ইউরোপের মাটিতে সবচেয়ে বড় মসজিদ কমপ্লেক্স


মুসলিম দেশে মসজিদ নির্মাণ যতটা সহজ খ্রিস্টান জন অধ্যুষিত কোন দেশে মসজিদ নির্মাণ ততটা কঠিন। গোটা পৃথিবীর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের তীর্থভূমিতে মসজিদ চিন্তা করতেও গা শিউরে উঠে। রোম খ্রিষ্টান ধর্মাবলীদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। রোমের মধ্যে ভ্যাটিকান সিটি হল মাত্র ১১০ একরের আলাদা একটা দেশ যা পোপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই রোম বলতে রোমান ক্যাথলিকদের তীর্থ স্থান, ভ্যাটিকান সিটি, পোপ, সেন্ট পিটার ও সান্তা মারিয়া গীর্জা, খ্রিষ্টানদের গৌরব ইত্যাদির কথা মনে করা হয়। সেই রোমেই তৈরি হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ইতালীয় ভাষায় এটা Moschea di Roma নামে সমধিক পরিচিতপ্রায় ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই মসজিদের বাইরে-ভেতরে ২০ হাজার মুসল্লি একসাথে নামায আদায় করতে পারেন। ১৯৬৯ সালে ২৪ টি মুসলিম দেশ ইতালী সরকারের কাছে রোমে একটি ইসলামিক কালচারাল সেন্টার খোলার আহ্বান জানান, তখন অনুমতি পাওয়া যায়নি। সে সময় রোমে এত মুসলিম ছিল না। বর্তমানে ইতালীতে ১.৫ মিলিয়ন বা প্রায় ১৫ লক্ষ মুসলিম বসবাস করে তাই সময়ের কথা বিবেচনা করে ইতালী সরকার এই মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয় এবং ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বৃহত্তম মসজিদ এখন রোমে অবস্থিত।

রোম নগরীর উত্তরাঞ্চলের Acqua Acestosa নামক এলাকায় সারিবদ্ধ বৃক্ষের সবুজ বেষ্টনীতে অবস্থিত এ মসজিদ কমপ্লেক্সে রয়েছে প্রশস্ত নামাযের জায়গা, অযুখানা, শৌচাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মিলনায়তন, পাঠদান কক্ষ, উন্মুক্ত মাঠ, লাশ ধৌতকরণ ও জানাযার ব্যবস্থা। মসজিদ কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে ১০ বছর। রোমান সিটি কাউন্সিল ১৯৭৪ সালে কমপ্লেক্সের জন্য ভূমি দান করেন। ১৯৯৫ সালের ২১ জানুয়ারী ইতালীয় প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট Sandro Pertini এর উপস্থিতিতে মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। কমপ্লেক্সটি নির্মাণের উল্লেখযোগ্য ব্যয়ভার বহন করেন সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল ইবন আবদুল আযিয, আফগানিস্তানের প্রিন্স মুহাম্মদ হাসান ও তদীয় স্ত্রী প্রিন্সেস রাযিয়া বেগম। একদা সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল ইবন আবদুল আযিয রাস্ট্রীয় সফরে রোম আসলে জামায়াতে নামায আদায়ের জন্য কোন মসজিদ পাননি। রোমে কোন মসজিদ নেই একথা জেনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তখন থেকে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে থাকেন।

ইরাকী স্থপতি সামী মুসাভী ও ইতালীয় স্থপতি Paolo Portoghesi কর্তৃক ডিজাইনকৃত নকশা অনুযায়ী মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ চুড়ান্ত হয়। খ্যাতনামা ৪০ জন স্থপতির মধ্যে এ দু’জনের লে-আউট শ্রেষ্ঠতার বিচারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। মসজিদ স্থাপত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ১২৮ ফুট উঁচু মিনারটিও বেশ দৃষ্টিনন্দন। সেন্ট পিটার্স গীর্জার গম্ভুজের চাইতে এর উচচতা ২ ফুট কম। ইসলামী ঐতিহ্য ও আধুনিক ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয় সাধনের একটি আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলো উত্তর আফ্রিকার (মাগরিব) পাম বৃক্ষের আদলে তৈরী। মসজিদের বাইরে-ভেতরে এমনভাবে আলোক প্রক্ষেপণের ব্যবস্থ করা হয়েছে যে, রাতের বেলা মনে হয় যেন মসজিদের চার পাশে প্রস্রবণের ফল্গুধারা প্রবাহিত।

মসজিদের অভ্যন্তরীণ করিডোর
খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীতে ইসলামের আগমণ ইতালীতে। অস্টম শতাব্দীতে ইতালীর বিভিন্ন দ্বীপ বিশেষত পেন্টেলেরিয়া, সিসিলি, আপুলিয়া, সারদিনিয়ায় মুসলমানদের অভিযানের ফলে ইতালীতে ইসলাম প্রচার সহজতর হয়। ১৫ শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপে উসমানীয় তুর্কীদের অভিযানের ফলে বহু মুসলিম পরিবার ইতালীতে বসতি স্থাপন করে। মূলত মরক্কো, তিউনিশিয়া ও মিশর হতে আগত মুসলমানরা রোমসহ ইতালীতে বসবাস করতে থাকে। রাস্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি না দিলেও ক্যাথলিসিজমের পর ইসলাম হচ্ছে ইতালীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।

২০০১ সালে সৌদি আরবে নিযুক্ত রোমের রাস্ট্রদূত Torquato Cardilli আনুষ্ঠানিক ভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ ইতালীর নেপলস বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ইসলাম বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন ছিল ব্যাপক। ৩৩ বছর ধরে আরব বিশ্বের ইরাক, সুদান, লিবিয়া, রিয়াদ, সিরিয়া, আলবেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় রাস্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালীণ ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি তিনি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এর পুর্বে ১৯৯৪-৯৫ সালে সৌদি আরবে নিযুক্ত Mario Scialoja নামক আরেকজন ইতালীয় রাস্ট্রদূত ইসলাম কবুল করে সরকারী চাকরী পরিত্যাগ করেন। দু’জন দায়িত্বশীল সরকারী কর্মকর্তার ইসলাম গ্রহণের কারণে ইতালীতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে ৫ হাজার মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কালিমা তাইয়্যেবার ছায়াতলে আসেন।

অনেকেই বলবেন, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট দেশে অন্যান্ন ধর্মের লোকদের খুঁজে পাওয়া দুঃস্কর। তাদের জন্য বলছি, মুসলিম দেশে গির্জা নির্মাণ মোটেই অসম্ভব নয় বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ৫৭ টি মুসলিম দেশে কম বেশী গির্জা রয়েছে এবং লাখ লাখ খ্রিষ্টান বিনা বাধায় ধর্ম কর্ম পালন করতে পারেন। মুসলিমদের তীর্থভূমি সৌদি আরবে বর্তমানে ১০ লাখ ক্যাথলিক খ্রিস্টান রয়েছে। পুণ্যভূমি ইরাকে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ৬ লাখ ৩৬ হাজার। ইরাকের বাগদাদ, মসুল, বসরা, আরবিল, কিরকুকসহ সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে গির্জা রয়েছে। নবী রাসূলদের দেশ সিরিয়ায় ২ লাখ খ্রিষ্টান নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করে আসছেন এবং রীতিমত গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে থাকেন। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে কপ্ট খ্রিস্টান রয়েছে ১৯,০০০,০০০ জন। নবী মূসা (আঃ) এর দেশ মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় কপ্টিক অর্থোডক্স চার্চের খ্যাতি বিশ্ব জোড়া।

লেখকঃ ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info