রেইন ফরেস্টের জীবজন্তু ।। Rain Forest Animals


চিরহরিৎ বন বলা যায় রেইন ফরেস্টকে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনে কখনও শীত আসে না। দানবাকৃতির বিশাল গাছ ঠাণ্ডায় কাবু হয় না, শুকিয়ে যায় না আঙ্গুর লতার ঝাড় কিংবা বিবর্ণ হয় না নাম না জানা অপূর্ব সব ফুল। এই বনে সারা বছর পাখি ডাকে গাছের শাখে, মগডালে মনের সুখে দোল খায় বানর, উজ্জ্বল সূর্যালোকে বিচিত্র রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতির দল।

রেইন ফরেস্ট যেনো টারজান ছবির কল্পনার ভুবনের বাস্তব চিত্র। বুনো জঙ্গলে, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর হরেক রকম বুনো প্রাণীর মিলনকেন্দ্র এই রেইন ফরেস্ট। বিশাল সাপ, বিচিত্র ব্যাঙ থেকে শুরু করে রেইন ফরেস্টে দেখা মেলে জানা অজানা লক্ষ লক্ষ কীট পতঙ্গের। রেইন ফরেস্টের নিবিড় অরণ্যে যে হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণী রয়েছে তার অধিকাংশের নামই মানুষ জানে না। রহস্যময় এ রেইন ফরেস্টগুলো ধারণ করে আছে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং বর্ণাঢ্য বন্য জীবনকে। পৃথিবীর মাত্র পাঁচ ভাগ এলাকা জুড়ে রেইন ফরেস্টের বিস্তৃতি হলেও সারা দুনিয়ার অর্ধেক প্রজাতির প্রাণী আর উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যায় এখানে। প্রবল শীতের সময় রেইন ফরেস্টে আগমন ঘটে লাখ লাখ বিদেশী পাখির।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info

আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে রেইন ফরেস্টের বিস্তৃতি। তবে সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকায়। আমাজন নদীকে ঘিরে রচিত হয়েছে এই রেইন ফরেস্ট। চার হাজার মাইল বিস্তৃত আমাজনের জঙ্গলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ প্রাণী ও উদ্ভিদের বাস। হাজার হাজার বছর ধরে রেইন ফরেস্টে বাস করে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এরা শিকার করে, মাছ ধরে আর বনের ফলমূল খায়। এই মানুষগুলো এখন প্রকৃতিরই একটা অংশ হয়ে গেছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সারা বিশ্ব জুড়ে রেইন ফরেস্ট বর্তমানে ক্রমশ ধ্বংসের সম্মুখীন। বহিরাগতরা বন জঙ্গল কেটে সব সাফ করে দিচ্ছে। খামার বাড়ি করছে, লেক খুঁড়ছে, খনি খুঁড়ছে, তেলের খনি খুঁজছে, তৈরী করছে নতুন রাস্তাঘাট আর এজন্য প্রতি মিনিটে মানুষ আশি হাজার একর রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করে চলেছে। চিন্তা করা যায়! এভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকলে আগামী একশ’ বছরে রেইন ফরেস্ট তার বুনো জীবন এবং প্রকৃতি নিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে।

চলেন তবে আমরা এখন রেইন ফরেস্টের কিছু প্রাণীর কথা শুনি যাদের জীবন মানুষের সীমাহীন লোভের কারণে আজ বিপদাপন্ন।


শিম্পাঞ্জীঃ
বহুল পরিচিত বুদ্ধিমান এই প্রাণীটির বাস মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে। পুরুষ শিম্পাঞ্জীগুলোর ওজন হয় মোটামুটি ১৭৫ পাউণ্ড। লম্বায় এরা পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। শিম্পাঞ্জীরা বেশিরভাগ সময় মাটিতে কাটালেও বাদাম, জাম ইত্যাদি বিভিন্ন ফলমূল সংগ্রহের জন্য গাছে উঠতে আপত্তি নেই মোটেও। আর গাছের ডালে ঝুলে দিব্যি আরামে ঘুমাতেও অসুবিধা হয়না কোনো। এগুলো এতো চালাক যে লাঠি আর পাথর দিয়ে উইপোকার ঢিবি ভেঙে চাকুম চুকুম করে সুস্বাদু কীটগুলোকে চিবিয়ে খায়।


রাফড লেমুরঃ
মাদাগাস্কার ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া জঙ্গলে লেমুরদের ঘরবাড়ি। বানরের ঠাকুর্দা বলা হয় লেমুরদের। ১৬ প্রজাতির লেমুরের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো রাফড লেমুর। তিন ফুটের চেয়েও লম্বা হয় কোনো কোনোটা। লম্বা, লোমশ লেজ দিয়ে এরা ভারসাম্য রক্ষা করে খুব সহজেই, আর গাছের ফাঁকেও চলে বেড়ায় স্বচ্ছন্দে।


পাতা খেকো পিঁপড়েঃ
মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এক ধরণের পিঁপড়ে দেখা যায়। এদের কাজই হচ্ছে সারাক্ষণ কাটুস কুটুস করে সবুজ পাতা কাটা। কাটা পাতাগুলো তারা মাটির নিচের বাসায় নিয়ে যায়। তারপর চিবিয়ে লালার মতো করে তাতে বিশেষ ধরণের ফাংগাস জন্মায়। এই ফাংগাস বা ছত্রাকই হচ্ছে এদের খাদ্য।


এমারেল্ড গ্রীণ ট্রি বোয়াঃ
রেইন ফরেস্টে সাপ আছে প্রচুর। এগুলোর মধ্যে একটি হলো এমারেল্ড গ্রীণ ট্রি বোয়া। সবুজ রঙের সাপগুলো লতা-পাতার মধ্যে এমনভাবে মিশে থাকে যে আলাদাভাবে এগুলোকে শনাক্ত করা খুব মুশকিল। ছয়ফুট লম্বা অজগরগুলো চুপচাপ ঝুলতে থাকে গাছের ডালে। আসলে অপেক্ষা করে শিকারের জন্য। কাছাকাছি কোনো পাখি এসে বসলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটার ওপর, শরীরে বসিয়ে দেয় দাঁত। তারপর মরণ বাঁধনে বেঁধে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। সবশেষে শুরু হয় খাওয়াদাওয়ার পর্ব।


মরফো বাটারফ্লাইঃ
রেইন ফরেস্টে প্রজাপতির অভাব নেই কোনও। বিচিত্র রঙের প্রজাপতির ছড়াছড়ি বনভূমিগুলোতে। তবে এগুলোর মধ্যে রঙ ও রূপের ছটায় সবচেয়ে বিখ্যাত হলো মরফো বাটারফ্লাই। শুধু দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলেই এগুলো দেখা মেলে। বলা হয় মরফো বাটারফ্লাইদের মতো অপরূপ নীল রঙের পাখা পৃথিবীর আর কোনো প্রজাপতির নেই।


গ্রেট হর্ণবিলঃ
অদ্ভুত একটা পাখি গ্রেট হর্ণবিল। আকারে যেমন বড়, ঠোঁটজোড়াও তেমনি বিশাল। মালয়েশিয়ার রেইন ফরেস্টে এদের আবাসস্থল। ওড়ার সময় মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে। যেন ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর। আর ডানার ভেতর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায়, মনে হয় যেন ট্রেনের হুইসল বাজছে। গ্রেট হর্ণবিলরা গাছে গর্ত করে বাস করে। মেয়ে হর্ণবিলরা মাটির দূর্গ গড়ে তোলে নিজের চারপাশে। ফলে বানর, সাপ কিংবা অন্যান্য প্রাণীরা ডিম চুরি করতে পারে না, বাচ্চাগুলোও নিরাপদে থাকে। মাটির দূর্গে ছোট একটা গর্ত করে পুরুষ হর্ণবিল। ফুটো দিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য খাবার সরবরাহ করে।


ফিলিপিনো ঈগলঃ
ফিলিপাইনের জাতীয় পাখিকে এক সময় ‘বানর খেকো ঈগল’ বলা হত। কারণ বানর ছিল তাদের প্রিয় খাদ্য। এই ঈগলরা বড় বড় পাখি ধরে খায়, সুযোগ পেলে শুয়োর এবং কুকুরও বাদ দেয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পাখিদের একটি হচ্ছে ফিলিপিনো ঈগল। জঙ্গলের সবচেয়ে বড় গাছটির মাথায় বাড়ি তৈরি করে ঈগলরা। তবে এসব ঈগল এখন ক্রমশ বিরল হয়ে উঠেছে মানুষের শিকার হতে হতে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি, বন জঙ্গল কেটে সাফ করার কারণেও এদের প্রায় বিলীন হবার জোগাড়।


তিন ঠেঙা স্লথঃ
ধীর গতিতে উল্টো হয়ে হেলে দুলে চলতে খুব পছন্দ করে তিন ঠেঙা স্লথরা। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেস্টের গাছের মগডালে এদের বাসস্থান। লম্বা, বাঁকানো নখ দিয়ে ডাল ধরে ঝুলে থাকে স্লথরা। এভাবেই পাতা আর ফুল খেয়ে পেট ভরায়। উল্টো হয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাতেও স্লথদের জুড়ি মেলা ভার। গাছের সঙ্গে এদের আত্মার সম্পর্ক। মাটিতে থাকতে পারে না বলে গাছ মরে গেলে স্লথও মরে যায়।


এশিয়ান হাতিঃ
বিশালদেহী এশিয়ান হাতিগুলোকে মানুষ ধরে ধরে এখন তাদের ‘দাস’ বানাচ্ছে। আফ্রিকান হাতির চেয়ে আকৃতিতে একটু ছোট হলেও এশিয়ান হাতিরা উচ্চতায় দশ ফুটের কম নয়, আর ওজন কমপক্ষে এগারো হাজার পাউণ্ড। শুধু উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে। আর তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় চারশো পাউন্ডের মতো খাবার প্রয়োজন হয়। দ্রুত বনভূমি বিলুপ্ত হবার কারণে এশিয়ান হাতিরাও নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করেছে।

ধরা যাক, কোনো ধূমকেতু নিজের পথ ভুলে অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে, এসেই আছড়ে পড়বে একেবারে। আর সাথে সাথেই ঘটে যাবে পারমাণবিক বোমার মতো ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণ। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এমন করেই বিভিন্ন ধূমকেতু, গ্রহাণুপুঞ্জ ইত্যাদির আঘাতে পৃথিবীতে কি বড়োসড়ো প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে যায়নি? আর তখন কি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি পৃথিবীর প্রাণীদের বেশিরভাগ প্রজাতিগুলো, এমনকি ডাইনোসরেরাও? আজকের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এদিকে আশঙ্কা করছেন যে খুব শীঘ্রি পৃথিবীর প্রাণীদের বেশিরভাগ প্রজাতিও দুঃখজনক ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এতই দ্রুত হারে বিলোপ ঘটছে প্রাণীদের!

লেখকঃ অনীশ দাস অপু।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।