আমাজনের বিস্ময় ।। Wonders Of Amazon


আমাজন রেইনফরেস্ট, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, পেরু, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, সুরিনাম, গায়ানা এবং ফ্রেঞ্চ গায়ানা, এই নয়টি দেশজুড়ে রয়েছে এর বিস্তৃতি।

সারাবিশ্বের প্রায় অর্ধেক অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে এই বন। আর এই বিশাল বনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র, ভয়ঙ্কর আর সুন্দর অসংখ্য প্রাণী। এদের মধ্যে এমন কিছু প্রাণী আছে, যাদের রয়েছে বেশ কিছু বিশেষত্ব, যা কিনা তাদের করে তোলে আরও ভয়ঙ্কর সুন্দর। তেমনই কিছু প্রাণীর কথা জানাবো আজ।


জাগুয়ারঃ
অনেকটা চিতা এবং লেপার্ডের মতো দেখতে জাগুয়ারকে বলা হয় আমাজন বনের রাজা। দৈর্ঘ্যে ২৫ থেকে ৩০ ইঞ্চি উঁচু এবং ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা বিশালাকার এই প্রাণীটির ওজন প্রায় ৫০ থেকে ১০০ কেজি হতে পারে। চিতাবাঘের জ্ঞাতি ভাই জাগুয়ার নিশাচর প্রাণী। রাতের অন্ধকারে অকস্মাৎ পেছন দিক থেকে সরাসরি শিকারের মাথায় আক্রমণ করে জাগুয়ার।

এমনিতে পুরো আমাজনেই দেখা পাওয়া যায় এদের। তবে আমাজনের ঝরনার পার্শ্ববর্তী ‘পাম্পাস তৃণভূমি’তে সবচেয়ে বেশি জাগুয়ার বসবাস করে। সাধারণ জাগুয়ার ছাড়াও আমাজনে দেখা পাওয়া যায় বিশেষ ধরনের কালো জাগুয়ারের। ত্বকে যদি ‘মেলানিননের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি থাকে, তবে সাধারণ জাগুয়ারই হয়ে ওঠে কালো। প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকার জন্য অনেক সময় জাগুয়ারদের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে সাধারণ জাগুয়ারদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য শুধুমাত্র রংয়েই।


অ্যানাকোন্ডাঃ
এই প্রাণীটির নাম শুনলেই অনেকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলিউডি সিনেমার সেই ভয়ঙ্কর ‘অ্যানাকোন্ডা’ সিনেমাটি। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে ওরা। পৃথিবীর বৃহত্তম সাপ হল অ্যানাকোন্ডা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হল গ্রিন অ্যানাকোন্ডা। ভারি সাপ হিসেবেও গ্রিন অ্যানাকোন্ডাই বেশি পরিচিত। প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি ওজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডা লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শীতল রক্তবিশিষ্ট এই প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। যদিও এটি মোটেও বিষধর নয়; তবে শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে হত্যা করার জন্য বিশেষ কুখ্যাতি আছে অ্যানাকোন্ডার।


ব্ল্যাক কেইম্যান কুমিরঃ
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির হল ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির, যার দেখা পাওয়া যায় আমাজন নদীতে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা ব্ল্যাক কেইম্যানের ওজন হতে পারে প্রায় ৪০০ কেজি। কেইম্যান জাতের অন্যান্য কুমিরেরা যেখানে দিনে শিকারে ব্যস্ত থাকে, সেখানে ব্ল্যাক কেইম্যান বের হয় রাতে। বিজ্ঞানিরা বলেন, এমনিতে সাইজে সবচেয়ে বড় হলেও বুদ্ধির দিক থেকে কিন্তু আমেরিকান অ্যালিগেটরের তুলনায় অনেকটাই বোকা ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির।


টাইটান বিটলঃ
‘বিটল’ শব্দটির অর্থ হল গুবরেপোকা এবং ‘টাইটান বিটল’ হল ‘দৈত্যাকার গুবরেপোকা’। আমাজনের অন্যতম বাসিন্দা টাইটান বিটল হল কীটপতঙ্গের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা পতঙ্গ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ছয় ইঞ্চি। বলা হয় টাইটান বিটলের চোয়ালের নিচের অংশ এতটাই শক্ত যে এটি চাইলেই কোনো পেন্সিলকে দুভাগ করে ফেলতে পারে; কিংবা সহজেই মানুষের শরীরে ঢুকে যেতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই, কারণ বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা এই পোকাটি সবচেয়ে নিরীহ প্রাণীও বটে। আমাজনের অধিবাসী উপজাতি শিশুরা টাইটান বিটলকে একটি মজার খেলনা হিসেবেই ব্যবহার করে। আরও একটি মজার ব্যাপার হল, নিজের জীবদ্দশায় কখনও কোনো খাবার খায় না টাইটান বিটল।


দৈত্যাকার সেন্টিপিডঃ
‘ক্যাটারপিলার’ অর্থাৎ শুঁয়োপোকা জাতের প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল আমাজনের জায়ান্ট সেন্টিপিড। লম্বায় প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এরা। বলা হয় আমাজনের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত প্রাণীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জায়ান্ট সেন্টিপিড, যার বিষক্রিয়ায় মুহূর্তের মধ্যে শিকারের সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে। শুঁয়োপোকাবংশের হলেও এরা মাংসাশী প্রাণী এবং নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বড় প্রাণীদের শিকার করতেও সক্ষম জায়ান্ট সেন্টিপিড।


দৈত্যাকার ককরোচঃ
অনেকটা চড়ুইপাখি সাইজের জায়ান্ট ককরোচ হল পৃথিবীর দীর্ঘতম তেলাপোকা। তেলাপোকা শুনলে অনেকেই নাক সিটকাবে। তবে সত্যি কথা হল হাল্কা ধরনের সোনালি রংয়ের এই প্রাণীটি কিন্তু দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই ভদ্র স্বভাবের। তার তাই আমেরিকাতে অনেকেই ‘এক্সোটিক পেট’ হিসেবে এদের নিজের বাড়িতে রাখে। দক্ষিণ আমেরিকান জায়ান্ট ককরোচ লম্বায় প্রায় এক হাতের সমান অর্থাৎ সাড়ে তিন ইঞ্চির মতো হয়ে থাকে।


গোলাপি ডলফিনঃ
আমাজন নদীর গোলাপি রংয়ের ডলফিন হল মিঠাপানির সবচেয়ে বড় সাইজের ডলফিন। প্রায় সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয় ফুট লম্বা এই গোলাপি ডলফিনকে নিয়ে বহু গল্পকথাও প্রচলিত আছে আমাজন এলাকায়। গোলাপি ডলফিনের ওজন হয় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সমান। আর এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বেশি! হালকা গোলাপি রংয়ের এই ডলফিনগুলোকে আমাজন নদী ছাড়াও পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় দেখা যায়।

আমাজনের গোলাপি ডলফিন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে "আমাজনের গোলাপি ডলফিন" লেখাটি পড়তে পারেন।


বৈদ্যুতিক ঈলঃ
নিজের শরীরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে এমন অনেক মাছের নামই শোনা যায়। এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আমাজনের ইলেকট্রিক ঈল। লম্বায় প্রায় ৬ ফুট এবং ২০ কেজি ওজনের ইলেকট্রিক ঈল প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে, যা মুহূর্তের মধ্যে তার শিকারকে ‘কাবাব’ বানিয়ে ফেলতে সক্ষম। বলা হয় আমাজনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারিদের মধ্যে একটি ইলেকট্রিক ঈল।

কি বৈদ্যুতিক ঈলের কথা শুনেই ভয় পেলেন? শুধু কি বৈদ্যুতিক ঈল আরো অনেক মাছ আছে যা আরো অনেক বেশি ভয়ংকর, সেই সব মাছের সম্পর্কে জানতে "ভয়ংকর যত মাছ" পড়তে পারেন।


পিরানহাঃ
আমাজনের আরেক ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণী হল পিরানহা মাছ। সাইজে ছোটখাটো হলেও মাংসাশী পিরানহারা তাদের হিংস্র স্বভাবের জন্য বরাবরই পরিচিত। একঝাঁক পিরানহা যখন একসঙ্গে নদীতে সাঁতরে চলে, তখন তাদের ধারালো দাঁত যে কোনো সাইজের প্রাণীদের মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। মাত্র ১৮ ইঞ্চি লম্বা পিরানহাদের প্রায় ৬০ রকমের প্রজাতি শুধুমাত্র আমাজন নদীতেই দেখা যায়। এছাড়াও কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাপ্তাই লেকেও পিরানহা মাছের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। পিরানহা মাছের চোয়াল এবং দাঁত এতটাই শক্ত এবং ধারালো যে আমাজনের আদিবাসীরা এদের দাঁত দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে।তবে বলা হয়, শুধুমাত্র দুটি পিরানহা একসঙ্গে থাকলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজের সঙ্গীকেও খেয়ে ফেলতে পারে এরা!


লিফ ফিশঃ
লিফ ফিশ, বাংলায় বলা যায় ‘পাতামাছ’, দেখতে আসলেই শুকনো পাতার মতো। আমাজনের নদীতে এরা এমনভাবে শুকনো পাতার ভেতর লুকিয়ে থাকে যে এদের খোঁজ মেলা ভার। পাতা মাছের এভাবে লুকিয়ে থাকাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ক্যামোফ্লেজ’। মাত্র চার ইঞ্চি লম্বা পাতামাছ তার চেয়ে দ্বিগুণ বড় মাছকেও সহজেই গিলে ফেলতে পারে। কারণ এদের মুখের হা বেশ চওড়া। লুকিয়ে থাকার জন্য পাতামাছ মাঝে মাঝে শরীরের রংও পাল্টাতে পারে।

মহাবন আমাজনের এই চমৎকার প্রাণীদের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও রয়েছে বেশ কিছু অদ্ভুত প্রাণী, রূপ, গুণ এবং বৈশিষ্ট্য, সব মিলিয়ে যারা অন্যরকম সুন্দর। এদের জন্যই বেঁচে আছে আমাজন, আর আমাজনের জন্যই টিকে আছে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী। আর এই আমাজান বন নিয়ে আরো কিছু তথ্য জানতে "অজানা আমাজন অরন্য" লেখাটি পড়তে পারেন।

লেখকঃ জেনিফার ডি প্যারিস।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info