একটি ঘাতক লেক


২১শে আগস্ট ১৯৮৬। পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ ক্যামেরুনের বর্ষাসিক্ত উচ্চ ভূমিতে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। মেষপালক হাদারী তার পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ের উপর একটি বাড়িতে থাকে। পাহাড়ের নিচেই হালকা আলোতে জ্বলজ্বল করছে লেক নাইওস। কেউই তখন কল্পনা করতে পারেনি যুগ যুগ ধরে ওদের জীবন-জীবিকার উৎস এই লেক তাদের জন্য প্রানঘাতী হয়ে উঠবে।

নাইওস উপত্যাকায় হাদারীদের গ্রাম লোয়ার নাইওস। সারাদিনের কাজ শেষ করে ফেরা গ্রামবাসী সন্ধ্যার খাবার এবং ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অকস্মাৎ এক বিকট শব্দে হাদারী চমকে উঠে। পাহাড়ের উপর সে তার বাড়ী থেকে বের হয়ে দেখে এক পুঞ্জ মেঘের মতো ধোয়া ভৌতিকভাবে নাইওস লেক থেকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে আসছে। ক্রমেই ধোয়া বাড়তে থাকে। নিমিষেই এ ধোয়া আশেপাশের উপত্যকা গুলোর গ্রাম গুলোতেও ছেয়ে যায়। প্রাণভয়ে হাদারী তার পরিবার নিয়ে আরো উচু একটি পাহাড়ের ঝোপে আশ্রয় নেয়। ততক্ষনে পুরো লোয়ার নাইওস গ্রাম এ আজব ধোয়া আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। সারারাত ঝোপে লুকিয়ে থেকে সকালে গ্রামে ফেরে হাদারী। গ্রামে ফেরে সে তার নিজ চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে না। প্রতিটি বাড়ীর দরজায়, শোবার খাটে, ঘরের মেঝেতে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে আছে। কেউ কেউ খাওয়ারত অবস্থা মারা গিয়েছে। শুধু মানুষ নয়, গ্রামের ছোট-বড় সব প্রানীকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ী-ঘরের কোনই ক্ষতি হয়নি। অনেকটা নিউট্রন বোমার আঘাতের মত।

কি হয়েছিলো ওইদিন?
সেই ঘটনার দুই মাস পর ভূ-বিজ্ঞানী কাট স্টাগার এই দুর্ঘটনার কারন অনুসন্ধানের জন্য সেখানে যান। অনুসন্ধানে বের হয় ওইদিন লেক নাইওস থেকে ১০০ কোটি ঘন মিটার গ্যাস উদগিরণ হয় যার কারনে লেকের পানি ১ মিটারেরও বেশী কমে যায়। ওইদিন ছড়িয়ে পরা গ্যাসের ৯৮-৯৯ ভাগ ছিলো কার্বন-ডাই অক্সিড। এই বর্নহীন ঘন গ্যাস পানির চেয়ে দেড় গুন ভারী। এটি বাতাসের অক্সিজেনকে নিঃশেষ করে দেয়। একই ঘটনা ঘটেছে লেক নাইওস এলাকার গ্রামগুলোতে। বায়ুতে অক্সিজেন না থাকায় মুহূর্তের মধ্যে লোয়ার নাইওস গ্রামে ১২০০ এবং আশে পাশের গ্রামে ৫০০ এর মতো মানুষ মারা যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট।


এতো গ্যাস আসলো কোথা থেকে কিংবা এই গ্যাস উদগীরনের কারন কি?
এরকম ভয়ানক একটি ঘটনার মূল কারন এখনো সঠিকভাবে বের করা সম্ভব হয়নি। সম্ভাব্য একটি কারন হলো কয়েকশ বছর ধরে এই গ্যাস পানির সাথে মিশে এই লেকটি একটি টাইম বোমায় পরিনত হয়। কিন্তু এরকম বিস্ফারন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হল কেন?? বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড় থেকে বড় কোন পাথর ভেঙ্গে পানিতে পড়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, ঝড়ো বাতাসের কারনেও এটি ঘটতে পারে। মূল কারন হলো পানিতে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল যা সামান্য পুশেই বিস্ফোরিত হয়।

এ ঘটনার পরে লেকের কিনারে বসবাসরত আদিবাসীদের বাঁচানোর জন্য নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় কিন্তু এখনও এই লেকের পানিতে গ্যাসের পরিমান বিপদজনক অবস্থায় আছে। স্থানীয় আদিবাসীরা অবশ্য তাদের নিজস্ব পন্থায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেমনঃ তাদের ধারনা লেকের পানিতে মাম্মি ওয়াটার নামের এক ঐশ্বরিক মহিলা বাস করে, সে নাখোশ হলেই এ ধরনের দুর্যোগ আসে। তাই তারা লেকের পানিতে নানারকম পশু-প্রানীকে জবাই করে উৎসর্গ করে তাকে খুশী রাখার জন্য।

বুড়িগঙ্গা নদী হওয়াতে এ আশংকা কম কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশ সরকারের উচিত বুড়িগঙ্গা নিয়ে বাস্তব কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া। এরকম একটি ঘটনা সদরঘাট এলাকায় ঘটলে নিমিষেই ৫ লাখ মানুষ মারা যাবে। সংখ্যাটা আরো বেশী হতে পারে।

লেখকঃ মো: সালাউদ্দিন ফয়সাল।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info