাও যে অনেক লম্বা সেটা কি জানেন? এই লম্বা জিহ্বা দিয়ে সে তার চোখ আর কান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। আবার এদিকে চোখের পাতা ফেললে আপনি তো চোখে কিছু দেখতেই পাবেন না। কিন্তু সাপ তার চোখের পাতার ভিতর দিয়ে দিব্যি সব কিছু দেখতে পায়।

প্রাণীদের এসব মজার কান্ড কারখানা সত্যি সত্যিই আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু মিথ্যে গুজবও আছে তাদের নিয়ে। যেমন ধরেন, অনেকেই বলে ফুলের গন্ধে সাপ আসে, ইঁদুরের গর্তে দাঁত রাখলে নতুন দাঁত গজায়, এরকম আরও অনেক কিছু। অথচ বাস্তবে যদি খোঁজ খবর নিতে যান, তাহলে দেখবেন ওগুলো শুধুই রটনা। যার সাথে বাস্তবের কোন মিল তো নাই, কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রকৃত ঘটনা পুরোটা উল্টো।

জীব জন্তুরা হয়তো জানে না, তাদের নিয়ে মানুষ এতো মিথ্যে গুজব রটিয়ে রেখেছে। এই খবর যদি ওরা জানতো তাহলে এই সব নিরীহ জীবজন্তুরা মনে কষ্ট পেতো নিশ্চিত। আপনি কি বলেন?


প্রচলিত ধারণাঃ ইঁদুরের গর্তে দাঁত রাখলে নতুন দাঁত গজায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ (ছোট বেলায়) হঠাৎ করে একদিন সকালে আয়নায় তাকিয়ে দেখলেন আপনাদের মুখে সামনে একটা দাঁত নেই। অনেকেই এক্ষেত্রে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে। ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত উঠে এটাই স্বাভাবিক। দুধের দাঁত পড়ে গেলে বড়ো অনেকে বলেন, ‘এই দাঁত ইঁদুরের গর্তে রেখে আসো। তাহলে তোমার ইঁদুরের মতো ঝকঝকে আর শক্ত দাঁত হবে।’ আসলে কি তাই হয়! আপনি যদি ইঁদুরের গর্তে ওই দাঁতটা নাও রেখে আসেন তাহলেও দেখবেন আপনার ঠিকই দাঁত উঠবে। আর নিয়মমতো নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার রাখলে আপনার দাঁত সুন্দর আর ঝকঝকে হবে।

প্রশ্ন করবেন, তাহলে বড়রা এরকম বলে কেন? আসলে অনেক সময় পড়ে যাওয়া দাঁত যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে সেটা আপনাদের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন ধরেন দাঁতটা আপনার মনের ভুলে পায়ে বিঁধে গেল। তাহলে তো একেবারে রক্তারক্তি কান্ড হয়ে যাবে। তাই ইঁদুরের গর্তে ফেললে এই বিপদ থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যাবে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info


প্রচলিত ধারণাঃ কুনোব্যাঙ স্পর্শ করলে শরীরে আঁচিল বা ব্রন হয়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ মানুষের দেহে অনেক সময় আঁচিল বা ব্রন দেখা যায়। অনেকে মনে করেন এসব ব্রন কোন ব্যাঙকে স্পর্শ করার ফল। আপনি জেনে অবাক হতে পারেন আসল কারণ কিন্তু ভিন্ন। সাধারণত মুখে বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্রন হয় ভাইরাসের কারণে। ত্বক বিশেষজ্ঞরা এরকমই বলেন। এর সাথে ব্যাঙকে স্পর্শ করার কোন সম্পর্ক নেই।

তবে এটাও মনে রাখবেন, কিছু কিছু ব্যাঙের কানের পেছনে আঁচিল থাকে। এই আঁচিলগুলোও কিন্তু বেশ ভয়ংকর। কারণ এর মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ থাকে। যা ব্যাঙ নিজেকে বাঁচাতে শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারে। এই বিষাক্ত পদার্থ শরীরে লাগলে তা থেকে বিশ্রি ঘা হতে পারে। তাই অযথা এসব ব্যাঙকে বিরক্ত না করাই ভালো।


প্রচলিত ধারণাঃ মশারা মানুষ বা অন্য প্রাণীদের কামড়ায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ মশা আমাদের রক্ত খায়। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে স্ত্রী মশা আমাদের দেহের রক্ত খায়। কিন্তু মশা কি আমাদের কামড়ায়? কাউকে কামড়াতে গেলে তার দাঁত থাকতে হয়। মশার কি দাঁত আছে? আসলে মশার কোন দাঁত নেই। আর দাঁত না থাকলে কামড়ানোর কোন প্রশ্নই তো আসে না। সুতরাং এক দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায় মশারা আমাদের কামড়ায় না।

হরদমইতো মশা আমাদের রক্ত খেয়ে ফেলছে। এখানে ব্যাপার হলো, মশারা রক্তের প্রয়োজনে আমাদের শরীরে বসে লম্বা ও সরু একটা নল ঢুকিয়ে দেয়। আমাদের শরীরে রয়েছে অসংখ্য রোমকূপ। নলটা ঢোকায় তারা রোমকূপের ছিদ্র দিয়ে। তারপর আরামসে রোমকূপের মধ্য দিয়ে ঢোকানো নল দিয়ে রক্ত চুষতে থাকে। রক্ত খাওয়া শেষে সুযোগ মতো পালিয়ে যায়। সরু নল শরীরে ঢোকার কারনে ব্যথা আমরা পাই আমরা। তখনই মনে হয় মশা আমাদের কামড়াচ্ছে।


প্রচলিত ধারণাঃ উটপাখি ভয় পেলে বালির গর্তে মুখ লুকায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ জীবন্তু পাখিদের মধ্যে উটপাখি সবচেয়ে বড় পাখি। অনেকের ধারনা, এই পাখি ভয় পেলে বালির গর্তে মুখ লুকায়। কিন্তু এই ধারণাটি সত্যি? আসেন যাচাই করে দেখি। উটপাখির দেহের তুলনায় তার মাথা একেবারে ছোট। এই পাখি তাদের ডিম বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে রেখে দেয়। মাঝে মাঝে তারা এই গর্তের ডিমগুলো পরীক্ষা করে দেখে, সেগুলো ঠিক আছে কিনা। আবার অনেক সময় আশেপাশে শত্রুকে দেখলেও সে ডিমগুলোর খোঁজ নেয়। এসময় অনেকদূর থেকে এই পাখিকে দেখলে মনে হবে তারা বালির মধ্যে মাথা ঢুকিয়েছে।

বালির মধ্যে উটপাখি মাথা ঢুকিয়ে রাখলে সে মারা যাবে। কারণ সেখানে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার জন্য তার শরীরে কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন।


প্রচলিত ধারণাঃ র‌্যাকুনরা খাবার ধুয়ে খায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ উত্তর আমেরিকার পরিচিত একটি প্রাণী র‌্যাকুন। ঘন লোমে আবৃত এই প্রাণীরা দলবদ্ধভাবে কোন জলাশয় বা পানির ধারে বাসা বানিয়ে বাস করে। এরা সর্বভূক প্রাণী। এদের খাদ্য তালিকায় আছে ব্যাঙ, মাছ ছাড়াও ফলমুল, পাখির ডিম,ধান, ভুট্টা, গম ইত্যাদি। অনেকের ধারনা র‌্যাকুনরা যে কোন খাবার আগে সেটা ধুয়ে খায়। আসল ব্যাপার কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। সাধারণত র‌্যাকুনরা পুকুর, জলাশয় বা ডোবায় খাবার শিকার করে। শিকার ধরতে এরা তাদের থাবাকে পানির মধ্যে নাড়ায়। এভাবেই তারা মাছ, ব্যাঙ শিকার করে। তাদের খাবার ধরার এই পদ্ধতির কারণেই অনেকে ধারনা করতে পারে র‌্যাকুনরা খাবার ধুয়ে খায়। বাস্তবে দেখা গেছে, র‌্যাকুনসরা খাবারের অভাবে ময়লা আবজর্নাও খায়।


প্রচলিত ধারণাঃ সাপ চুরি করে গরুর দুধ খায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ আমাদের দেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন রাতের বেলা সাপ এসে গরুর দুধ চুরি করে খায়। আর এ কারণে পরদিন গরুর কাছ থেকে গরুর মালিক কাংখিত দুধ পায় না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনেকেই এখনও এটা বিশ্বাস করে। আর এর প্রতিকার স্বরূপ তারা কবিরাজ বা অন্য এ ধরণের আধ্যাত্মিক গুরুর কাছ থেকে গরুর জন্য তাবিজ কবজ বা অন্য কিছু নিয়ে আসে। কিন্তু সাপ কি আসলেই গরুর দুধ খায়? প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলেন, মুখের গঠনের কারণে সাপ দুধ বা তরল কোন খাবার খেতে পারে না। তবে অনেক সময় সাপ অত্যাধিক গরমে পানিতে মাথা ভেজায়। আর গরুর দুধের বাটে মুখ রেখে সাপের পক্ষে দুধ খাওয়া তো রীতিমতো অসম্ভব একটা ঘটনা। তাই এই গুজবে কান দিবেন না।


প্রচলিত ধারণাঃ বাঁদুড় চোখে দেখতে পায় নাঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ অনেকের ধারণা বাঁদুড় অন্ধ। সে চোখে কিছুই দেখতে পায় না। এজন্য জীবজন্তু প্রেমিক অনেকেই বাঁদুড়ের জন্য মনে কষ্ট পান। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাঁদুড় অন্ধ নয়, তারা দেখে। তাদের দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ। তবুও এদের চলাফেরা বা খাদ্য সংগ্রহ করতে কোন অসুবিধা হয় না। বরং অন্ধকার রাতেও চলার পথের সামনে কোথায় কী আছে তা ঠিকই বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে? বাঁদুড় মূলত ‘ইকোলোকেশন’ পদ্ধতিতে চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহ করে। শব্দের প্রতিধ্বনির মাধ্যমে কোন কিছু শনাক্ত করাই হচ্ছে ইকোলোকেশন। এই পদ্ধতিতে বাঁদুড় তাদের মুখ ও নাক দিয়ে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই শব্দ তরঙ্গ চলার পথে কোন বাধা পেলে প্রতিধ্বনি হিসেবে ফিরে আসে। এই প্রতিধ্বনির মাধ্যমেই বাঁদুড় যে কোন বস্তুর আকার, গঠন এবং অবস্থান বুঝতে পারে। এ কারণেই বাঁদুড় অন্ধকারে অনায়াসে চলাচল করতে পারে।

এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাঁদুড়ের চোখ বেঁধে দিলে তাদের চলাফেরায় কোন সমস্যাই হয় না। কিন্তু কান বেঁধে দেবার পর তারা আর চলতে পারে না। তাহলেই বুঝতে পারছ শব্দ তাদের জন্য কতো গুরুত্বপুর্ণ।


প্রচলিত ধারণাঃ বিড়াল রাতের অন্ধকারে দেখতে পায়ঃ
প্রকৃত ঘটনাঃ রাতের অন্ধকারে বিড়াল চলাফেরা করতে দেখে অনেকের ধারণা, বিড়াল রাতের অন্ধকারে দেখতে পায়। মনে রাখবেন এই তথ্যটি আংশিক সত্য। আসলে বিড়াল পুরোপুরি অন্ধকার রাতে কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু খুব সামান্য পরিমাণ আলো থাকলেই বিড়ালের জন্য যথেষ্ট। এরকম আলোয় মানুষ কিছুই দেখতে পাবে না। কিন্তু বিড়াল এসব ক্ষেত্রে অনেক ভালো দেখতে পায়। কারণ বিড়ালের চোখের রেটিনার পেছনে টাপেটাম নামে একটি অংশ আছে। বাইরে থেকে আসা সামান্য পরিমাণ আলো টাপেটামে প্রতিফলিত হয়ে চোখের কোন কোষে আঘাত করে। টাপেটাম থেকে কোন কোষে প্রতিফলিত হবার সময় আলো কিছুটা বর্ধিত হয়। ফলে বিড়াল স্বল্প আলোতেও স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। অন্ধকারে বিড়ালের চোখ জ্বলজ্বল করে এই টাপেটামের কারণে।

টাপেটাম বিড়ালকে স্বল্প আলোয় ভালোভাবে দেখতে সাহায্য করলেও আরও কিছু বৈশিষ্ট্য বিড়ালকে অন্ধকারে চলতে সাহায্য করে। বিড়ালের ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি বেশ প্রখর। আর এগুলোই বিড়ালকে অন্ধকারে শিকার খুঁজে নিতে বা নিরাপদে চলাচল করতে অনেকটা সাহায্য করে। তাই পুরোপুরি অন্ধকার রাতেও বিড়াল এসবের উপর নির্ভর করে পথ চলতে পারে।

লেখকঃ এবি।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।