কীভাবে কাটে ওদের শীতকাল ।। How They Spend Their Winter

হুড়মুড় ধুপধাপ- ওকি শুনি ভাই রে!
দেখছ না হিম পড়ে - যেয়োনাকো বাইরে।

সুকুমার রায়ের একটি ছড়ার দু'লাইন দিয়ে শুরু করলাম।


শীত এলে অনেকেই খুশি হয়। গরম পোশাক পরে পিঠা, মিঠা, সব্জি খিচুরির আয়োজন করে অনেকে। যাদের এসব আয়োজনের সামর্থ নেই তারা জবুথবু হয়ে খড়বিচালি জ্বালিয়ে আগুনের ওম নিয়ে, ছেড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে কোনরকমে কাটিয়ে দেয় শীতকালটা। কিন্তু যাদের এটুকুও করার অবস্থা নেই জগতের সেসব প্রাণীরা কীভাবে পার করে এই হিম ঋতু।

প্রতি বছর নিয়ম করে শীত আসে। শীত এলে কেউ কেউ খুব খুশি হয়। কারণ শীত এলেই নিত্য নতুন পিঠা আর খেজুর রসের মজা কে না জানে। আবার শীতের মিষ্টি রোদও কম মজাদার নয়!

শীত এলেই সবার মধ্যে নানারকম প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। অতিরিক্ত শীত থেকে বাঁচতে মানুষ লেপ কম্বল, সোয়েটার, জ্যাকেট বা অন্যান্য গরম পোষাক ব্যবহার শুরু করে। আবার ভেসলিন, লোশন ও নানারকম তেল হাতে পায়ে গায়ে মেখে মানুষ শীতের কামড় থেকে দেহকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। ফলে হাত পা বা ঠোঁটের চামড়া ফাটে না।

এতো গেল মানুষের শীত থেকে বাঁচার প্রস্তুতির কথা। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কোন রকম সোয়েটার জ্যাকেট বা লেপ কম্বল গায়ে না দিয়েও প্রাণীরা দিব্যি বেঁচে থাকে কীভাবে?

hybridknowledge.info hybridknowledge.info

শীত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণীদের রয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত নিজস্ব কিছু পদ্ধতি। আর এসব পদ্ধতির কারণেই তারা এমনকি বরফের দেশে তীব্র শীতেও বেঁচে থাকে। একেক প্রাণী শীত থেকে বাঁচতে একেক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। তাদের এইসব পদ্ধতিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলোঃ পরিযান বা মাইগ্রেশন, শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন এবং অভিযোজন বা অ্যাডপটেশন। এ সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।


নিজের দেশ ছেড়ে দুরদেশে যাওয়ার নাম মাইগ্রেশন বা পরিযানঃ
আপনারা হয়তো খেয়াল করে দেখেছেন, প্রতি বছর শীতকালে অনেক নাম না জানা পাখিতে ভরে যায় আমাদের আশপাশের খাল বিল ও জলাশয়গুলো। সুদুর উত্তরমেরু, সাইবেরিয়া থেকে এসব যাযাবর পাখি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। এদের বলে মাইগ্রেটরি বার্ডস বা পরিযায়ী পাখি। এসব পাখিদের মধ্যে বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, কাদাখোচা, গডউইত উল্লেখযোগ্য।

শীতপ্রধান অঞ্চলের হলেও শীতকালের প্রচন্ড শীত এসব পাখি সহ্য করতে পারে না। আবার তাদের এলাকায় এসময় খাদ্যাভাবও দেখা যায়। তাই এসব পাখি দলবল নিয়ে অন্য দেশে চলে আসে, যেখানে ঠান্ডা একটু কম। আমাদের দেশের মানুষগুলো বেশী অতিথিপরায়ন বলে এসব পাখিকে আদর করে অতিথি পাখি নাম দেয়া হয়েছে। এসব অতিথি পাখি বসন্ত এলে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়।


তবে কিছু নিষ্ঠুর লোক এসব পাখিকে শিকার করছে। এদের আবার ‘সৌখিন শিকারী’ বলে গালভরা নামে ডাকা হয়। তবে শুধু সৌখিন শিকারীরাই নয় অনেক পেশাদার শিকারীরা অতিথি পাখিদের যত্রতত্র শিকার করে টাকার লোভে।

অতিথি পাখিদের সঙ্গে এই অমানবিক আচরণের কিছু কুফলও আছে। সংক্ষেপে বললে, নির্বিচারে অতিথি পাখি মারার কারণে আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নানাভাবে নষ্ট হয়। যেমন ধরেন, অতিথি পাখি খাদ্য হিসেবে অনেক পোকামাকড় ও ছোট ছোট জলজ উদ্ভিদ খায়। এতে পোকামাকড় প্রাকৃতিকভাবেই অনেকটা নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। আবার অতিথিপাখির মল জলাশয়ের মাছেদের প্রিয় খাবার।


আবার অনেক সময় অতিথি পাখিরা শিকারীর ভয়ে কোন কোন এলাকায় আর আসতে চায় না। ফলে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে আমরাই বঞ্চিত হই। কারণ ঝাক বেধে অতিথি পাখিরা যখন তাদের স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে সেটা অবশ্যই পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের একটি।

শুধু পাখিই নয়, আরো বেশকিছু প্রাণী আছে যারা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল পথ। তার মধ্যে তিমি, ব্লুফিশ, লেমিংস, লবস্টার, কচ্ছপ, ঈল, মোনার্ক প্রজাপতি, প্লোভারসহ আরো অনেকেই আছে।

লুকিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকার নাম হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রাঃ

শীত থেকে বাঁচতে পাখিরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়। কিন্তু ধরেন যারা উড়তে পারে না, আবার শীতও একদমই সহ্য করতে পারে না, তারা কী করবে!


ভয় নেই, ওদের জন্যও রয়েছে শীতকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা। এদের এই ব্যবস্থার নাম হাইবারনেশন। অনেক প্রাণীই শীত থেকে বাঁচতে হাইবারনেশন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। হাইবারনেশন হচ্ছে শীতকালে প্রাণীদের লম্বা, গভীর এক ঘুমের নাম।

প্রাণীরা সুবিধামতো একটা গর্ত খুঁজে নিয়ে একটানা অনেকদিন ঘুমিয়ে থাকে। এদের কাছে কুম্ভকর্নও ফেল বলতে পারেন। এসময় প্রানীদের দেহের তাপমাত্রা কমে যায়। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ও রক্ত চলাচল এতোই কমে যায় যে, দেখলে মনে হবে প্রাণীটি বোধহয় মারা গেছে। কিন্তু আসলে এসব প্রাণী এসময় ঘুমিয়ে থাকে।

সাধারনত শীতল রক্তের প্রাণীরা (যেমনঃ ব্যাঙ, সাপ) শীতকালে এ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাই এসময় বাইরে ব্যাঙ বা সাপ তেমন একটা দেখা যায় না। কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

শীতনিদ্রার সময় প্রাণীরা শরীরের জমানো চর্বি পুড়িয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকে। এ দলে সরীসৃপ প্রাণী যেমন গিরগিটি, কচ্ছপ এবং বেশ কিছু পোকামাকড় আছে।

তবে উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের অনেকেও শীতকালে হাইবারনেশনের আশ্রয় নেয়। কাঠবিড়াল, বাদুড়, ধেড়ে ইদুর, ছোট ইদুর, সাদা গলার পোরউইল পাখি ইত্যাদি হাইবারনেশনের মাধ্যমে শীত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে।

যুদ্ধ করে বাঁচার নাম অ্যাডপ্টশন বা অভিযোজনঃ

অনেক প্রাণী শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। গরম পোশাক কেনার পয়সা নেই তাতে কী। প্রাকৃতিকভাবেই যুদ্ধ করার মতো দৈহিক অবস্থা এদের আছে। এদের দেহে চামড়ার নীচে চর্বির অনেক মোটা স্তর থাকায় এরা সহজে শীতে কাবু হয় না। চর্বির এই স্তরকে বলে ব্লাবার। এই ব্লাবার তাদের দেহকে শীতেও গরম রাখে।


এসব প্রাণীদের মধ্যে আছে মেরু ভালুক, সীল এবং তিমি ইত্যাদি। তাছাড়া দেহে অনেক ঘন লোমও এদের শীতের হাত থেকে বাঁচায়। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, এসব প্রাণীর কারো কারো দেহের এক ইঞ্চি জায়গায় গড়ে এক মিলিয়ন লোম থাকে। মানুষের মাথায় গড়ে এক মিলিয়ন করে চুল বা লোম থাকে। এবার তুলনা করে আপনি বলেন, ওদের কি আর সোয়েটার বা জ্যাকেট পড়ার দরকার আছে? যেমন মেরু ভালুক এবং মেরু শেয়ালের দেহে এরকম ঘন লোম দেখা যায়।

তাছাড়া অন্য এলাকার প্রাণীদের চেয়ে শীতপ্রধান অঞ্চলের প্রাণীদের দেহ গঠনেও অনেক পার্থক্য আছে। যেমন ধরো, মেরু শেয়ালের কথা। এদের দেহ অন্য এলাকার শেয়ালের চেয়ে একটু গোলগাল ও স্থুলাকার। এ ধরনের দেহ তাপমাত্রা সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া এদের নাকমুখ একটু ছোটখাটো এবং কানটাও ছোট ও গোলাকৃতির। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের দেহ থেকে তাপ বের হয় কম।


আগেই জেনেছেন এদের সারা দেহ ঘন লোমে ঢাকা। একইভাবে এদের পায়ের পাতাও লোমে ঢাকা। এদিকে মরু শেয়াল যখন ঘুমায় তখন এদের লম্বা লোমশ লেজ দিয়ে দেহকে জড়িয়ে নেয়। অনেকটা মাফলারের মতো করে। তাই শুণ্যের নিচের তীব্র শীতেও ওরা দিব্যি আরামেই থাকতে পারে।

যে কথা না বললেই নয়ঃ
প্রাণীদের শীত থেকে বাঁচার উপায়গুলো তো জানলেন। প্রাণীরা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু বৈশিষ্ট্য পেলেও মানুষের কিন্তু তা নেই। মানুষকে তাই শীতে গরম পোষাক পড়তেই হয়।

আপনার আশে পাশে অনেক মানুষকে নিশ্চয়ই দেখছেন যারা শীতে গরম পোষাক পড়তে পারে না। কারণ কি জানেন? ওদের আসলে শীতের পোষাক কেনার সামর্থ্য নেই। ওদের শীতনিদ্রায় যাওয়ার উপায় নেই, ওদের চামড়ার নিচে নেই পুরু চর্বি, গরমের দেশে পাড়ি দেওয়ার টাকাও নেই ওদের কাছে। ফলে অসহায়ের মতো শীতের কামড় সহ্য করতে হয় ওদের। শীত সহ্য করতে না পেরে প্রতি বছরই কিছু মানুষ মারা যায় আমাদের দেশে। কিন্তু তোমার কাছে হয়তো অনেকগুলো শীতের পোষাক।

বাড়তি দু'একটা পোষাক ওদেরকে বিলিয়ে দিলে আপনার খুব ক্ষতি হবে না। কিন্তু ওদের দারুণ উপকার হবে। সুতরাং একটু ভেবেই দেখেন না ওদের জন্য কিছু করা যায় কিনা।

লেখিকাঃ শারমীন আফরোজ।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

২টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।