আমাদের বর্তমান আধুনিক বিশ্ব আজ যে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে তার মূল উৎস যে বর্তমান তথা অতীতে সকল আবিস্কারক এবং তাদের সকল আবিস্কারের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে তাতে নিশ্চই কারো দ্বিমত থাকার কথা না। কিন্তু সব আবিস্কার কি আমাদের কাজে লেগেছে? না তা কিন্তু লাগেনি, এমন এমন আজব কিছু আবিস্কার আছে যা সময়ের স্রোতে হাড়িয়ে গেছে সময়ের অতল গভিরে, আবার এমন এমন আবিস্কার আছে যা আমাদের বিশ্বকে সম্পুর্ন ভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সে যাই হোক আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিব অতীতের আজব এবং অবাক করা কিছু আবিস্কারের সাথে। চলুন তাহলে শুরু করা যাক,
ঘোড়ার বিষ বাষ্প প্রতিরোধী মুখোশঃ
কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে অতীত থেকে বর্তমান সময়ের সভ্যতা কার পিঠে চড়ে এসেছে? তাহলে এক বাক্যে যে উত্তর আসবে তা হল ঘোড়া। গাড়ি আবিস্কারের পূর্বে এই ঘোড়া ছিল মানুষের সব থেকে প্রয়োজনিয় প্রানী। আর এই ঘোড়ার কোন ক্ষতি হবে আর তা কি কেউ সহ্য করতে পারে বলুন? না মোটেও পারে না, আর তাই ১৯৪০ সালে তৈরি করা হয় ঘোড়ার জন্য মুখোশ। যা ঘোড়াকে যেকোন প্রকার বিষাক্ত গ্যাস থেকে রক্ষা করবে। যদিও পরবর্তিতে এই মুখোশের কোন প্রয়োজন পরেনি। কেননা, যতদিনে যান্ত্রিক বাহন ঘোড়ার জায়গা দখল করে নেয়। এই ঘোড়ার মুখোশ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করে, ইংল্যান্ডের নন্ডন শহরের "Our Dumb Friends League" নামে একটি প্রতিষ্ঠান। নাম যেমন অদ্ভুত তাদের আবিস্কারও তেমন অদ্ভুত।
টাক মাথার চিড়ুনিঃ
আসলে এই চিড়ুনি আবিস্কার কে করেছিল তা জানা সম্ভব হয় নি, কিন্তু এই চিড়ুনি যে আবিস্কার করেছিল তার মাথায় যে বিশাল বড় একটা টাক ছিল তা কিন্তু একটু হলেও আন্দাজ করা যায়। যা হোক, এই চিড়ুনির উপরের অংশে একটা ফোমের মত লাগানো থাকে আর তার নিচে থাকে ব্রাশ। যার ফলে যাদের মাথায় টাক আছে, তারা টাক মালিশ আর আশে পাশের বেঁচে যাওয়া চুল গুলিকে অনায়াসে আচড়াতে পারবেন।
ভেন্ডিং মেশিনঃ
ভেন্ডিং মেশিন (Vending Machine) এর সাথে যারা পরিচিত না তাদের জন্য বলছি, এটি এমন একটি মেশিন যার মধ্যে নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী থাকে, যার একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারন করা থাকে, আপনি যদি সেই নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ মেশিনের মধ্যে দেন, তাহলে আপনি আপনার নির্বাচিত খাদ্যটি মেশিনের মধ্যে থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। এখন কথা হচ্ছে এই ভেন্ডিং মেশিন কবে আবিস্কার করা হয়? ১৯শে জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে সর্ব প্রথম এই ভেন্ডিং মেশিন সকলের সামনে আনা হয় আর তখন থেকে আজ অব্দি এই মেশিন উন্নত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়। প্রথম যে মেশিনটির সাথে সকলের পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটিতে একটি ডাইমের বিপরিতে সল্প সময়ের জন্য পানির স্প্রে নেওয়া যেত।
ফোর্ড জাইরনঃ
দু'চাক্কা বিশিষ গাড়ি ফোর্ড জাইরন (Ford Gyron)। দু'চাক্কা বিশিষ্ট এই গাড়িটির প্রথম ধারনা দেয় ফোর্ড কম্পানি ১৯৬১ সালে। সব থেকে মজার কথা হচ্ছে এই গাড়িটি ১লা এপ্রিলে সবাইকে এপ্রিল ফুল বানাবার লক্ষ্যে ফোর্ড কম্পানি এই গাড়ির কনসেপ্ট সবার সামনে তুলে ধরে, এবং তখন পর্যন্ত তাদের ধারনা ছিল এরকম গাড়ি কোন দিন রাস্তায় গড়াবে না। কিন্তু কালের বিবর্তনে বর্তমানে দু'চাক্কার গাড়ি বানাবার জন্য অনেক নামি-দামি কম্পানি চেষ্টা করে চলেছে।
কথায় চালিত যন্ত্রমানবঃ
আপনি যদি মনে করে থাকেন যন্ত্রমানব বা রোবট আবিস্কার হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে তাহলে আপনার ধারনা যে সম্পূর্ন ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৬১ সালে Marvin Glass তার ডিজাইন করা এবং তৈরি করা সিগাগো শহরে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি এই রোবটের নাম দেন "Robot Commando Soldier"। এই রোবটটি রকেট ছুড়তে সক্ষম এবং এই রোবট চালাতে কোন রিমট কন্ট্রোল নয় বরং শুধু মাত্র মুখের আওয়াজই যথেষ্ট। কি এখন বুঝলেনতো Voice Command কত দিন আগে আবিস্কার হয়েছিল।
ঝুলন্ত টিভি ষ্ট্যান্ডঃ
বর্তমান সময়ে ফ্লাট টিভি গুলি কিন্তু দেওয়ালের সংগে আমরা ঝুলিয়ে রাখি। কিন্তু আগের দিনের টিভি গুলি কিন্তু এরকম পাতলা ছিল না বরং একটু মোটাই ছিল। কিন্তু টিভিকে ঝোলাবার ধারনা কিন্তু অনেক পুরাতন। ১৯৬৩ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সিসাগো শহরে সবার প্রথম ঝুলন্ত টিভি ট্যান্ডের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যাতে অনায়াসে ১৫ ইঞ্চি আকৃতির টিভি দেওয়ালের সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া সম্ভব।
ভিডিও ফোনঃ
ক'দিন আগেই বাংলাদেশে মোবাইল সেবাদানকারি কম্পানি গুলি চালু করল 3G সার্ভিস। এর মাধ্যমে অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে গেল ভিডিও ফোনের দুয়ার। অবশ্য এই 3G আশার পূর্বেই Skype, Viber, WeChat এর সাহায্যে আমরা কিন্তু এই ভিডিও ফোনের স্বাদ মিটিয়েছি। এখন প্রশ্ন হল কবে প্রথম এই ভিডিও ফোন চালু হয়েছিল। এর ইতিহাস আপনাকে অবাক করবে। ভিডিও ফোন সর্ব প্রথম চালু করে এমন একটি কম্পানি যারা কাজ করত বিবাহ নিয়ে, মানে বাংলায় বলতে গেলে ঘটকালির কাজ। পশ্চিম জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট (Frankfurt) শহরে অবস্থিত এই কম্পানিটি ১৯৫৭ সালে সর্ব প্রথম ভিডিও ফোনের চালু করে। যার মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত শাখায় ছেলে মেয়েরা যেয়ে তাদের জন্য ঠিক করা পাত্র অথবা পাত্রীর সাথে চেহারা দেখে কথা বলতে পারে। এর জন্য তাদের সামনে থাকত একটি টেলিভিশন, ক্যামেরা আর ফোন। আর ফোনে আলোচনা ভাল লাগলে দেখা আর তারপর বিয়া। সেই থেকে বির্তন হয়ে আজ এসেছে এই ভিডিও ফোন।
পরিবার নিয়ে গাড়ি চালানোর মজাঃ
এই গাড়িটি মূলত ডিজাইন করা হয় বাচ্চাদের জন্য। মা বাবার সাথে ঘুরতে যাবার সময় যাতে বাচ্চারা হাসি খুশি থাকে তার জন্য পিছনের সিটে গাড়ি চালাবার তিনটি হাতল এবং গাড়ির সামনের মত পিছনেও কাচ লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর এই গাড়ির ডিজাইনারের নাম Jack Fletcher। ১৯৫৫ সালের ৪ই জানুয়ারি তিনি সর্বপ্রথম এরকম ডিজাইনের গাড়ি নিয়ে পরিবার সহ ঘুরতে বের হন।
ভবিষ্যতের ঘাস কাঁটার যন্ত্রঃ
আগের দিনের মানুষেরা যে ভবিষ্যত নিয়ে অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করত তার আরেকটি উতকৃষ্ট উদাহরন হল এই ঘাস কাঁটার যন্ত্র। ১৯৫৭ সালে সকলের সামনে উপস্থাপন করা হয় ভবিষ্যতের ঘাস কাঁটার যন্ত্র "The Power Mower of the Future"। তৎকালীন সময়েই এই যন্ত্রে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হয়ছিল যা তখনকার সময়ে অনেকেই শুধু মাত্র কল্পনা করত। এই ঘাস কাঁটার মেশিনে চালক বসে থাকত একটি স্বচ্ছ প্লাষ্টিকের চালক বক্সে, এই ঘাস কাঁটা যন্ত্রের ছিল নিজেস্ব জেনারেটর, টেলিফোন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র। এবার বুঝে দেখুন কেমন ছিল এই ঘাস কাঁটার যন্ত্র।
মটর সাইকেল প্লেনঃ
১৯৫৭ সালে Eric Kemp ডিজাই করেন মটরসাইকেল প্লেনের। Eric Kemp পেশায় ছিলেন একজন উরোজাহাজ ডিজাইনার আর তাই তিনি তৈরি করেন এই মটর সাইকেল। এটি দেখতে প্লেনের মত হলেও এটি কিন্তু আকাশে উড়তে ছিল সম্পূর্ন অক্ষম।
কৃত্রিম মস্তিষ্কঃ
বর্তমান সময়ে কৃত্রিম মস্তিস্ক (Artificial Brain) সম্পর্কে অনেকের ধারনা আছে বেশ বিস্তর। অবশ্য বলা যায় বর্তমানে কম্পিউটার হচ্ছে এই কৃত্রিম মস্তিস্কের ভবিষ্যত বা বর্তমান। সে যাই হোক এই কৃত্রিম মস্তিক প্রথম আবিস্কার করেন Dr. A.G. Macleod। ২৬শে জুন ১৯৬১ সালে তিনি একটি ঔষধ কম্পানির আর্থিক সহায়তায় মানুষের মস্তিস্কের অনুরূপ একটি মেশিন বানাবার চেষ্টা করেন বা একটি ধারনা দেন। আর সেখান থেকেই উৎপত্তি হয় এই কৃত্রিম মস্তিস্কের ধারনা। অবশ্য প্রথমে তিনি সম্পূর্ন মানুষের ব্রেনের অনুরূপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্যার্থ হয় তবে তখন যদি বর্তমান সময়ের মত কম্পিউটার থাকত তাহলে হয়ত তিনি তৈরি করে ফেলতেন সত্যিকার অর্থে কৃত্রিম মস্তিস্ক।
হাটাহাটি করার গাড়িঃ
আমেরিকার নিউয়ার্ক শহরে Lincoln Tunnel চালু হবার পরে দর্শনার্থি এবং গাড়ির চাপে জ্যাম লেগে থাকা ছিল একদম নিয়মিত ব্যাপার। আর এ থেকে মুক্তি পেতে কতৃপক্ষ চালু করেছিল "Lincoln Tunnel Catwalk Car"। ১৯৬০ সালে চালু হওয়া এই গাড়ি নিজের গতি শক্তিকে বিদ্যুতে পরিনত করে ২২০০ ফুট লম্বা লিংকন টানেল পারি দিতে সক্ষম ছিল। এটি তৎকালীন সময়ের সর্বাধুনিক গাড়ি ছিল বলা চলে।
চোখের পলক পরার যন্ত্রঃ
একটা অদ্ভুদ যন্ত্র। এটি মেয়েদের চোখের পলক পরার সংখ্যা ঠিক করার জন্য ব্যাবহৃত হত। কি অবাক হচ্ছেন? হবারই কথা। এমন আজব যন্ত্র কে আবিস্কার করেছিল কে জানে। তবে ১৯৪৯ সালের দিকে অনেক মেয়ে তাদের চোখের পলক পরার সংখ্যা ঠিক রাখায় জন্য এই যন্ত্রের সাহায্যে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রথমে এই যন্ত্রটি পরিয়ে আপনাকে একটি বই দেওয়া হবে পড়ার জন্য, এসময় আপনার চোখের পলক সংখ্যা গুনে হেলমেটের মধ্যে কোন এক গ্যাস যা কিনা এই পলক পরার সংখ্যা ঠিক করতে পারে তা দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হত। কালের বিবর্তনে যে এই যন্ত্র এখন আর নেই তা নিশ্চই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বচ্ছ ফোন বুথঃ
মোবাইলের আগে পথে ঘাটে ফোন দেবার জন্য ব্যাবস্থা করা হয়েছিল ফোন বুথের। কিন্তু অনেকেই এই ফোন বুথের মধ্যে ঢুকে জুড়ে দিতেন সারা দুনিয়ার আলাপ মিটাতে আর বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অনেকে। তাই পশ্চিম জার্মানিতে ১৯৫৯ সালে প্রথম চালু করা হয় এই স্বচ্ছ ফোন বুথের। উদ্দেশ্য একটাই, যে ভিতরে ফোনে গল্প করছেন তিনি যেন স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারেন যে বাইরে কত জন লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর চক্ষু লজ্জার জন্য হলেও যেন তাড়াতাড়ি কথা শেষ করেন। বেশ ভাল বুদ্ধি, কি বলেন?
উল্টানো গ্রামোফোনঃ
ক্যাসেট আসার আগে গান শোনার সব থেকে জনপ্রিয় ব্যাবস্থা ছিল এই গ্রামোফোন। আমাদের দাদা নানারা কিন্তু এই গ্রামোফোনেই গান শুনেছেন। কিন্তু, ১৯৬০ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর প্রথম বারের মত এই গ্রামোফোন উল্টা করে রেখে বাজাবার প্রক্রিয়া চালু করা হয়। অনেকেই বলবেন এটা আবার এমন কি হল? ঠিক, তেমন কিছু না হলেও ক্যাসেটের আমলে গান শোনার সব থেকে জনপ্রিয় মাধ্যম BoomBox তৈরির ধারনা আসে এই উল্টা লটকানো গ্রামোফোন থেকেই। কি এখন নিশ্চই এত ছোট মনে হচ্ছে না এই উল্টা লটকানো গ্রামোফোনকে?
লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন