সুন্দর জেলিফিশ

আমাদের পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তাদেরকে মোটমাট নয়টি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে একটি পর্ব হল ‘নিডারিয়া’। এই নিডারিয়া পর্বের হাইড্রোজোয়া শ্রেণীর প্রাণী হল জেলিফিশ। আর মাছ হল ‘পিসেস’ শ্রেণীর প্রাণী। মাছের কিন্তু আমাদের মতো মেরুদণ্ডও আছে। কিন্তু জেলিফিশের আবার এই মেরুদণ্ডের বালাই-ই নেই। তাই নামের মধ্যে ‘ফিশ’ থাকলেও আসলে ওরা মাছ নয়। ভাবছেন, তবু কেন আমরা ওদেরকে মাছ বলি? আরে, এই একই প্রশ্ন তো আমারও।

জেলিফিশ পৃথিবীতে বাস করছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর (১ মিলিয়ন বছর = ১০,০০,০০০ বছর) ধরে। এর মানে ডাইনোসরদেরও আগে ওরা পৃথিবীতে এসেছে। তার মানে হলো, কোন ভাবে যদি আমরা ওদের সাথে কথা বলাটা রপ্তো করতে পারি, তাহলেই কেল্লা ফতে! ডাইনোসরদের গল্প শোনার জন্য বিজ্ঞানীদের আর এতো কষ্ট করতে হবে না। কেবল সাগরতীরে গিয়ে ওদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিলেই চলবে!

পৃথিবীতে মোট কয় প্রজাতির জেলিফিশ আছে জানেন? প্রায় ২,০০০ প্রজাতির। এত প্রজাতির সবার পরিচয় দিতে গেলে তো আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলতে হবে! তাই আজকে আপনাদের সবচেয়ে সুন্দর জেলিফিশগুলোর গল্প বলব।


অ্যাকুয়েরা ভিক্টোরিয়াঃ
এদের কিন্তু আরো একটা নাম আছে স্বচ্ছ জেলিফিশ। কারণ এদের গায়ের কোনো রঙ-ই নেই! আর দেখতেও একদম স্বচ্ছ। জেলিফিশের শরীরের ভেতর থেকে অনেকগুলো সুতার মত এক ধরনের অঙ্গ বের হয়, এগুলোকে টেন্টাকেলস বলে। এদের টেন্টাকেলসে ‘নেমাটোসিস’ বলে একটা জিনিস থাকে, যার সাহায্যে এরা শিকার করে। এদের শরীরে আবার জিএফপি প্রোটিনও থাকে, যার কারণে ওরা দেখতে হয় নীলাভ সবুজ রঙের। এই প্রোটিন ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এমন খরগোশ বানিয়েছেন, যা অন্ধকারেও জ্বলতে থাকে! তাছাড়া এই জিএফপি থেকে আলঝেইমার রোগের ওষুধ বানানোরও কাজ চলছে। তাহলেই দেখা যাচ্ছে, এই জেলিফিশ শুধু সুন্দর নয়, অনেক কাজের কাজিও বটে!


অস্ট্রেলিয়ান বক্স জেলিফিশঃ
জেলিফিশের সব গুলো প্রজাতির মধ্যে এরাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাই এদের বলা হয় ‘সাগর বোলতা’। দেখতে এরা অনেকটা ঘনকের মতো। তাছাড়া এরা খুব দ্রুত সাঁতরাতেও পারে। আর গায়ের রং স্বচ্ছ বলে এদেরকে সহজে দেখাও যায় না। এদের আবার পেটে অনেক গুলো চোখ থাকে! আর সেই চোখ গুলোর জন্য ওদের দেখতে বেশ ভয়ংকর লাগে! এদের নেমাটোসিস, যা দিয়ে ওরা শিকার করে, সেটা এতোই ঘন হয়, যে এদের বিষ দিয়ে খুব সহজেই ডজন খানেক মানুষকে মেরে ফেলা যেতে পারে।


বাথিকোরাস বউলোনিঃ
জেলিফিশের এই প্রজাতিটি মানুষের চোখে পড়েছে খুব বেশিদিন হয়নি, মাত্র বছর দশেক আগে। আর আবিষ্কারের পরপরই ওদের নিয়ে মহা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো। কারণ? এরা দেখতে অনেকটাই ‘স্টার ওয়ারস’ সিনেমার ডার্থ ভেডারের মতো। এরা প্রধানত আর্কটিকের আশেপাশের গভীর সমুদ্রে বাস করে। এদের শরীরে মোট টেন্টাকেলস আছে আটটি। আর অদ্ভুত আকৃতির এই জেলিফিশ গুলোর মাথায় প্যাঁচও কম নেই। সাঁতার কাটার সময় ওরা কি করে জানেন? যে টেন্টাকেলস গুলো বিষাক্ত, সেগুলো সামনের দিকে রেখে তবেই সাঁতার কাটে!


কোস্টারিকান জেলিফিশঃ
নাম শুনেই তো বুঝতে পারছেন, জেলিফিশের এই প্রজাতিটি কোস্টারিকার উপকূলে থাকে। এরা দেখতে অনেকটা বহুভুজ আকৃতির। ভাবছেন ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ এদের নাম তো শুনেছি; কিন্তু এই বহুভুজটা আবার কি জিনিস? ত্রিভুজের থাকে তিনটা বাহু বা রেখা, চতুর্ভুজের থাকে চারটা, পঞ্চভুজের থাকে পাঁচটা। আর বহুভুজের থাকে চারটার বেশি। মানে পঞ্চভুজও এক ধরনের বহুভুজ। এই জেলিফিশ গুলোও হয় এমন অদ্ভুত আকারের। আর অন্য জেলিফিশদের তুলনায় এর কিন্তু একটু আলাদা। কারণ লার্ভা মানে বাচ্চা জেলিফিশ থেকে এরা একলাফে পুর্ণবয়স্ক জেলিফিশ হয়ে যায়। ওদের জীবনে কৈশোর, যৌবন বলে কিছুই নেই! এরা দেখতে গাঢ় গোলাপি রঙের হয়। আর থাকে সমুদ্রের প্রায় ৮,০০০ মিটার গভীরে।


ফ্লাওয়ার হ্যাট জেলিফিশঃ
নাম শুনেই তো বুঝতে পারছেন, এদের বিশেষত্ব কি। হ্যাঁ, এদের মাথায় গোলাপি রঙের একটা হ্যাটের মতো থাকে। আর এই হ্যাটটার জন্যেই ওদেরকে সুন্দর লাগে! তবে সুন্দর হ্যাট পরা দেখে ওদেরকে আবার আদর করতে যাবেন না যেনো। ওদের বিষ কিন্তু খুবই যন্ত্রণাদায়ক। তবে ওরা মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। কারণ, ওরা সাধারণত ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। আর থাকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও জাপানের সাগরে।


ফুট লং টেন্টাকেলস জেলিফিশঃ
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, এরা বেশ লম্বা। লম্বায় এরা প্রায় ১ ফুট পর্যন্ত হয়, মানে পায়ের সমান হয় আরকি। আর থাকে কোথায় জানেন? পশ্চিম আটলান্টিকের বরফ শীতল পানিতে। সেখানকার তাপমাত্রা কত জানেন? মাইনাস ৬০ ডিগ্রিরও অনেক নিচে! কতো ঠাণ্ডা পানি রে বাবা! এদের দেহ নরম ও টিউব আকারের এবং দেখতে বাদামি, লালচে বাদামি থেকে কমলা রঙের হয়ে থাকে। দেখতে অনেক সুন্দর হলেও আপনি কিন্তু চাইলেও এদের পুষতে পারবেন না। কারণ এদের থাকার জন্য অনেক বড় অ্যাকুরিয়াম আর প্রচুর আলো প্রয়োজন। আর আত্মরক্ষার জন্য এদের টেন্টাকেলসে থাকে বিষকোষ। যখনই বিপদে পড়ে, এই বিষকোষ-ওয়ালা টেন্টাকেলস দিয়ে ওরা শত্রুদের গায়ে পেঁচিয়ে ধরে।


মুন জেলিফিশঃ
জেলিফিশের সমস্ত প্রজাতির মধ্যে এদেরকেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অনেকে আবার আদর করে এদেরকে সসার জেলীও বলে। আর এরা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি এদের চলনও ছন্দময়। ভাবছেন, এদের নাম মুন মানে চাঁদ হলো কিভাবে? আরে, ওরা দেখতে যে একদম পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের মতোই। এরা মেডুস, প্লাঙ্কটন আর মলাস খেয়ে বেঁচে থাকে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? ওদের মায়েরা বাচ্চা দেওয়ার কয়েক মাস পরেই মারা যায়!


ফিয়ালেলা জ্যাপাইঃ
জেলিফিশের নাম দেওয়ার বেশ কয়েকটি গল্প আছে! যেমন ধরেন এই ফিয়ালেলা জ্যাপাই জেলিফিশের নামের গল্পটাই শোনেন। যে বিজ্ঞানী এই জেলিফিশের নামকরণ করেছিলেন, তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন ফ্রাঙ্ক জ্যাপা। আর তার নামের অনুকরণেই সেই বিজ্ঞানী এই জেলিফিশটির নামই দিয়ে দিলেন জ্যাপাই! আর এই গল্প শুনে ফ্রাঙ্ক জ্যাপা খুশির চোটে তো সরাসরি সেই বিজ্ঞানীর কাছেই চলে গিয়েছিলেন। আর এই প্রজাতির জেলিফিশের সবচেয়ে মজা কি জানেন? এদের টেন্টাকেলস গুলো সারা জীবন ধরে আকারে তো বাড়েই, সংখ্যাতেও বাড়তে থাকে।


রোপিলেমা এস্কুলেন্টামঃ
এই জেলিফিশগুলোকে আবার ‘চায়না টাইপ’ জেলিফিশও বলা হয়। কেন? কারণ চীনের উপকূলে যে এদের প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এরা দেখতে কিছুটা লালচে রঙের। আর মাথার উপরে আছে এক ছাতার মতো অঙ্গ, যার ব্যাস ৩০০-৬০০ মিলিমিটার (১০ মিঃমিঃ=১ সেঃমিঃ)। আর এরাই জেলিফিশের একমাত্র প্রজাতি যাদের খাওয়া যায়। আর তাই জাপানে রীতিমতো এদের চাষ করা হয়!

লেখকঃ ফাহিম রফিক।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info