উল্কা আর উল্কাবৃষ্টি ।। Meteors & Meteor Showers


‘উল্কা’ জিনিসটা আসলে কী? উল্কাবৃষ্টি আসলে কেন হয়? আর কেনই বা উল্কাদের খসে পড়া তারার মতো দেখায়?

প্রথমে আসা যাক, উল্কা কী, সে প্রশ্নে, যে সব বস্তু মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের বলে মহাজাগতিক বস্তু। এ রকম কোনো মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর যথেষ্ট কাছে এসে পড়লে, পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে বস্তুটি ভূপৃষ্ঠের দিকে তীব্র বেগে এগোতে থাকে। তখন এর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের কণা গুলোর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ ও ঘর্ষণের ফলে বস্তুটি জ্বলে ওঠে। তখন যে ক্ষণস্থায়ী সরু আলোর রেখা দেখা যায়, সেটাই উল্কা। বেশির ভাগ সময় উল্কার আকার এত ছোট হয় যে, এটি ভূপৃষ্ঠে আসতে আসতেই জ্বলে ছাই হয়ে যায়। তবে যদি বস্তুটি মোটামুটি বড় আকারের হয়, তখন সেটি পুরোপুরি পুড়ে ছাই হয়ে যায় না। বস্তুটির অবশিষ্টাংশ ভূপৃষ্ঠে ভীষণ জোরে আছড়ে পড়ে। এই অবশিষ্টাংশকে বলে উল্কাপিণ্ড।

কিন্তু ঠিক কোন মহাজাগতিক বস্তু আসে এ ভাবে?

পৃথিবীর চারপাশে শুক্র বা মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত তেমন কিছুই নেই। অথচ শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৫টি উল্কাপাত দেখা যায়।

এই মহাজাগতিক বস্তু গুলো আসে কোত্থেকে?


সৌর জগতের সবচেয়ে ছোট সদস্য গ্রহাণু। এই গ্রহাণু গুলো পৃথিবী থেকে বেশ দূরে অবস্থান করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এগুলো ছাড়াও মহাশূন্যে অসংখ্য ছোট ছোট বালুকণা আর পাথরের টুকরোর মতো পদার্থ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। সিংহ ভাগ উল্কাই এসব কণার মাধ্যমে সৃষ্ট। এই কণা গুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে সংঘর্ষে জ্বলে ওঠে। খুব ছোট হওয়ায় এদের কেউই পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। প্রতি ১০০ বছরে হয়ত কয়েকটি ছোটখাট টুকরো পৃথিবী পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। আর বিশাল খাদ কিংবা ডাইনোসরদের বিলুপ্ত করে দেওয়ার মতো ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী বিশাল উল্কা আসার সম্ভাবনা হিসেব করলে প্রতি ৩ লক্ষ বছরে একবার! এগুলো হল গ্রহাণু বেল্টের কোনো বিক্ষিপ্ত সদস্যের কাজ। যারা ঘুরতে ঘুরতে মঙ্গল ও পরে পৃথিবীর আকর্ষণে পথ বদলাতে গিয়ে, শেষমেশ পৃথিবীর মহাকর্ষ বল এড়াতে না পেরে এখানে আছড়ে পড়ে।

সাধারণত ভোরের দিকে সন্ধ্যার চেয়ে বেশি উল্কা দেখা যায়। কারণ, সে সময় উল্কাদের অবস্থান থাকে পৃথিবীর গতির দিকে। আর খালি চোখে আমরা যে সব উল্কা দেখি, সেগুলো প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার উপরে থাকে। আর এদের বেগ থাকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।

এ তো গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া উল্কাদের কথা। এখন আসা যাক উল্কা বৃষ্টির গল্পে। প্রতি বছরই কিছু নির্দিষ্ট দিনে আকাশে উল্কার পরিমাণ বেশ বেড়ে যায়। ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ টা উল্কাও দেখা যায়। একেই বলে উল্কাবৃষ্টি।


এই অসংখ্য উল্কা আকাশের একেকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই আসে। এই জায়গা গুলিকে বলে বিকিরণ বিন্দু বা ‘radiant’। এ থেকে মনে হতেই পারে, এগুলো নিশ্চয়ই একই মাতৃ বস্তু থেকে আসছে; আসলেও তাই। এর জন্য প্রায়ই দায়ি থাকে ধূমকেতু। ধূমকেতুর শেষে যে লেজ থাকে, সেটা মূলত বরফ কণা পূর্ণ গ্যাসীয় পদার্থে তৈরি। ধূমকেতু যখন সূর্যের খুব কাছে চলে যায়, এই লেজের কিছু অংশ বলা যেতে পারে খসে যায়। এই অবশিষ্টাংশ এদের কক্ষপথের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকে। চলার পথে পৃথিবীর কাছে চলে আসলে, কাছাকাছি অঞ্চলের টুকরোগুলো উল্কা হয়ে পৃথিবীর দিকে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসে। এভাবেই উল্কাবৃষ্টির সৃষ্টি হয়।

যে নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে উল্কাবৃষ্টি হয়, সেগুলো থাকে একেকটি তারা মণ্ডলের মধ্যে। তাই অবস্থান শনাক্তকরণ সহজ করতে একেকটি উল্কাবৃষ্টি যে তারা মণ্ডলের পটভূমিতে হয়, সেই তারামণ্ডলের নামানুসারে উল্কাবৃষ্টির নামকরণ করা হয়। তবে তারা মণ্ডলের নামের শেষে সাধারণত ids অথবা nids যোগ করা হয়। অনেক সময় তারা মণ্ডলের নামের শেষের দু একটা বর্ণও বাদ দেয়া হয়। যেমন, আগস্টের ১২ তারিখে যে উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়, তার নাম ‘পারসেইডস’ (perseids)। এই উল্কাবৃষ্টির নামকরণ করা হয়েছে পারসিয়াস তারা মণ্ডল থেকে। উল্কা বৃষ্টিটি হয়েছিল ‘সুইফট টাটল’ নামক ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশ থেকে। আবার অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে দেখা যায় ‘ওরায়নিডস’ (orionids) নামক উল্কাবৃষ্টি। এটির নামকরণ করা হয়েছিল কালপুরুষ তারামণ্ডল (orion) থেকে। উল্কাবৃষ্টিটি হয়েছিল হ্যালির ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশ থেকে।

এই দিন গুলিতে বা তার একদিন আগে ও পরের দিন গুলোতে রাতের আকাশে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩০ থেকে ৪০টা উল্কা চোখে পড়ে। যদি কমও দেখা যায়, তবু অন্তত ০৫ থেকে ১০টা উল্কা চোখে পড়বেই। ভাগ্য ভালো হলে একসঙ্গে কয়েকটাও দেখা যেতে পারে। তবে ঢাকার মতো আলো দূষণময় শহর গুলিতে অবশ্য এ নিয়ম খাটে না। এই ধরনের শহরে এত উল্কা দেখা যায় না।

লেখকঃ সৈয়দা লামিম আহাদ।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info
জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info