পৃথিবীর আদিম গোষ্টি ।। World Primitive Cultures

আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিব পৃথিবীর কিছু আদিম গোষ্টির সাথে যারা বর্তমান যুগেও প্রযুক্তির ছায়া থেকে দূরে বনে জংগলে বসবাস করে।


Oldest Awá- An endangered indigenous group of people:
পৃথিবী থেকে যে কয়টি আদিম জনগোষ্ঠী বিলুপ্ত হতে চলেছে তাদের মধ্যে ব্রাজিলের Awá বা Guajá জনগোষ্ঠী অন্যতম। এদের আবাস ব্রাজিলের পূর্ব আমাজনে। এই জনগোষ্ঠীর বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ৩৫০ জন, যার মধ্যে ১০০ জনই বাইরের বিশ্বের খবর জানেনা। উনবিংশ শতাব্দীতে এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮০০ জন। এদের বেশির ভাগই বাস্তুহারা হয় ইউরোপিয়ানদের আগমনের ফলে। নগ্ন ও আদিম এই জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিশ্বব্যাংক ১৯৮২ সালে ব্রাজিল সরকারকে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয়।


পিগমিঃ
পিগমি মধ্য আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা প্রধানত হ্রস্বকায় বলে বিশেষভাবে পরিচিত। এরা আফ্রিকার আদিমতম জনগোষ্ঠী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও এদের অস্তিত্ব ছিল। ফিলিপাইনের ইয়েতা আদিবাসীরা মূলতঃ পিগমি। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও পিগমিদের অস্তিত্ব আছে। এরা আছে পাপুয়া নিউগিনিতে। পিগমি বলতে সাধারণভাবে হ্রস্বকায় যে কোন প্রাণী বোঝানো হলেও পিগমি মূলতঃ বামনাকৃতির জঙ্গলবাসী একটি প্রাচীন মানবসম্প্রদায়। খ্রীস্টপূর্ব ২২৫০ অব্দের একটি চিঠিতে পিগমিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় বিংশ শতাব্দীতে এই জাতিগোষ্ঠী বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে পিগমিদের সংখ্যা ১ লক্ষের বেশী হবে না। এদের উচ্চতা সব্বোর্চ্চ সাড়ে ৪ ফুট হয়ে থাকে ; প্রাপ্তবয়স্ক আর শিশুর মধ্যে উচ্চতার তফাৎ করা তাই কঠিন। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, পিগমিদের এ খর্বাকৃতির কারণ হলো, শরীরের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য যে ইনসুলিন জাতীয় আইজিএফ নামের উপাদানটি কাজ করে, পিগমিদের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। এ কারণেই এরা হ্রস্বকায় হয়ে থাকে। জঙ্গলে পিগমিরা নিজেরাই ঘরবাড়ি তৈরি করে। তাদের ঘরবাড়িগুলোও আকারে-উচ্চতায় ছোট হয়। জঙ্গলবা্সী এই আদিমানব শিকার করে জীবন ধারণ করে। আদিম মানুষের মতো দলবেঁধে পিগমিরা শিকারে যায় এবং বন্যপশু শিকার করে।। এরা সবচেয়ে পছন্দ করেন "বল্লু ডুকার" নামে এক ধরনের ছোট হরিণ। পিগমিরা শিকার ধরে জালে আটকে। এই জাল তৈরি করা হয় এনকুসা নামে এক ধরনের দৃঢ় গুল্ম দিয়ে। ফলে জালগুলো হয় খুবই শক্ত। পশু শিকারের সময় তারা কোমর সমান করে জালগুলো পেতে ছোট কাঠের টুকরা দিয়ে নিচগুলো ভালো করে আটকে তারপর শিকারকে তাড়িয়ে জালে এনে আটক করেন। শিকার যদি হাতি বা ওই ধরনের বড় আকৃতির কিছু হয়, তবে জালবন্দি অবস্থায় তীর মেরে দুর্বল করে দেওয়া হয়। শিকার নিয়ে তারা দলবেঁধে গ্রামে ফেরেন। এ সময় পিগমি নারীরা দলবেঁধে নাচে। তাদের বিশ্বাস, গর্ভাবস্থায় কোনো মহিলার সামনে এ শিকার ও শিকার-পরবর্তী উৎসব সৌভাগ্যের প্রতীক। পিগমি জাতিগোষ্ঠীরও দলনেতা থাকে আর এ দলনেতা নির্বাচিত হয় কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। দলনেতাকে তুখোড় শিকারি হতে হয়। এদের কয়েকটি উপজাতি হলো Mbenga (Aka এবং Baka), Mbuti এবং Negrito। ক্যামেরুন, কঙ্গো এবং গ্যাবনের জঙ্গলে Mbenga উপজাতির বাস। কঙ্গোতে Mbuti প্রজাতির প্রায় ৩০-৪০ হাজার পিগমি আছে।


কারেন পাদায়েং:
Karen Padaung (কারেন পাদায়েং) উপজাতির আবাস বর্তমান মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের Mae Hong Sorn এবং Phrae প্রদেশে। এই উপজাতির মেয়েদের গলা অস্বাভাবিক লম্বা। এটাই এই উপজাতীয় মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতীক। এসব মেয়েদের বয়স যখন বয়স ৫ থেকে ৬ তখন থেকেই এই উপজাতির পুরুষরা তাদের গলায় একটি তামার স্প্রিং পরিয়ে দেয়। এই স্প্রিং-এর টানে এসব মেয়েদের গলা বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে আস্তে আস্তে লম্বা হয়। পরিপ্রেক্ষিতে একটি যুবতী মেয়ের গলা প্রায় ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।তারা এই স্প্রিং সবসময় পরে থাকে তাদের বিশ্বাস স্প্রিং খুললেই তাদের ঘাড় যে কোন সময় মটকে যাবে। বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত এই উপজাতির মেয়েরা কানের দুল পরেনা!


বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একদা দুর্গম আন্দামান ব্রিটিশ ভারতে পরিচিত ছিল ‘কালাপানি’ নামে। ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেককে পাঠানো হতো এখানকার কুখ্যাত সেলুলার জেলে। আন্দামান ও নিকোবর ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঙ্গরাজ্য। ৫৭২টি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে এ রাজ্য গঠিত। এসব দ্বীপের বেশির ভাগই জনবসতিহীন। দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে রয়েছে গভীর জঙ্গল। যেখানে বাস করে জারোয়া ছাড়াও ওঙ্গি, গ্রেট আন্দামানিজসহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়। তারাই এই আন্দামান দ্বীপের আদি মানুষ। ধারণা করা হয়, আফ্রিকা থেকে যেসব মানুষ প্রথম এশিয়ায় পাড়ি জমায়, এদের অনেকে তাদেরই বংশধর। এদের মাত্র কয়েক শ করে সদস্য টিকে আছে এখন। জারোয়ারা থাকে আন্দামানের দক্ষিণ-পূর্বের দ্বীপে। তাদের সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রা এখনো আদিম ধরনের। জারোয়ারা উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। বনের জীবজন্তু ও ফলমূল আর সমুদ্রের মাছ তাদের মূল খাদ্য। নিজেদের এলাকায় বাইরের মানুষ ঢুকে পড়লে তাদের বিষমাখা তীর ছুঁড়ে হত্যা করতে দ্বিধা করে না জারোয়ারা। এ কারণে জারোয়া অঞ্চলে পর্যটকসহ বাইরের মানুষের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। বাইরের প্রভাব ও রোগ ছড়ানো থেকে আদিবাসীদের সুরক্ষাও এ নিষেধাজ্ঞার অন্যতম কারণ। জারোয়াদের আবাসস্থলকে তাই ঘোষণা করা হয়েছে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে।গোটা আন্দামানে ৪০৪ জন জারোয়ার বাস।


জুলুঃ
আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ লোকের একটি জনগোষ্ঠীর নাম Zulu (জুলু)। যাদের মূল বসতি দক্ষিণ আফ্রিকার Kwa-Zulu Natal (কোয়া-জুলু নাটাল) প্রদেশে। জুলুদের উৎপত্তি উত্তর কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী Nguni (উনগুনি) থেকে। জুলু জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করা হয় Zulu Kantombhela( জুলু কান্টোমভেলা)-কে যিনি ১৭০৯ সালে জুলু জাতির গোড়াপত্তন করেন। তখন এই প্রদেশটিতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র Nguni (উনগুনি) জাতিগোষ্ঠীর বসতি ছিল যাদের অপর নাম হল Imji । উনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে জুলুদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তখন কৃষ্ণকায় জুলুদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হত। কিন্তু বর্তমানে তারা সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। আধুনিক জুলু জনগণ শহর এবং গ্রাম উভয় অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। যদিও কোয়া-জুলু নাটালই এখনও তাদের মাতৃভূমি হিসেবে স্বীকৃত, তথাপি জুলুদের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী গটেং প্রদেশের তুলনামূলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখে সেখানে বসতি গড়েছে। অবশ্য এই প্রদেশেরও সবচেয়ে বেশী কথিত ভাষা হচ্ছে জুলু ভাষা। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে জুলুদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা । দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন এবং বর্তমান উভয় উপ রাষ্ট্রপতিই জুলু জাতির। তারা হলেন যথাক্রমে জ্যাকব জুমা এবং ফুমজিল উমলাম্বো-উংগুকা (Phumzile Mlambo-Ngcuka)। জুলু জনগোষ্ঠীর ভাষা হল জুলু বা ইসিজুলু যা বান্টু ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। জুলু দক্ষিণ আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশী কথিত ভাষা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় অর্ধেক মানুষই এই ভাষা বুঝতে পারে। মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়েতে বসবাসকারী জুলুরা খৃস্টান (রোমান ক্যাথলিক অথবা প্রোটেস্ট্যান্ট)। তবে জিম্বাবুয়েতে অনেক জুলুই আধা খৃস্টান এবং আধা প্রকৃতি পূজারী। অন্যান্য সব জুলুই প্রকৃতি পূজারী।


Eskimo (Esquimaux) বা এস্কিমোঃ
একটি নৃগোষ্ঠী যারা মূলত উত্তর আমেরিকার আলাস্কা, কানাডা ,গ্রীনল্যান্ড এবং পূর্ব সাইবেরিয়া সুমেরুবৃত্তীয় বরফ ঢাকা অঞ্চলে বসবাস করে। Eskimo শব্দটির অর্থ কাঁচা মাংস ভক্ষণকারী। এরা কাঁচা মাংস খায় বলে Red Indian-রা তাদের এ নামে ডাকেন। নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকগণের ধারণা Eskimo-রা ম এশিয়ার মঙ্গোলীয় জাতির বংশোদ্ভূত এবং অনেক বছর আগে জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে Eskimo-রা Inuit–Yupik (আলাস্কায় Inupiat–Yupik) নামে পরিচিত। Eskimo-দের জীবনযাত্রা খুবই কঠিন। প্রচণ্ড শীতে এরা থাকতে অভ্যস্ত। জীবনের চাহিদাও কম। সমুদ্রের সীল, তিমি ইত্যাদি শিকার করে নিজেদের খাদ্য-খাবার, ঘরবাড়ি, তেল ও জ্বালানির ব্যবস্থা করে। গরমকালে এরা বলগা হরিণ ও সীলমাছের চামড়ায় তৈরি তাঁবুতে বাস করে। আবার যখন শীত পড়ে, বরফ জমে যায় সর্বত্র, তখন তারা বরফ খুঁড়ে পাথর বা ঢাকনা দিয়ে আবাসস্থল তৈরি করে। এই ঘরকে বলা হয় Igloo । স্থলপথে Eskimo-রা চলাচলের জন্য কুকুরে টানা গাড়ি ব্যবহার করে। এই গাড়িকে বলা হয় স্লেজ গাড়ি। জলপথে ব্যবহার করে চামড়ার তৈরি ছোট ছোট নৌকো। এই নৌকোর চামড়া Umiak বা Kayak নামে পরিচিত। গোটাবিশ্বে Eskimo-দের সংখ্যা প্রায় কোটির কাছাকাছি। মরা মেরুভালুক, তিমি মাছ ও সিন্ধুঘোটক তাদের কাছে প্রিয় প্রাণী।

লেখকঃ মামুনুর রশিদ এবং রাজিব হুমায়ুন তন্ময়।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info