সাইকোলজিরই একটা শাখা প্যারা সাইকোলজি মানুষের অদ্ভুত সব ক্ষমতা নিয়ে পর্যালোচনা করে। এই যেমন ধরুন অতৈন্দ্রিক ক্ষমতা বা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ, এক কথায় যে সব জিনিস ঠিক মানুষের স্বাভাবিক কর্মকান্ডের মধ্যে পড়ে না। জার্মান সাইকোলোজিস্ট ম্যাক্স দেসোর (১৮৬৭ - ১৯৪৭) সর্বপ্রথম সাইকোলজির এই শাখাটা সংজ্ঞায়িত করেন।
প্যারা সাইকোলজিতে যদিও অলৌকিক ঘটনা বা ক্ষমতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে, সেটা হয় পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে। প্যারা সাইকোলজিস্টরা কিছু বিষয় নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ করে থাকেন, যার মধ্যে পড়ে টেলিপ্যাথি (মানুষের মনের কথা বুঝতে পারা), প্রি রিকোগনিশান (অর্থাৎ আগে থেকেই কোন কিছু ধারণা করা এক কথায় ভবিষ্যত বলতে পারা), টেলিকিনসিস বা সাইকোকিনসিস (অর্থাৎ কোন ধরণের শারীরিক সম্পৃক্ততা ছাড়াই কোন জিনিস নাড়ানো), সাইকোমেট্রি (কোন বস্তু, প্রাণী বা জায়গাকে স্পর্শ করে সেটা সম্পর্কে সব জেনে যাওয়া), মৃত্যু স্পর্শ (মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা), বাইলোকেশান (অর্থাৎ একই সময় দুই জায়গাই অবস্থান করা)।
মজার মজার সব মশলাদার আইটেম তাই না? তাহলে দেরী কেন শুরু করে দেই কি বলেন?
টেলিপ্যাথিঃ আসলেই কি এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট, যারা সত্যিই অন্যের আত্মা দেখতে পারে? পড়তে পারে অন্যের মনের কথা অথবা নিজের চিন্তা ভাবনা ট্রান্সফার করতে পারে অন্যের মনে। তা সে যত দূরেই থাকুক না কেন? ফ্রেডরিক ডব্লিউ, এস, মেয়ার ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দে যা টেলিপ্যাথি বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন তার অস্তিত্ব কি আসলেই আছে?
অতন্দ্রীয় যোগাযোগ মাধ্যমঃ খুব কাঠখোট্টা বিজ্ঞানীও টেলিপ্যাথিকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন না যেমনটি হয়ে থাকে প্যারাসাইকোলজির অন্য গুলোর ক্ষেত্রে। কারণটা হয়তো আমরা সবাই জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে এর প্রমাণ পেয়ে থাকি। যেমন ধরুন আপনি কোন এক বন্ধুর কথা গভীরভাবে চিন্তা করছেন ঠিক সেই মুহুর্তে আপনার বন্ধুটি আপনার বাসার কলিংবেল চাপছেন অথবা আপনাকে কল করেছেন। এসব বিষয়কে আমরা খুব সহজেই কাকতালীয় ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে যাই। অথচ আমরা এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকিনা যে এটা আমাদের মস্তিষ্কের এক অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা যেখানে আমাদের অবাধ প্রবেশাধিকার নেই।
টেলিপ্যাথির ইতিবৃত্তঃ শীতল যুদ্ধ শুরু হবার বহু আগে এমন কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও পূর্বে অন্যদের মনো জগতে ভ্রমন করতে পারে এমন লোকদের নিয়ে কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিল তিন মহারথী (দ্যা গ্রেট সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং ব্রিটেন) এবং তার ফলাফলও ছিল চমকপ্রদ। সে সময় টেলিপ্যাথি মিলেটারি ইন্টিলিজেন্সে একটি বিশেষ আসন করে নিয়েছিল এবং এর ধারকদের বলা হত 'সাই এজেন্ট (Psi Agent)'। বর্তমানে টেলিপ্যাথিকে বিজ্ঞানীরা রিমোট সেন্সিং বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সে যায় হোক, এই এজেন্টরা তাদের মনটাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এবং বস্তু সম্পর্কে তথ্য দিতেন।
সময়টা ১৯৪০ সাল, এরকমই এক ক্ষমতাধর টেলিপ্যাথ উলফ ম্যাসিং (উলফ ম্যাসিং এর মজার কিছু ঘটনা) জোসেফ স্ট্যালিনের সুনজরে পড়লেন।
উলফ ম্যাসিং এর ঘটনাটাকেই মূলত টেলিপ্যাথির প্রতি সরকারী আকর্ষণের সূত্রপাত ধরা হয়।পশ্চিমা বিশ্বও টেলিপ্যাথি নিয়ে নাড়াচাড়াই পিছিয়ে ছিল না। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে এস, জি, সোয়াল (১৮৮৯-১৯৭৯) নামের ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের এক গণিতের প্রফেসর ১ লক্ষ মানুষের মধ্য থেকে ১৬০ জনকে নিয়ে টেলিপ্যাথি টেস্ট করেন। একইভাবে প্যারাসাইকোলজিস্ট বাসিল সাকলেটন এবং রিটা এলিয়ট কিছু ফলাফল পেতে সক্ষম হন যেটাকে কোনভাবেই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
কেন একজন অন্যের মনোজগতে অবাধ বিচরণ করতে পারছে, অন্যের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন পারছে সেটা আজও অজানা। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন যে, প্রত্যেকটি মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এই ক্ষমতাটা আছে আর এই ক্ষমতাটাকে কাজে লাগাবার জন্য দরকার সুতীক্ষ্ণ মনোসংযোগ।
টেলিপ্যাথি পরীক্ষার একটা খুবই সহজ প্যাটার্ন আছে। এই ক্ষেত্রে সাবজেক্ট এবং পরীক্ষক মুখোমুখি বসেন আর পরীক্ষকের সামনে থাকে একটা মনিটর যেখানে রেনডমলি ছবি অথবা সিম্বল জেনারেট হতে থাকে। পরীক্ষকের সামনে যে ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে টেলিপ্যাথকে (সাবজেক্ট) সেটা বলতে বা এঁকে দেখাতে হয়। টেলিপ্যাথিক সাবজেক্ট আসলে পরীক্ষকের মস্তিষ্কে যে ইমেজটা পড়ছে সেটা পড়তে পারে এবং তার উপর ভিত্তি করেই ছবি আঁকে। বছরের পর বছর এই পদ্ধতীতে খুবই আশ্চর্যজনক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।
মরফোজেনেটিক ফিল্ডঃ ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ডরেক এই মরফোজেনাটিক ফিল্ডের সূত্র আবিষ্কার করেন। এই সূত্রানুযায়ী প্রকৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে, যা পরবর্তী প্রয়োজনানুসারে অন্যদের কাছে পৌঁছে যায়। তাঁর বিখ্যাত উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ব্রিটিশ বংশীয় চিকাডি (Parus caeruleus) নামক পাখির দুধ চুরি কৌশল। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী কিছু পাখি যখন দুধের বোতলের এ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনি খুলে দুধ চুরি করা শিখেছিল সেই কৌশলটি বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ঐ প্রজাতির পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, খুবই দ্রুত ইউরোপ মহাদেশীয় অন্যান্য পাখিরাও একই কৌশলে দুধ চুরি করা শুরু করে দেয়। এটা সম্ভব হয়েছিল মরফোজেনেটিক ফিল্ডের বদৌলতে। কারণ টেলিপ্যাথি বাঁধনহীন, এটা মানুষ এবং পশু উভয়ের সাথেই সমানভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ডরেক |
শেল্ডরেক এই ব্যাপারটি প্রমাণ করার জন্য বেছে নিয়েছিল একটা পোষা তোতা পাখি এবং ওটার মালিককে। তোতা পাখিটির ভান্ডারে ছিল ৫০০ শব্দ এবং এই শব্দ গুলোর সমন্বয়ে পাখিটি যে কোন বাক্য বলতে পারত। এই পাখিটাকে একটা মনিটরের সামনে রাখা হলো যেখানে তার মালিক এ্যামিকে দেখা যাচ্ছিল। পাখিটির মালিক ছিল একই বিল্ডিং এর আরেক ফ্লোরে (পাখিটির থেকে দুই ফ্লোর নীচে)। এ্যামির সামনে ছিল কিছু খাম যার মধ্যে ছিল কিছু ছবি এবং সিম্বল। এ্যামি খামখুলে ছবিগুলো দেখা শুরু করল, আশ্চর্যজনকভাবে তোতা পাখিটি তার মালিকের ভিডিও ইমেজ দেখে ইংরেজীতে সেই ছবি গুলোর বর্ণনা দিতে শুরু করল, যেন সে তার মালিকের মনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছে। পশু মানুষের মধ্যে এমন নিরিবিচ্ছিন্ন এবং চমকপ্রদ টেলিপ্যাথিক দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত আর দেখা যায়নি।
এ্যামি এবং তার তোতা |
এটা ছাড়াও বিবিসি মানুষ এবং পশুর উপর পরীক্ষার কিছু নমুনা নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছে। এরকমই একটা ডকুমেন্টারিতে কিছু কুকুরকে দেখানো হয়েছে যেখানে কুকুরগুলোর মালিকেরা ঐগুলোকে বাসায় রেখে বাইরে চলে যান (কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে না)। একটা নির্দিষ্ট সময় পর মালিকেরা বাসায় তাদের কুকুরের কাছে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ডকুমেন্টারি টিম রেকর্ড করেছে যে, ঠিক যে মুহুর্তে মালিকেরা বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনই কুকুর গুলো উঠে দরজার কাছে চলে গেছে এবং মালিকের জন্য অপেক্ষা করছে। অগণিতবার এই পরীক্ষাটা চালানো হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তে উপণিত হয়েছে যে এটা কোন কো ইনসিডেন্স না। কারণ ফলাফল প্রতিবারই একই।
টেলিপ্যাথি ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটা এখনো ধোঁয়াশা। সে যায় হোক, হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই পরীক্ষার মাধ্যমেই এর কার্যকারণ নির্ধারণ করা যাবে। কিন্তু তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কেন এই ক্ষমতাটা বিদ্যমান, আর যদিওবা বিদ্যমান কেনই বা গুটি কয়েকজনই এর প্রয়োগ করতে পারে?! অন্যদের কমতিটা কোথায়?!
লেখকঃ সব্যসাচী প্রসূন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।