পুরাতন আকাশচুম্বী শহর ।। The Oldest Skyscraper City


বর্তমান সময়ে অনেকেই মনে করেন যে সুউচ্চ অট্টালিকা সমৃদ্ধ শহর বহন করে আধুনিকতার প্রতীক। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধারনা কিন্তু বাস্তব। কিন্তু এই সুউচ্চ অট্টালিকা বানাবার প্রথা কি চালু হয়েছে আমাদের এই আধুনিক যুগেই? যদি ভাবেন হ্যাঁ; তাহলে বলব না, আপনার ধারনা একদম ভুল। কেননা সুউচ্চ অট্টালিকা বানানো কিন্তু মোটেও আধুনিক যুগেই শুর হয়নি। আজ আপনাদের মরুভুমির এমন এক শহরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব যে শহরকে বলা হয় "Manhattan Of The Desert", আপনারাতো জানেনই যে বিশ্বের সব থেকে বেশি সংখ্যক উচু বিল্ডিং আছে আমেরিকার ম্যানহাটান শহরে। চলুন তাহলে আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই পৃথিবীর সব থেকে পুরাতন আকাশচুম্বী শহরের সাথে।


সারা বিশ্বের কাছে "Manhattan Of The Desert" নামে খ্যাত "ওয়াদি হ্যাড্রামউত" (Wadi Hadramout) নামে মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এই এলাকাটি "ইয়েমেন" (Yemen) দেশটির "সিবাম" (Shibam) শহরে অবস্থিত। শহরটির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল এই শহরটি পুরাটাই মাটির দেওয়াল দিয়ে গড়া। যেমন শহরকে ঘিরে রয়েছে মাটির দেওয়াল তেমনি এর ভিতরে গড়ে ওঠা সম্পূর্ন শহরটাই মাটির বাড়ি দিয়ে তৈরি করা। ১৯৮২ সালে, এই শহরকে "World Heritage" হিসেবে চিহ্নিত করে UNESCO। এই শহরটি গড়ে ওঠে ১৬শ শতকের দিকে, যা কিনা বিশ্বের সব থেকে পুরাতন শহর যাখানে রয়েছে মাটি দিয়ে তৈরি উচু টাওয়ারের মত বিল্ডিং। প্রায় ৪০০ বছর আগে এই শহর ছিল ব্যাবসা বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।


এই শহরটি মূলত সকলের দৃষ্টিকারে এর বাড়ি গুলির জন্য। এই শহরে মোট বাড়ির সংখ্যা ৫০০টি, আর বাড়ি গুলি ৫ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত। প্রতিটি তলা একটি পরিবারের জন্য বানানো। বর্তমান যুগের অনেকটাই ফ্লাটের পূর্বরূপ এই বাড়ি গুলি। শহরটিকে মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেবার মূল কারন ছিল তৎকালীন সময়ে বেদুইন দস্যুদের হাত থেকে শহরবাসীকে রক্ষা করা। আগেই বলেছি ৪০০ বছর আগে এটি ছিল ব্যাবসা বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। আর সে কারনেই এখানে যে দস্যুদের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও এই শহরটি মূলত স্থাপিত হওয়া শুরু হয় প্রায় ২৫০০ বছর আগে তারপরেও পরবর্তিতে শতাব্দি গুলিতে এর বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এ পর্যন্ত মাটির তৈরি শহর গুলির মধ্যে এই "ওয়াদি হ্যাড্রামউত" (Wadi Hadramout) শহরটির বাড়ি গুলিই সব থেকে উঁচু। বাড়ি গুলির বেশির ভাগ ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু।


এই শহরটিতে বর্তমানে প্রায় ৭,০০০ এর মত লোক বসবাস করে। আর তারা সকলেই এই বাড়িগুলির প্রতিটি তলা পেয়েছেন পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে। প্রতিটি বাড়ি মূলত তৈরি করা হয়েছিল ১০০ জন লোকের ধারন ক্ষমতা হিসাব করে। বাড়ি গুলির প্রতিটি তলা আবার তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন কাজে। নিচ তলা তৈরি করা হয় মূলত পোষা গৃহপালিত প্রানি রাখার জন্য, ২য় তলা বানানো হয়েছে ব্যাবসা বানিজ্যের দোকান বা লেনদেন করার অফিসের জন্য আর তৃতীয় তলা থেকে শুরু হয় মানুষের বসবাসের জন্য। ৩য় তলা থেকে আবার শুরু হত ভিন্ন নিয়ম। ৩য় তলা তৈরি হত অতিথিদের বসবাসের ব্যাবস্থার অনুসারে, ৪র্থ এবং ৫ম তলা তৈরি করা হত স্ত্রী এবং বাচ্চাদের থাকার ব্যাবস্থা অনুসারে আর ৬ষ্ঠ তলা তৈরি হত সাধারন রুম হিসেবে। ১ম এবং ২য় তলায় সাধারনত কোন জানালা রাখা হত না। এখানে বলে রাখি সেই সময়ে বাড়ি বানাবার এই নিয়ম মূলত ব্যাবহৃত হত একক মালিকাধীন বাড়ির ক্ষেত্রে। বর্তমানে এই ব্যাবস্থা আর নেই কেননা বংশ অনুসারে ভবিষ্যত বংশধররা প্রতিটি তলা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। আর বর্তমানে ব্যাবসা বানিজ্য তেমন না থাকায় এই শহরকে আর বাণিজ্যিক কেন্দ্রও বলা যায় না।


এই বাড়ির গুলির নকশা কিন্তু খুব আধুনিক ছিল, মানে বর্তমান যুগের বাড়ি গুলির নকশা গুলির সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এই বাড়ি গুলির মধ্যে সব বাড়ি কিন্তু বসবাসের জন্য ব্যাবহৃত হত না। এর মধ্যে ছিল কিছু বাড়ি যেগুলি ব্যাবহৃত হত মসজিদ হিসেবে, এমনকি কিছু কিছু বাড়ি ব্যাবহৃত হত শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে।


প্রতিটি বাড়ি তৈরি হয়েছে মাটির ইট দিয়ে। তবে এই ইট গুলি কিন্তু বর্তমান সময়ের ইটের মত আগুনে পোড়ানো হত না। এই মাটির তৈরি ইট তৈরি করার পূর্বে এর মাটির সাথে খড়কুটা এবং পানির সংমিশ্রন করা হত, এরপরে এই ইট গুলিকে নির্দিষ্ট আকৃতি দিয়ে রোদে শুকানো হত প্রায় তিন দিন। আর মরুভুমির রোদ কেমন উত্তপ্ত তা আশা করি আর বলে বুঝাতে হবে না। ব্যাস তিনদিন পরেই এই ইট গুলি তৈরি হয়ে যেত বাড়ি তৈরির জন্য।


প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির হাত থেকে বাড়ি গুলিকে বাঁচাতে এই বাড়ি গুলির বাইরের দেওয়ালে শুধু মাত্র চুনকাম করে দেওয়া হয়। ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট বৃষ্টির পানি থেকে বাড়ি গুলিকে বাঁচাতে। তা না হলে শত বছরের বেশি সময় ধরেও এই বাড়ি গুলি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হত না।


সিবাম (Shibam) শহরটি ১৬০ কিঃমিঃ লম্বা এবং ২ কিঃমিঃ চওড়া। শহরটি যেহেতু মরুভুমির মধ্যে অবস্থিত তাই এখানে বৃষ্টি হলেও তা খুব কম হয় আর বন্যা হওয়াটা অনেকটাই অসম্ভব। তারপরেও ১২৯৮ সালে এবং ১৫৩২ সালে এই সিবাম শহরে ভয়াবহ বন্যা হয়। যার ফলে এই শহর পুরাটাই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। মূলত বর্তমানে যে বাড়ি গুলি রয়েছে সে বাড়ি গুলি তৈরি করা হয়েছে ৪০০ বছর আগে।


এবার চলুন গুগল ম্যাপে দেখে নেই পুরাতন আকাশচুম্বী এই শহর,



লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info
জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info